কত তর্ক-বিতর্কই না হচ্ছে গ্রাউণ্ড জিরোর দু’ব্লক দূরে একটি ইসলামিক সেন্টার স্থাপন করা উচিত হবে কিনা সেটি নিয়ে। আবারো পশ্চিমা মানুষ এবং মিডিয়া সাধারণ মুসলমানদের সাথে মিশিয়ে ফেলেছে হাতেগোনা কিছু সন্ত্রাসীকে যারা ইসলামের নামে শুধু অমুসলমান না মুসলমানদেরও নির্দ্বিধায় হত্যা করতে পারে। একজন বিবেকবান মানুষ এবং মুসলিম হিসেবে আমি জানি যে ইসলাম এগুলোর কোনকিছুই সমর্থন করেনা।
যে ধ্যান-ধারণার উপর ভিত্তি করে এই দেশের প্রতিষ্ঠাতারা এই দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল তা দুঃস্বপ্ন হয়ে ধরা দিচ্ছে এই ক্ষমতাধর দেশটির রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ মানুষের কাছে। অথচ আমেরিকার First Amendment এ স্পষ্ট লেখা আছে এই দেশে বসবাসকারীদের স্বাধীনভাবে নিজ ধর্মপালনের অধিকারের কথা।
আর Park51 কোন মসজিদও না, এটি হবে একটি ১৩ তলা ইসলামিক সেন্টার যেখানে রান্নার স্কুল থেকে শুরু করে সাঁতার কাটার পুল পর্যন্ত থাকবে। শুধু একটি তলায় থাকবে নামাজের স্থান। আর এমনও না যে এই ভবনটি গ্রাউন্ড জিরোতে তৈরী হচ্ছে, এটি তৈরী হচ্ছে গ্রাউন্ড জিরো থেকে দুই ব্লক দূরে। নিউ ইয়র্ক শহরের আকাশচুম্বি ভবনের ভীরে ইসলামিক সেন্টারটিকে দেখাও যাবেনা গ্রাউণ্ড জিরো থেকে কিন্তু তারপরও এটি নিয়ে কত হট্টগোল। অথচ গ্রাউণ্ড জিরোর ঠিক কাছেই যে একটি গির্জা (Saint Paul’s chapel. অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি যে ৯/১১ এর ভয়ঙ্কর হামলায় কোন ক্ষতি হয়নি আঠারো শতকের এই গির্জার।
) সমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে সেটি নিয়ে কিন্তু কারও কোন মাথা ব্যথা নেই। আমারও নেই কারণ আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি প্রত্যেক মানুষেরই আছে তার নিজ ধর্মপালনের অধিকার। ইহুদী, ক্রিশ্চিয়ান, হিন্দু, বৌদ্ধদের মত মুসলমানদেরও আছে তাদের ধর্মপালনের অধিকার। আর সেই অধিকার থেকে যদি তারা একটি ইসলামিক সেন্টার স্থাপনই করে তাহলে দোষটি কোথায়? আর এটি যদি ইসলামিক সেন্টার না হয়ে একটি মসজিদই হতো তাহলেই বা দোষটি কোথায় ছিল?
