আমি একজন অতি সাধারন মানুষ। সুন্দরের সন্ধানে ঘুরে বেড়াই জলে স্থলে অন্তরীক্ষে। এই ব্লগে প্রচারিত ধারাবাহিক উপন্যাস এবং কবিতা আমার নিজ ব্লগ নীল নক্ষত্রে প্রচার করছি।
নক্ষত্রের গোধূলি-১৬
চেক ইন, ইমিগ্রেশনের ঝামেলা সেরে ওয়েটিং লাউঞ্জ। কিছুক্ষণ বসেই রাশেদ সাহেব পাশে বসা মনির হাত ধরে আবার গেয়ে উঠলেন ‘তরে লইয়া যাইমু আমি লন্ডনে-----,।
মনিরা শুকনো কাঠের মত একটু হেসে হাতটা ছাড়িয়ে উঠে গিয়ে বাসায় ফোন করে খবর নিয়ে এলো গাড়ি পৌচেছে কি না। ওদের পৌছার খবর পেয়ে নিশ্চিন্ত হোল। মাইকে নারী কণ্ঠের ঘোষনা ভেসে এলো, উঠে প্লেনে উঠার গ্যাং ওয়ের গেটের কাছে এসে কিউতে দাঁড়ালেন। বোর্ডিং কার্ড চেক হবার পর শেষ বারের মত সিকিউরিটি চেক সেরে আস্তে আস্তে গ্যাং ওয়ে দিয়ে প্লেনের ভিতর এসে সীট নম্বর খুঁজে বসে পরলো।
মনিরা জানালার পাশে তার পাশে রাশেদ সাহেব।
রাশেদ সাহেব আবার সেই গান গাইছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সব যাত্রী ওঠা হলে মাইকে বিমান বালার কন্ঠ ভেসে এলো, যাত্রী দের সীট বেল্ট বাধার অনুরোধ এবং ঢাকা বিমান বন্দর ছেড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই কুয়ালালামপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে জানিয়ে দিল। একটু পরেই প্লেন টারমাক ছেড়ে এসে রান ওয়ে দিয়ে ছুটে চলে এক সময় ঢাকা বিমান বন্দরের মাটি ছেড়ে আকাশে উড়ে গেল। নিচে রাতের ঢাকা শহরের ঝকমকে নানা রঙের বাতি পরে রইলো।
রাশেদ সাহেবের মুখটা মলিন হয়ে গেল।
এই ঢাকা শহর আমাকে একটু জায়গা দিতে রাজী হোল না। আমার নিজের শহর, নিজের দেশ ছেড়ে আমাকে যেতে হচ্ছে ভিন্ন দেশের ভিন্ন শহরে। মনি রাশেদ সাহেবের এই পরিবর্তন দেখে তার মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিয়ে বললো মন খারাপ কোরনা, এইতো কদিন দেখতে দেখতে চলে যাবে তার পরে তো আবার আসবে। তত ক্ষনে প্লেন অনেক উপরে উঠে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর শহরের দিকে উড়ে চলেছে। নিচে তখন কিছু কিছু ছিটে ফোটা আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে।
রাশেদ সাহেব মনির বুক থেকে মাথা উঠিয়ে জানালা দিয়ে নিজ দেশের শেষ বিন্দুটা দেখে নিতে চাইলেন কিন্তু আর সে সময় পেলেন না। প্লেন তত ক্ষনে বাংলাদেশের স্থল সীমা পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে এগিয়ে চলছে।
রাশেদ সাহেব অনন্তের উদ্দেশ্যে যাত্রার শেষ মুহুর্তে নিজ দেশের শেষ কণা টা দেখতে না পেরে মনটা বিষণ্নতায় ভরে গেল, মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। মনিরা দেখতে পেয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে তার নিজ মনের বিষণ্নতা, যাতনা কষ্ট সব চেপে রেখে হেসে ফেলল, কি হয়েছে তাই, এমন মন খারাপ করছ কেন?
