আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নক্ষত্রের রাত

ভাবনার কথা

তারা ভরা রাতের ছবিতে হলুদ তারারা জ্বলে জ্বলে নীলচে আকাশকে আলো দিচ্ছে আর দুর পাড়ের সরাইখানা বা বাড়ির বাতিগুলো জ্বলে জ্বলে আলো দিচ্ছে রন নদীর পানিকে৷ নদীর এ পারে বয়সী প্রেমিক প্রেমিকা বসে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে৷ তাদের পেছনে নদীর পারে রাখা দুটো নৌকো৷ ওপারের কৃত্রিম আলোগুলো কিন্তু নৰত্রের আলো থেকে কিছুটা হলেও উজ্জ্বল৷ ভ্যানগগের ছবি দেখলে মনে হয় সে যেন অল্প করে রং তৃলতেই জানত না৷ এমননন করে তুলি ডুবিয়ে এতততত গুলো রং তুলে ধাঁই ধাঁই করে চালিয়ে দিয়েছে ক্যানভাসের ওপরে৷ অবশ্য পড়ে পরে জেনেছি অমন ধাঁই ধাঁই করে তুলি চালানোটা হল গিয়ে 'উত্তর-ভাবুকদের' নিজস্ব কেতা৷ ভ্যানগগ যখন ঐ ছবি যখন সে আঁকে তখন ভয়ংকর পানীয় আঁবসাত্‍ এ অতিরিক্ত আসক্তির বিদঘুটে সব প্রতিক্রিয়া নিয়ে শরীর আর মনটা তার এলোমেলো হয়ে আছে৷ প্যারিসের জমকালো তুমুল রঙ্গিন দিনগুলোর শোরগোল থেকে পালিয়ে এসেছে আর্ল এ থাকবে বলে৷ হলুদ কুটির ভাড়া নিয়ে সেটাকে সাজিয়ে তোলার জন্য তখন ছবি আঁকছে সে একের পর এক৷ জীবনে আরও ভয়ংকর অস্থিরতা আর একাকীত্ব তখনও আসতে বাকি৷ তেমন এক সময়ে নৰত্রের রাতকে নিজের ভেতরের চোখ দিয়ে যেভাবে দেখেছে সেভাবে তুলে এনেছে৷ নৰত্রের রাতের সবচেয়ে বিখ্যাত ছবিটা যখন সে আকেঁ তখন সে স্বেচ্ছায় নিজেকে সমর্পন করেছে এক স্যানিটোরিয়ামে৷ নৰত্রের রাতের ছবিতে সব বিষয়গুলো প্রকট হয়ে চিত্‍কার করছে৷ তারাগুলো যেন ফেটে যাচ্ছে, বাতাসের ঢেউ ঘূর্ণি হয়ে উঠছে আর এক পাশে অস্থির এক সাইপ্রেস গাছ৷ মেডিটেরিয়ান অঞ্চলে সাইপ্রেস গাছ লাগানো হয় সাধারণত সমাধিৰেত্রে৷ যদিও এরই মধ্যে হতাশার গভীরতা তখন তাকে অনেক স্থির করে নিয়েছে৷ প্রিয় বন্ধু গগ্যাঁ, যাকে সাথে রাখবে বলেই সে হলুদ কুটির সাজিয়ে নিতে চেয়েছিল, তাকে ছেড়ে চলে গেছে৷ একঘেঁয়েমিতা আর একাকীত্বে সে মরতে চায়নি, জানিয়েছিল তার ভাইকে৷ এরও বছরখানেক পরে প্রচন্ড যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে মরে যাওয়ার খানিক আগে অস্ফূটে কেবল বলেছিল, কেউ ভাবতে পারে জীবন এত দুঃখের! একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে যেন সে ছবির পেছনের কান্নাটাও শোনা যায়৷ না৷ অমন আবেগী জীবনের উপলদ্ধিরও অন্য পিঠ থাকে৷ সংশয়ের পিঠ৷ থিওকে যদি ভ্যানগগ নিয়মিত চিঠি না লিখে যেত তাহলে কি তাকে এমন করে বোঝা হত? কি হলে কি হতে পারত এটা বড় নিরর্থক তর্ক৷ এত এত সম্ভাবনা থাকে যে, প্রত্যেকে তার জায়গা থেকে ইস উস করতে থাকে৷ সেখান থেকে চলে আসে যা ঘটে বা যা ঘটতে পারে তার দার্শনিক ব্যাখ্যার আলোচনা৷ এ ব্যাপারে দু' দার্শনিকের দুটো মারাত্মক উক্তি আছে৷ একটা খুবই বিখ্যাত, মার্ক্সের, দার্শনিকদের কাজ এখন আর পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করা নয় বরং পাল্টানো৷ আরেক দার্শনিক, দেলু্যজ এর মতে, দর্শনের সমসত্ম প্রশ্নগুলো হওয়া উচিত ব্যবহারিক৷ মানে 'এটা মানে কি' 'ওটা আসলে কি'- এমনধারা না বলে বলা উচিত- 'এটা দিয়ে কি হয়' বা 'ওটা কিভাবে কাজ করে'৷ এখন যেহেতু থিওকে