কতজন আমেরিকান জানেন যে এই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠাতাদের একজন টমাস জেফারসনের নিজ সংগ্রহে ছিল কোরআনের একটি কপি, যেটি আজও সংরক্ষিত আছে লাইব্রেরী অফ কংগ্রেসে? শুনেছি ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়াতে জেফারসনের একটি মূর্তি আছে, সেখানে তার হাতে ধরা আছে একটি ফলক যেখানে খোদাই করা আছে আমেরিকার Religious Act 1876, নিচে লেখা God-Jehovah, Brahma, Rama, Atma, Allah। তারা কি জানেন আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টে খোদাই করা আছে আমাদের প্রিয় নবীর একটি প্রতিকৃতি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আইনপ্রণেতাদের একজন হিসেবে? যদিও প্রতিকৃতিটি নিয়ে বিতর্ক হওয়ায় সেটির নিচে এখন দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে একটি ফুটনোটে লেখা আছে যে ভাস্কর সৎ উদ্দেশ্যে শুধুমাত্র হযরত মুহম্মদ (সাঃ) কে সম্মান জানাতেই প্রতিকৃতিটি তৈরী করেছেন।
একবার সু্যোগ এসেছিল গ্রাউণ্ড জিরোতে যাবার। গিয়ে হতবিহ্ববল হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ দমকা বাতাসে মানুষ যেমন কুঁকড়ে যায়, তেমন কুঁকড়ে গিয়েছিলাম। চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল CNN এ বহুবার দেখা Twin Towers এর ধ্বসে পড়ার দৃশ্যটি। আমার আবেগের মাত্রাটা একটু বেশি তাই নিজের চোখের জল সামলাতে পারিনি।
সাথে ছিল এক ভারতীয় মুসলমান বন্ধু যার খালাতো ভাই কাজ করতো Twin Towers এর ভিতর অবস্থিত কোন এক অফিসে, ৯/১১’র সেই হামলায় সে নিহত হয়। খুব সম্ভবত তার দেহটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেই বন্ধু গ্রাউন্ড জিরোতে গিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠেছিল। তার কান্নার রেশ ছুঁয়ে গিয়েছিল আমাকে, আমাদের সাথে থাকা অন্যান্যদের। শুধু আমি না, আমার মত আরও কোটি কোটি মুসলমান বিশ্বাস করে যে ৯/১১ এর হামলাটি ছিল নির্মম, বর্বর।
সাধারণ আমেরিকানরা কি কখনও জানবে আমার মত মুসলমানদের তাদের প্রতি এই আবেগ, এই সমবেদনার কথা?
ভাবলে কষ্ট পাই যখন দেখি বারবার শুধু ইসলামকেই টেনে আনা হয় এই বিষয়ে। ভেবে পাইনা যে হাতেগোনা কিছু মানুষের অপরাধের জন্য কেন সাধারণ মুসলমানেরা ছোট হয়ে থাকবে অন্যদের চোখে, কেন তারা বঞ্চিত হবে তাদের অধিকার থেকে, কেন সামান্য একটি ইসলামিক সেন্টার স্থাপনা নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে বয়ে যাবে ঝড়, কেন মানুষ রাস্তায় নেমে যাবে, মিছিল করবে, স্লোগান দিবে এই স্থাপনা ঠেকাতে? আমেরিকাতেও তো ছিল এবং এখনো আছে Klu Klux Klan এর মত কুখ্যাত বর্নবাদী সংগঠন যারা বিশ্বাস করে আমেরিকা হবে শুধু সাদা ক্রিশ্চিয়ানদের। আমরা কি তাই বলে সকল সাদা ক্রিশ্চিয়ানদের ঘৃণা করি বা করবো? আমাদের এখনকার সমাজের একটি বড় সমস্যা হলো একজনকে দিয়ে একশজনকে যাচাই করা। গ্রাউন্ড জিরোর দু’ব্লক দূরে ইসলামিক সেন্টার স্থাপন করা যাবে কিনা সেটার বিতর্ক পশ্চিমাদের সেই মানসিকতার পরিচয়ই হয়তো আরও একবার দিচ্ছে। তবে ভাল লেগেছে বারাক ওবামার এই সেন্টারের প্রতি সমর্থন।
Conspiracy Theoryগুলো পড়লে সবকিছু ধোঁয়াটে মনে হয়। আসলেই জানিনা কাদের হাত ছিল সেপ্টেম্বর ১১ এর নাশকতার পিছনে। শুধু জানি যে যাদের হাতই থাকুক না কেন, তাদের প্রতি ঘৃণা আর ক্ষোভ ছাড়া আমার মত একজন সাধারণ মানুষের মনে আর কিছু নেই।
* নিচের ছবিগুলো গ্রাউন্ড জিরোর সামনে থেকে তোলা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।