মানুষটা এইতো এতো ক্ষন কি আনন্দে ছিল। হঠাত্ করেই কেমন নিভে গেল।
মনি সব বুঝতে পারল। বুঝেও না বোঝার ভান করে তার কাঁধে স্বামীর মাথা টেনে নিয়ে বলল দেখ একটু ঘুমাতে পার কি না। রাশেদ সাহেব কিছু না বলে সুবোধ বালকের মত স্ত্রীর কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রইল। কখন যেন একটু তন্দ্রার মত এসেছিল বুঝতে পারেনি। মনির কথার শব্দে তন্দ্রা ভাব কেটে মনির দিকে তাকিয়ে দেখে মনি কার সাথে কথা বলছে।
এ পাশে চেয়ে দেখে মালয়েশিয়ান এয়ার হোস্টেস খাবার মেনু নিয়ে এসেছে, তারা কি খাবে মনি তাই বলে দিচ্ছে। রাশেদ সাহেব মনির হাত চেপে ধরে আবার গেয়ে উঠলো সেই গানটা। মনি আবার একটু হাসল। এই হাসির আড়ালে কত কষ্ট চেপে রেখেছে তা শুধু মনিই জানে। স্বামীকে বুঝতে দেয়নি।
কত দিন পরে সে তার স্বামীকে একটু হাসি খুশি দেখছে, তার ভাল লাগা দেখছে। তাকে আর বিব্রত করা কেন, থাক না তার কষ্ট চাপাই থাক, ওকে আর জানাবার কি এমন দরকার। তার ভাল লাগায় বিঘ্ন ঘটাবার কোন ইচ্ছা হোল না, যে ভাবে চলছে চলুক। নিয়তি যে দিকে নিয়ে যায় সেদিকেই চলুক।
খাবার পরে চা খেয়ে রাশেদ সাহেব আবার মনির কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে একটু চোখ বুজে রইলো।
কতক্ষণ এভাবে ছিল তা বুঝতে পারেনি। হঠাত্ মাইকে কুয়ালালামপুর বিমান বন্দরে নামার ঘোষনা শুনেই চমকে উঠলেন।
একি মনি, তুমি আমাকে একটু ডাকবে না? তুমি একটু চোখ বন্ধ করতে পারতে। এভাবে সারা রাত জেগে রইলে কেন?
কেন আবার, দেখলাম তোমার নাক ডাকছে, কত দিন পর তুমি একটু ঘুমিয়েছ তাই আর ডাকিনি। বেয়াই এক বার এসেছিল খোজ নিতে।
উনার সিট সামনের দিকে, তোমাকে ঘুমে দেখে কিছু বলেনি চলে গেছে। আমারও চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিল।
নাও রেডি হয়ে নাও। জানালা দিয়ে দেখলেন মালয়েশিয়ার আকাশে ভোরের আলো ফুটে উঠছে। নিচে পাম বাগানের সারি দেখা যাচ্ছে।
পাহাড়ি লাল মাটির বুকে পাম গাছ গুলি দেখতে বেশ লাগছিল। দেখ মনি একে বারে ঠিক আমাদের সাভারের মত তাই না?