ভ্যানগগ চিঠি লিখেই ফেলেছে, সেটা ধরেই এগুনো ভাল৷ এই সময়ের অনেক বিশেষজ্ঞই বিচিত্র বিষয় নিয়ে কাজ করে থাকেন৷ হয়ত আগেও করতেন, এখন যোগাযোগ হচ্ছে বেশি৷ চিকিত্‍সক-মনোবিজ্ঞানীরা কাজ করেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের আঁকা ছবির ওপরে, ভাবতে আমার অনত্মত অবাক লাগে৷ ভ্যানগগ (ডাচ উচ্চারনে 'ফিনসেন্ট ফ্যানহখ') সারা জীবনে কি কি ধরণের অসুখে ভুগেছে সেটা নিয়ে গবেষণা করে বিখ্যাত হয়েছেন কয়েকজন৷ ইন্টারনেটে (অনত্মর্জালে!) গুগল অনুসন্ধানে যারা ভ্যানগগের ওপর নানা প্রশ্ন লিখে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন তাদের একটা বড় প্রশ্ন হল- ভ্যানগগ ঠিক কি কি অসুখে ভুগছিল? সিফিলিস, গণোরিয়া, কাশিসহ নানাবিধ শারীরিক অসুখ তো ছিলই, মানসিক অসুখের মধ্যে ছিল মৃগী রোগ (এপিলেপসি)৷ মনোবিজ্ঞানী আর মনোবিশেস্নকরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভ্যানগগের রং, তুলির টান, ছবির নামকরণ, ছবির বিষয় পরীৰা করে গেছেন গভীর ধৈর্যের সাথে৷ আধুনিক মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে- শিল্পীর ছিল ব্যক্তিত্বের বিশৃক্সলা বা পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার৷ হালসকারের মত মনঃসমীৰকরা আবার বলেছেন, ছোটবেলায় ভাইকে হারানোর একটা গভীর ছাপ আজীবন বয়ে বেড়িয়েছিল সে৷ সব মিলে দাঁড়ায়, ভ্যানগগ মানুষটা ছিল অস্থির-অবেগী-বিশৃক্সল-ভারসাম্যহীন৷ চিকিত্‍সা বিজ্ঞানের মতেই, ব্যক্তিত্বের বিশৃক্সলায় আক্রানত্ম যে কোন মানুষের চিনত্মা পদ্ধতি হয় সংশয়ী এবং পরষ্পরবিরোধী৷ যদি তাই হয় তবে এমন কি সম্ভব যে থিওকে যখন ভ্যানগগ বসে চিঠি লিখছিল তখন আসলেই সে যা ভাবছিল সেটা সব সময় তার লেখায় উঠে আসেনি! উঠে হয়ত এসেছে ভাবনার বিশৃক্সলা৷ যেমন, রন নদীর পাশে নৰত্রের রাত অাঁকার অভিজ্ঞতা নিয়ে ভ্যানগগ যখন থিওকে লিখছে তখন বলছে, সে সময় আমার মধ্যে প্রবল ধর্মবোধ জেগে উঠছিল, আমার খুব ধর্মবোধ হচ্ছিল৷ ওরকম করে ভাবনার বীজ তার আগের জীবনে আছে ঠিকই কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে, যে মূহুর্তে ছবিটা অাঁকার তাড়া সে অনুভব করছিল তখন সে তাড়াটা তার কাছে অচেনাই ছিল; যখন সে চিঠি লিখতে বসল তখন তার কাছে হটাত মনে হল, ঐ অনুভূতিটা ধর্মবোধ হয়ে থাকতে পারে! অমনটা ঘটেছে কি ঘটেনি সেটা আলোচ্য নয় বরং প্রশ্নটা হতে পারে- অমনটা ঘটা সম্ভব কি না! আবার এও ঠিক, যুক্তির নৌকোর যত সংশয়ের ঘাটে যাওয়ার সম্ভাবনাই থাকুক না কেন, কঠিন মাঝির বুকেও খানিক হলেও দোলা দিয়ে যায় সেই হাহাকার- কেউ ভাবতে পারে, জীবন এত দুঃখের! জীবনের সবচেয়ে আবেগী অনুভূতির মধ্যেও সংশয়ের সম্ভাবনা থাকে৷ যে কোন বিষয়ে সবচেয়ে বিশ্বাসী মানুষটাকেও সময়ের স্রোত এসে নাড়িয়ে দিয়ে যায়৷ এ বোধ হয়ত সকল জীবনমান প্রত্যেক ব্যক্তি মানুকে তাড়া করে বেড়ায়- আসলে কোনটা ঠিক? তারপরেও প্রত্যেক মানুষের কিছু সুনির্দিষ্ট বিশ্বাস থাকে, থাকে কিছু করণীয় এর ভাবনা৷ এবং তারও পরে, দুপুর বেলায় কোন এক ছায়াঘেরা গ্রামের মাটির ঘরের দাওয়ার মত চুপ করে পথ চেয়ে থাকে- হাহাকার৷

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।