আর অবাক হতে চাই না
কাজী নজরুল ইসলাম। আমাদের জাতিয় কবি, বিদ্রোহী কবি, প্রমের কবি আরো কত কত নামে আমরা তাকে ডেকে থাকি। ইদানিং আবার তাকে ইসলামি ভাব ধারার কবি বলেও কেউ কেউ আখ্যায়িত করছেন। কিন্তু তার সবচেয় বড় পরিচয় (আমার আল্প জ্ঞানে) তিনি একজন অস্রাম্পদায়িক। আমার মনে হয় না তিনি কখনো নিজেকে কোন ধর্মের বেড়াজালে আটকাতে চায়নি।
তার কাছে সবচেয় বড় ছিল মানুষের মানুষ পরিচয়।
তিনি তার আনেক কবিতায় তার এই চিন্তা ধারা প্রকাশ করছেন এবং আমার কৈফিয়ৎ কবিতায় আতি সুন্দর ভাবে নিজের কৈফিয়ৎ দিয়ে গেছেন। আনেকেই পরেছেন তবুও আমার কৈফিয়ৎ কবিতাটি তার মৃত্যুবার্ষিকীতে পোস্ট করলামঃ
আমার কৈফিয়ৎ
বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’,
কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুজে তাই সই সবি!
কেহ বলে, ‘তুমি ভবিষ্যতে যে
ঠাঁই পাবে কবি ভাবীর সাথে হে!
যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে-বাণী কই, কবি?’
দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী!
কবি-বন্ধ্বুরা হতাশ হইয়া মোর লেখা প’ড়ে শ্বাস ফেলে।
বলে, কেজো ক্রমে হ’চ্ছে অকেজো পলিটিক্সের পাঁশা ঠেলে।
পড়েনাক’ বই, ব’য়ে গেছে ওটা।
কেহ বলে, বৌ-এ গিলিয়াছে গোটা।
কেহ বলে, মাটি হ’ল হ’য়ে মোটা জেলে ব’সে শুধু তাস খেলে।
কেহ বলে, তুই জেলে ছিলি ভালো, ফের যেন তুই যা’স জেলে।
গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁচা।
প্রতি শনিবারই চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা!’
আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি — ‘
অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি।
সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, আড়ি চাচা!
যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা!
মৌ-লোভী যত মৌলভী আর ‘মোল-লারা’ ক’ন হাত নেড়ে,
‘দেব-দবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!
ফতোয়া দিলাম—কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!
‘আম পারা’- পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!’
হিন্দুরা ভাবে, ‘পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’
আনকোরা যত নন্ভায়োলেন্ট নন্-কো’র দলও নন্ খুশী।
‘ভায়োলেন্সের ভায়োলিন্’ নাকি আমি, বিপ্লবী-মন তুষি।
‘এটা অহিংস’, বিপ্লবী ভাবে,
‘নয় চর্কার গান কেন গা’বে?’
গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কন্ফুসি!
স্বরাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের অঙ্কুশি’!
নর ভাবে, আমি বড় নারী-ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী বিদ্বেষী।
‘বিলেত ফেরনি?’ প্রবাসী-বন্ধু ক’ন, ‘এই তব বিদ্যে, ছি!’
ভক্তরা বলে, ‘নবযুগ-রবি!’-
যুগের ন হই, হুজুগের কবি
বটি তো রে দাদা, আমি মনে ভাবি, আর ক’ষে কষি হৃদ-পেশী,
দু’কানে চশ্মা আঁটিয়া ঘুমানু, দিব্যি হ’তেছে নিদ্ বেশী!
কি যে লিখি ছাই মাথা ও মুন্ডু, আমিই কি বুঝি তার কিছু?
হাত উঁচু আর হ’ল না তো ভাই, তাই লিখি ক’রে ঘাড় নীচু!
বন্ধু! তোমরা কিলেনাক’ দান,
রাজ-সরকার রেখেছেন মান!
যাহা কিছু লিখি অমূল্য ব’লে অ-মূল্যে নেন। আর কিছু
শুনেছ কি, হুঁ হুঁ, ফিরিছে রাজার প্রহরী সদাই কার পিছু?
বন্ধ্বু! তুমি তো দেখেছ আমায় আমার মনের মন্দিরে,
হাড় কালি হ’ল, শাসাতে নারিনু তবু পোড়া মন-বন্দীরে!
যতবার বাঁধি ছেড়ে সে শিকল,
মেরে মেরে তারে করিল বিকল,
তবু যদি কথা শুনে সে পাগল! মানিল ন রবি-গান্ধীরে!
হঠাৎ জাগিয়া বাঘ খুঁজে ফেরে নিশার আঁধারে বন চিরে!
আমি বলি, ওরে কথা শোন্ ক্ষ্যাপা, দিব্যি আছিস্ খোশ্হালে!
প্রায় ‘হাফ’-নেতা হ’য়ে উঠেছিস, এবার এ দাঁও ফস্কালে
‘ফুল’-নেতা আর হবিনে যে হায়!
বক্তৃতা দিয়া কাঁদিতে সভায়
গুঁড়ায়ে লঙ্কা পকেটেতে বোকা এই বেলা ঢোক! সেই তালে
নিস্ তোর ফুটো ঘরটাও ছেয়ে, নয় পস্তাবি শেষকালে।
বোঝেনাক’ যে সে চারণের বেশে ফেরে দেশে দেশে গান গেয়ে
গান শুনে সবে ভাবে, ভাবনা কি! দিন যাবে এবে পান খেখে।
রবেনাক’ ম্যালেরিয়া মহামারী,
স্বরাজ আসিছে চ’ড়ে জুড়ি-গাড়ী,
চাঁদা চাই, তারা ক্ষুধার অন্ন এনে দেয়, কাঁদে ছেলে-মেয়ে।
মাতা কয়, ওরে চুপ্ হতভাগা, স্বরাজ আসে যে, দেখ্ চেয়ে।
ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন,
বেলা ব’য়ে যায়, খায়নিক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।
কেদেঁ ছুটে আসি পাগলের প্রায়,
স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়!
কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছ কি? কালি ও চুন
কেন ওঠেনাক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?
আমরা তো জানি, স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছি খাস।
কত শত কোটী ক্ষুধিত শিশুর ক্ষুধা নিঙাড়িয়া কাড়িয়া গ্রাস
এল কোটী টাকা, এল না স্বরাজ!
টাকা দিতে নারে ভুখারি সমাজ।
মা’র বুক হ’তে ছেলা কেড়ে খায়, মোরা বলি, বাঘ, খাও হে ঘাস!
হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ঘরে ছেলের লাশ!
বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে,
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা কই মুখে,
রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসেনাক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুঃখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!
পরোয়া করি না, বাচিঁ বা না-বাচিঁ যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথার ওপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।
প্রর্থনা ক’রো-যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটী মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমারা রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।