মনি জানালা দিয়ে দেখে বললো হ্যা তাইতো।
একটু পরেই প্লেন নেমে মাটি স্পর্শ করে মটরিং করে ধীরে ধীরে টারমাকের দিকে এগিয়ে এসে থেমে গেল। দরজা খুলে দেয়ার পর যাত্রীরা সীট বেল্ট খুলে একে একে যার যার সীট ছেড়ে নেমে গেল। রাশেদ সাহেবরাও নেমে এসে ট্রান্সফার ডেস্ক খুঁজে তাদের টিকেট দেখিয়ে বসার যায়গা এবং পরবর্তী ফ্লাইটের ডিপারচার গেট জেনে নিয়ে বসে পরল।
কায়সার বেয়াই এলো একটু পরেই।
আসেন বেয়াই।
আমি এখানে দুই দিন থাকবো, আপনারা চলে যান লন্ডনে গিয়ে দেখা হবে।
লন্ডনে আপনি কোথায় থাকবেন ফোন নম্বরটা দিয়ে যান।
ফোন নম্বর নিয়ে সে যেখানে থাকবে সে বাসার ঠিকানা দিয়ে বলল
তাহলে আসি, লন্ডনে দেখা হচ্ছে।
এখানে পাচ ঘন্টা বসে থাকতে হবে।
চলনা মনি বাইরে যেয়ে কুয়ালালামপুরে একটু বেড়িয়ে আসি। তুমি ভয় পেয়ো না, আমি এখানে সব চিনি। এয়ারপোর্টে এই পাচ ঘন্টা কি করবো?
মনি খরচের কথা ভেবে বলল, না আমার ভাল লাগছে না। তার চেয়ে চল ভেতরেই হাঁটা হাটি করি।
চারিদিকে তো কাচের দেয়াল সবকিছুই তো দেখা যায়। বাইরে গিয়ে আবার কি দেখবে? তারপরে আবার তো চৌদ্দ ঘন্টার জার্নি রয়েছে, শুধু শুধু ক্লান্তি বাড়ানোর কি দরকার?চল একটু হেটে দেখি।
বলেই মনিরা উঠে গিয়ে একটা ট্রলি নিয়ে এসে তাদের হাতের ব্যাগ গুলি ট্রলিতে নিয়ে এগিয়ে বলল এসো, ঘুরে দেখি। রাশেদ সাহেব মনির পিছনে উঠে গেলেন। এ মাথা থেকে ও মাথায় যত দোকান পাট যা আছে সব ঘুরে ঘুরে দেখে এক সময় ক্লান্ত হয়ে আবার এসে বসলেন তাদের লন্ডনের প্লেন যেখান থেকে ফ্লাই করবে সেই সি গেটের কাছে।
মনিরা খরচের কথাটা রাশেদ সাহেবকে বুঝতেই দেয়নি যে সে খরচের কথা ভেবে বাইরে যেতে চায়নি। এখানে বাইরে গেলেই অন্তত সত্তর ডলার বা পঞ্চাশ পাউন্ড খরচ হয়ে যাবে। সে জানে তার পাগল খেয়ালের বসে যা মনে আসছ তাই বলছে। সেও যদি আবেগের বশে তাই রাজী হয়ে যায় তাহলে কি আর চলে?মামার কাছ থেকে আনা টাকা দিয়ে পাউন্ড কিনে এনেছে। তাকে যে আবার এই টাকা ফেরত দিতে হবে।
লন্ডনে গিয়ে কি হবে না হবে তার কি কিছু ঠিক আছে?
আজও মানুষটা সংসারি হতে পারলো না। আজ ছাব্বিশ টা বছর ধরে দেখে আসছে সংসার সম্পর্কে কি উদাসীন। নিজের কথা আর কোন দিন ভাবতে পারবে না। এমনি কি আর বলে, তুমি না হলে আমি কবে বাতাসে উড়ে যেতাম। মনি নিজে যদি শক্ত করে হাল না ধরত তাহলে কি যে হতো কে জানে।
মানুষটার মনে সারাক্ষণ শুধু দেশ, সমাজ, প্রতিবেশী, বাবা মা ভাই বোন। কোন সময় একবার ভুলেও নিজের কথা ভাবতে দেখেনি। বাজারে গেলে দুটার বেশি তিনটা জিনিসের কথা বলে দিলে আর মনে রাখতে পারে না, লিখে দিতে হয়। টাকা, ব্যাগ আর লিস্ট লিখে বাজারে পাঠালে কখনো দেখা যায় যে খালি ব্যাগটা হাতে নিয়ে ফিরে এসেছে। কি হোল, বাজারে যাওনি?না, ওই ভ্যান ওয়ালা টা বললো ওর মেয়ের অসুখ তাই ওকে ওষুধ কেনার জন্য টাকা দিয়ে দিলাম।
আমাদের তো আছে, চলবে না?এই মানুষকে আর কি বলবে। ছাব্বিশ বছর ধরে এই দেখে আসছে।
রাগা রাগিও করা যাবে না, ওই ড্রইং রুমে টিভির সামনে বসে থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত আদর সোহাগ করে না আনা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত কিচ্ছু খাবে না। এই পাগলকে বুকে নিয়েই মনি চলছে। মনটা শিশুর মত সরল আর সাগরের মত বিশাল।
থাকুক, আমার পাগল আমার বুকেই থাক এইতো আমার পরম শান্তি। কত বলেছে ভবিষ্যতের জন্য কিছু ভাব, সে কথা কোন দিন কানে নেয়নি। অফিসের বেতন তোলার সময় চেক লিখে তার পিওন সুনীলের হাতে দিয়ে দিত। সুনীল আবার সেই টাকা এনে মনির কাছে দিয়ে যেত। কোন দিন জিজ্ঞেসও করেনি সুনীল কত টাকা দিয়েছে।
সেই জিজ্ঞেস করে নিত আজ কত টাকার চেক লিখেছিলে মনে আছে?না। চেকের মুড়ি দেখে মনিকেই তা সামাল দিতে হতো। যদিও জানে সুনীল খুবই বিশ্বাসী তবুও। ওর নিজের কখনো টাকার দরকার হলে মনির কাছে চেয়ে নিত। মনি আমাকে পঞ্চাশ টা টাকা দিতে পারবে?তার নিজের রোজগারের টাকা সে চাইছে বলে মনি কোন দিন জিজ্ঞেস করেনি টাকা দিয়ে কি করবে?মনি নিজেই এর মধ্যে থেকে সংসার চালিয়ে যা কিছু সঞ্চয় করতে পেরেছে তাই তার সম্বল।
খুব ক্ষুধা লেগেছে মনি।
মনি ব্যাগ থেকে ঢাকা থেকে বড় মেয়ের দেয়া সেদ্ধ আটার রুটি আর শামী কাবাব বের করে দিয়ে খালি হয়ে যাওয়া পানির বোতলটা ভরে এনে দিল।
নাও খাও।
তুমি খাবে না, তোমারও তো ক্ষুধা লেগেছে।
একটু পরেই দেখলো তারা যে গেট দিয়ে লন্ডন যাবার প্লেনে উঠবে সেখানে এক বিশাল ৭৪৭ বোইং এসে দাঁড়ালো।
দেখ, দেখ মনি আমরা এই প্লেনে লন্ডন যাব। ঘন্টা খানিক পর লন্ডনের যাত্রীদের প্লেনে ওঠার জন্য সি গেটে যাবার ঘোষনা শুনে তারা এগিয়ে গেল। ওদের বাংলাদেশী সবুজ পাসপোর্ট দেখে যথারীতি অন্যান্য এয়ারপোর্টের মত এখানেও বিব্রতকর পরিস্থিতি। তবুও রক্ষা যে ওদের বেশ মোটা এবং পুরাতন পাসপোর্ট এবং রাশেদ সাহেবের পাসপোর্টে ইতিপূর্বে বৃটেন ভ্রমণের ভিসা দেখে তেমন কোন ঝামেলা করেনি। এক সময় সব ঝামেলা শেষ করে প্লেনে উঠে সীট খুঁজে বসে পরলেন।
এবারেও মনি জানালার পাশে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই প্লেন ভারত মহাসাগরের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। সামনের জি পিএস এর স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে। জানালা দিয়ে নিচে নীল সাগরের ঢেউয়ের চূড়ায় সাদা ফেনা আরো বেশি সুন্দর ছবির মত দেখাচ্ছে, মাঝে মাঝে টুকরো মেঘ গুলির উপর দিয়ে যাচ্ছিল। সাগর পাড়ি দেয়ার পর যে শহরের উপর দিয়ে যাচ্ছে রাশেদ সাহেব বলে যাচ্ছেন কবে এই শহরে এসেছিলেন, তোমাকে নিয়ে এই যে এই এই শহরে এসেছিলাম দেখ উপর থেকে দেখ কেমন দেখাচ্ছে।
ওইসব শহরের নানা গল্প বলছিলেন। তার কোনটা মনিরার কানে যাচ্ছে কোনটা যাচ্ছে না। সে শুধু অবাক হয়ে রাশেদ সাহেবের মুখের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে। মনে হচ্ছে যেন তাকে এই প্রথম দেখছে। [চলবে]
নক্ষত্রের গোধূলি-১৭
কুয়ালালামপুর থেকে লন্ডন দীর্ঘ চৌদ্দ ঘন্টার পথ।
কম না। মাঝে দুই বার খাবার দিয়েছে, দুই বার হালকা নাশতা আর চা কফি বা পানীয় তো আছেই। যে যখন যা চাইছে। রাশেদ সাহেব মনিরা কে জোর করে বার বার পানীয় দিচ্ছে যাতে ডি-হাইড্রেশন হয়ে এয়ার সীকনেসে না ধরে। মাঝে মাঝে উঠে এলি ওয়েতে হাঁটা হাটি করতে বলছে নিজেও করছে।
রাশেদ সাহেবকে যেন আজ মনিরার কাছে নতুন লাগছে। এর আগেও তো কত বার প্লেন জার্নি করেছে তখন তো এতো এমন করেনি, এ যেন অন্য কোন নতুন রাশেদ সাহেব।
মনিরার ভাবনা শুধু একটাই, যে জন্য আসা তার কতটা কি হবে, কোন কাজকর্ম পাবে কি না, কি করবে, মনি যখন চলে যাবে তখন এই আত্মভোলা মানুষটা কি ভাবে থাকবে, কি করবে এই সব সাত পাচ ভেবে নানা আশঙ্কায় মনিরার মন বিষণ্ন হয়ে রয়েছে। না কি আবার দেশে ফিরে যেতে হবে। এমন যদি হয় তাহলে কি উপায় হবে, নানা কিছু।
আবার এটাও ভাবছে দেশ ছেড়ে যখন বের হয়ে এসেছে নিশ্চয়ই একটা গতি হবেই। এতো বড় এই ইংরেজদের রাজ্যে কি ওর জন্য একটা কাজও জোগার হবে না?নানা কিছু ভাবতে ভাবতে আশা নিরাশার অনিশ্চয়তা আর গতরাতের অনিদ্রায় ক্লান্ত হয়ে মনিরা ঘুমিয়ে পরেছে।
রাশেদ সাহেব ওর মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে আর ডাকতে পারলো না। কাত হয়ে থাকা মনির মাথাটা টেনে নিজের বুকে এনে নিলেন, মনি একটু কাত হয়ে রাশেদ সাহেবের বুকে ঘুমাচ্ছে। মনির মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন সে কত সুখী।
মনির মত স্ত্রী পেয়েছে। যে তার সম্স্ত সত্তা দখল করে রয়েছে, ওকে ছাড়া একটা দিন তো দূরের কথা একটা বেলাও চলে না। তার মনের কথা গুলি কেমন করে যেন সব ঠিক ঠিক বুঝে ফেলে। অবাক লাগে। ভালবাসা কি এমনই গভীর?কত গভীরে গেলে এমন হতে পারে?কই আমি তো পারি না! ভাবতে ভাবতে সেও এক সময় ঘুমিয়ে পরে।
হঠাত্ মাইকে এয়ার হোস্টেজের কণ্ঠে চমকে উঠলেন, প্লেন অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই হিথ্রো এয়ারপোর্টে নামবে, সেখানকার তাপ মাত্রা দুই ডিগ্রী এবং আবহাওয়া সম্পর্কে জানিয়ে যাত্রীদের সেই অনুযায়ী পোষাক পরে নেবার কথা জানিয়ে সীট বেল্ট বেধে নেবার অনুরোধ জানালো। মনিরার ঘুম তখন ভাঙ্গে নি। রাশেদ সাহেব আস্তে করে ডাকলেন, মনি ওঠ, লন্ডন এসে গেছে। মনির সীট বেল্ট বেধে নিজেরটাও বেধে নিলেন।
আবার ডাকলেন মনি ওঠ।
মনি চোখ মেলে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে?
লন্ডন এসে পরেছি প্লেন নামছে।
মনি জানালা দিয়ে দেখল। ছবির মত সাজান সুন্দর বাড়ি ঘর, টেমস নদী, আই অফ লন্ডন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে প্লেনের চাকা মাটি ছুঁয়ে গেল। একটু পরেই প্লেন হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের তিন নম্বর টার্মিনালের সামনে থেমে গেল।
রাশেদ সাহেব ব্যগ থেকে মনির গরম কাপড় বের করে মনিকে পরিয়ে দিলেন, পায়ে মুজা বদলে গরম মুজা পরিয়ে দিলেন, এছাড়া হ্যান্ড গ্লোভস আর গলার মাফলার মনির হাত ব্যাগে ভরে দিলেন।
গ্যাং ওয়ে টেনে প্লেনের দরজার সামনে আনতে দরজা খুলে দিল। যাত্রীরা একে একে সবাই নেমে গেল। টার্মিনালের দোতলার উপর বেশ অনেকটা পথ হেটে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে বেশ দীর্ঘ কিউর পিছনে। তাদের পালা এলে কাল ইমিগ্রেশন অফিসার তাদের পাসপোর্ট দেখে সীল দিয়ে ফেরত দিয়ে দিল।
রাশেদ সাহেব এক হাতে ব্যাগ আর অন্য হাতে মনিরার হাত ধরে লাগেজ কনভেয়ারের কাছে এসে দাঁড়ালো। ওদের মালামাল কোন বেল্টে আসছে তা মনিটরে দেখে নিয়ে সেখানে যেয়ে দাঁড়ালেন। ওদের মাল আসতেই বেল্ট থেকে নামিয়ে কাস্টমের সবুজ গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে বাইরে যেখানে যাত্রীদেরকে রিসিভ করার জন্য সবাই এসে অপেক্ষা করে সেখানে এসে ফিরোজকে খুঁজে না পেয়ে মনিরাকে বললো তুমি এখানে এগুলি নিয়ে বসে থাক আমি ফিরোজকে খুঁজে বের করি। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ফিরোজকে না পেয়ে আবার মনির কাছে ফিরে এলেন।
মনি জিজ্ঞেস করল, পেলে না?
দেখছি না।
তাহলে কি আসে নি?
না আসলেও আসবে।
তুমি কি ঠিক ভাবে জানিয়েছিলে?
কি যে বল, তারিখ, ফ্লাইট নম্বর, সময় সব জানিয়েছি। আমার মনে হচ্ছে ওরা রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামে আটকে রয়েছে।
এখানেও ট্রাফিক জ্যাম আছে নাকি?
থাকবে না মানে, এখন পুরো পিক টাইম। দাঁড়াও আর একটু দেখি, তারপর ফোন করি।
বলেই তিনি মনির পাশে বসে পরলেন।
আমার কিন্তু ভয় করছে আসবে কি না, যদি না আসে তাহলে কি করবে এখন?
কি যে বল তুমি আসবে না কেন, অবশ্যই আসবে। একটু অপেক্ষা কর।
প্রায় আধা ঘন্টা পার হয়ে গেল এর মধ্যে ওকে না দেখে এবার রাশেদ সাহেবও একটু চিন্তিত হলেন। উঠে গিয়ে দোকান থেকে সাথে থাকা পাউন্ডের একটা কয়েন ভাঙ্গিয়ে এনে ফিরোজের বাসায় ফোন করলেন।
ফিরোজের মেয়ে জানাল আব্বু আম্মু দুজনেই আপনাদের রিসিভ করতে চলে গেছে, আম্মু একটু বাইরে কাজে গিয়েছিল ফিরতে দেরি হওয়াতে দেরি হয়েছে।
আচ্ছা ঠিক আছে তা হলে আমি ওকে মোবাইলে ফোন করছি।
লাইন কেটে দিয়ে আবার মোবাইলে ফোন করে সরাসরি ফিরোজের সাথে কথা হোল।
হ্যা রাশেদ আমরা আসছি, তোমরা কি তিন নম্বর টার্মিনালে আছ?
হ্যা?
তাহলে ওখানেই থাক আমাদের আরো আধা ঘন্টা লাগবে।
সত্যি আধা ঘন্টার মধ্যেই ফিরোজ এসে ওকে খুঁজে পেয়ে বললো তারা তারি চল যেখানে গাড়ি রেখে এসেছি ওখানে বেশিক্ষণ রাখা যায় না।
তারা তারি করে একটা ট্রলি এনে ফিরোজ সহ মালপত্র উঠিয়ে বাইরে এসে দেখে ফিরোজের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে ওর স্ত্রী বসে আছে। ওদের দেখে নেমে এলো। এর আগে ফিরোজের স্ত্রীর সাথে দেখা হয়নি। দ্রুত পরিচয় পর্ব সেরে মাল গুলি গাড়ির পিছনে রেখে গাড়িতে উঠে বসার সাথে সাথেই ফিরোজের স্ত্রি শেফালি, চিটাগাং এর মেয়ে লিভারপুলে জন্ম এবং বেড়ে উঠা, গাড়ি স্টার্ট দিল। টার্মিনাল থেকে বের হয়ে এই সামান্য একটু হেটে গাড়িতে আসতেই মনিরা শীতে কেঁপে উঠলো।
ভাবী হিটার বাড়িয়ে দেন
হ্যা ভাই দিচ্ছি। একটু রসিকতা করে বলল কি ভাবি আগুনের কাছে বসেও শীত লাগছে?
রাশেদ নিজের কোট খুলে মনির গায়ে জড়িয়ে দিল। একটু পরেই গাড়ি গরম হলে মনি একটু স্বস্তি পেল। ফিরোজ আর রাশেদ সাহেবের হাসি তামশা আর ওদের দুজনের আন্তরিকতা দেখে মনি অবাক হোল। এতো ঘনিষ্ঠ বন্ধু এরা! হিথ্রো এলাকা ছাড়িয়ে এসে গাড়ি মটর ওয়ে ধরে ওদের বাড়ির দিকে চলছে।
ভাবী গাড়িও চালাচ্ছে আবার ফাকে ফাকে কথাও বলছে। মনিরা ওদের এই সব কাণ্ড দেখে একটু নিশ্চিন্ত হয়েছে, মুখে হাসির আলো দেখা যাচ্ছে। প্রায় ঘন্টা খানিক ড্রাইভ করে রাত আটটার দিকে ওদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো।
ফিরোজের নিজের বাড়ি। বাড়িতে মা, বোন, বোন জামাই আর ওদের দুই মেয়ে এক ছেলে নিয়ে ফিরোজের সংসার।
মালপত্র নামিয়ে ভাবি দোতলায় ওদের জন্য বরাদ্দ করা ঘরে রেখে এসে বসার ঘরে বসল।
ফিরোজের মা বললো তোমাদের বড় মেয়ে ফোন করেছিল। তোমরা পৌঁচেছ কি না জানতে চেয়েছিল, ওদের একটা ফোন করে জানিয়ে দাও, চিন্তায় আছে।
ফিরোজ উঠে গিয়ে লাইন ধরে দিল।
মনি কথা বলল, হ্যা মা আমরা এই মাত্র এলাম।
তোমার চাচা চাঁচি দুজনেই গিয়েছিল, তোমরা কেমন আছ?আচ্ছা সাবধানে থেক, রাখি তাহলে।
বাড়ির সবার সাথে আলাপ পরিচয় হবার পর
শেফালি ভাবি এসেই বলল ভাবী কাপড় বদলে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নেন, আমার মনে হয় গোসল করলেই ভাল হবে। আপনার রুমের পাশেই বাথরুম। লম্বা জার্নি করে এসেছেন আজ আর বেশি কথা না, খেয়ে দেয়ে রেস্ট করেন কাল কথা হবে।
শেফালির আন্তরিকতা দেখে মনিরা একটু অবাক হোল।
লন্ডনের মত শহরে যেখানে সব কিছু মাপা এমনকি মুখের হাসিটাও। মনিরা এ কয়দিন জেনে এসেছে সম্পুর্ণ অনিশ্চিতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে সেখানে প্রথম দেখাতেই এমন আপন করে নেয়াতে মনিরার কাছে অবাক লাগারই কথা।
ভাবীর কথা শুনে ওরা দুই জনেই উঠে গেল।
মনিরা বললো সে গোসল করবে।
করে ফেল ভাল লাগবে, আমি হাত মুখ ধুয়ে নিলেই হবে।
স্যুটকেস খুলে মনিরা কাপড় বের করে গোসল করে এলো। রাশেদ হাতমুখ ধুয়ে এসে বলল
ওই যে ফিরোজের জন্য কাসুন্দি, ঝিটকার পিয়াজ আর ওগুলি এনেছি ওগুলি বের কর।
মনিরা ভাবল তাহলে ও আগে থেকে জানতো এখানে আসবে। আমাকে তো শুধু বলেছিল ফিরোজকে মেইল পাঠাবে, তা ওর এত ঘনিষ্ঠ বন্ধু অথচ এতদিন কিছু জানতে পারিনি, আমাকে তো কোনদিন কিছু বলে নি। যাক ওদের বন্ধুত্বের ভাব দেখে মনটা বেশ প্রফুল্ল হোল।
ভাবতে ভাবতে সব কিছু বের করে একটা ব্যাগে ভরে নিচে নেমে এলো।
শব্দ পেয়ে ভাবী ডেকে বললো ভাবী এদিকে কিচেনে আসুন খাবার রেডি।
মনি এগিয়ে কিচেনে গিয়ে ভাবির সামনে ব্যাগটা নামিয়ে দিয়ে বলল এই যে ভাবী আপনার ভাই তার বন্ধুর জন্য এনেছে।
ওতে কি পিয়াজ আছে?
হ্যা।
আমি জানি পিয়াজ থাকতে হবে।
কেউ এলেই তার আর কিছু না, শুধু এই পিয়াজ আনতে বলবেই। যাক ভাবী গোসল করেছেন মনে হচ্ছে!
হ্যা ভাবী গোসল করে ফেললাম।
ভাল করেছেন। কি, এখন শীত লাগছে?
না বেশ তো ভালই লাগছে।
নেন এবার খেয়ে দেয়ে শুয়ে পরুন।
শুনলাম আপনি এদেশে জন্মেছেন, এদেশে বড় হয়েছেন তা এত সুন্দর বাংলা বলেন আমার কাছে অবাক লাগছে।
ওমা, কি বলেন! এদেশে জন্মেছি বলে কি আমরা বাঙ্গালি না?
যাক ভাবী খুব ভাল লাগছে। [চলবে]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।