আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সোয়া দুই লাখ টাকার পানিতে পৌনে তিন লাখ টাকা ঘুষ

টুকলিফাই মারাই আমাদের কাজ, চুরা ছেঁচা দেয়াই আমাদের লক্ষ্য।

মন্তব্যঃ এটাতো একটা ওয়সা আরও ৭৭ টি সরকারী প্রতিষ্ঠান ও ১২০০ বাসাবাড়িতে রেগুলার এই কাজ করছে। উর্ধ্বতন কতৃপক্ষ জানেনা মানে ? সব টেবিলের নির্দিষ্ট রেট আছে একদিন এদিক সেদিক হলে নিচের দিকে তুফান চলে। আর সরকারী প্রতিষ্ঠানের পানির লাইন যোগসাজোশেই নষ্ট রাখা হয়। চলতি বছরের শুরু থেকেই রাজধানীর আগারগাঁওয়ের লায়ন্স চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পাইপলাইনে ওয়াসার পানি যায় না।

নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহ ছাড়া হাসপাতালই অচল হয়ে পড়বে। তাই ওয়াসার পানি কিনতে শুরু করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এক গাড়ি পানির দাম ৪০০ টাকা হলেও সঙ্গে ঘুষ দিতে হয় আরো ৫০০ টাকা। গত জানুয়ারি মাস থেকে এভাবেই ৪০০ টাকার পানি ৯০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে তাদের। এতে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে অন্তত পাঁচ লাখ টাকা, যার মধ্যে পৌনে তিন লাখ টাকাই ওয়াসার কর্মচারীদের ঘুষ হিসেবে দিতে হয়েছে।

এই ঘুষের টাকার সমন্বয় নিয়েও কর্তৃপক্ষ পড়েছে বিপাকে। ফলে বোর্ড সভায় ঘুষ দেওয়ার বিষয়টিকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দিতে হয়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে লায়ন্স ইনস্টিটিউট ও চক্ষু হাসপাতালের প্রশাসক কর্নেল (অব.) ডা. দীবাকর খীসা পানি সংকটের কথা কালের কণ্ঠের কাছে স্বীকার করেন। তবে ওয়াসার লোকজন নতুন করে ঝামেলা বাধাবে_এ ভয়ে তিনি তাদের নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, 'হাসপাতালের পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার নিশ্চয়তা দিলে বলতে পারি।

কিন্তু আপনি কি সেই নিশ্চয়তা দিতে পারবেন?' তবে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. তাকসেম এ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'লায়ন্স চক্ষু হাসপাতালের পানির লাইনে একটু সমস্যা ছিল। কিন্তু সেটা তো অনেক আগেই সমাধান হয়ে গেছে। এর পরও আট মাস ধরে এভাবে পানি কেনার বিষয়টি তো বিস্ময়কর। আমাকেও তো ওরা কোনো দিন এসে জানায়নি। হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানে এভাবে পানি কেনার বিষয় কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

আমি এখনই খবর নিচ্ছি। ' জানা গেছে, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষ ঢাকা ওয়াসার অঞ্চল-৪-এর নির্বাহী প্রকৌশলী ওয়াহিদুল ইসলাম মুরাদকে পানি সংকটসহ দ্বিগুণেরও বেশি অর্থে পানি কেনার বিষয়টি জানিয়ে সমাধানের অনুরোধ করে। এর পরই বিপাকে পড়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরের দিন পানি সরবরাহকারীরা হাসপাতালে গিয়ে কর্তৃপক্ষকে শাসায় এবং গাড়িতে করে পানি দেওয়া বন্ধ করে দেয়। পানি ছাড়া তো হাসপাতাল চালু রাখা সম্ভব নয়।

বাধ্য হয়ে হুমকিদাতাদের কাছে ছুটে যান হাসপাতালের কর্মকর্তারা। ভুল স্বীকার করলে শুরু হয় পানি দেওয়া। কিছুদিন পর আবারও পানি সংকটের সমাধান চেয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে আবেদন জানানো হয়। তখন আরো বাড়তি হুমকি-ধমকি কপালে জোটে। ওয়াসার কর্মচারীরা জানিয়ে দেয়, বাড়তি টাকা নেওয়ার কথা ওয়াসাকে জানালে গাড়ি ও পাইপলাইন_দুভাবেই পানি দেওয়া চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।

এদিকে ঘুষের টাকার সমন্বয় করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন হিসাব বিভাগের কর্মীরা। বার্ষিক নিরীক্ষার জন্য রসিদ সংরক্ষণের প্রয়োজন। কিন্তু ঘুষের কোনো রসিদ দেয় না ওয়াসার কর্মীরা। তাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বোর্ড সভা ডাকে। কয়েকজন সদস্য সভায় মন্তব্য করেন, 'ঘুষ লেনদেনকারী উভয়ই সমান অপরাধী।

বিকল্প খুঁজতে হবে। ' আরেকজন বলেন, 'প্রতি গাড়ি পানির দাম ৪০০ টাকা হলেও রসিদে ৯০০ টাকা উল্লেখ করে দিলেই হতো। কিন্তু পানি সরবরাহকারীরা তা করবে না বলে আগেই শর্ত দিয়ে রেখেছে। ' আরেক সদস্য বলেন, 'বিষয়টি ওয়াসার দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের জানালেই ওরা পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ' ফলে ঘুষ দিয়েই পানি কেনার সিদ্ধান্ত হয় সভায়।

বলা হয়, পানির বিলের ওপর ঘুষ দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে সেগুলো সংরক্ষণ করতে হবে অডিটের জন্য। এর পর থেকে সেভাবেই চলছে। চলতি বছরের ১ মার্চ হাসপাতালের পানির বিলের কপিতে একজন কর্মকর্তা মন্তব্য করেন, 'ওয়াসার এক গাড়ি পানির দাম ৪০০ টাকা। কিন্তু হাসপাতালকে আরো অতিরিক্ত ৫০০ টাকা ঘুষ দিয়ে অর্থাৎ এক গাড়ি পানি ৯০০ টাকায় কিনতে হয়। ' মন্তব্যে আরো বলা হয়, দৈনিক পাঁচ-সাত গাড়ি পানি আনলেও কোনো রশিদে ৪০০ টাকার বেশি উল্লেখ করা হয় না।

বিলের নিচে লায়ন্স চক্ষু ইনস্টিটিউটের মহাসচিবের মন্তব্য, 'প্লিজ ট্রাই টু রিকানেক্ট ওয়াটার কানেকশন। ' এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. লিয়াকত আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এখন তো আগের চেয়ে বেশি পরিমাণ পানি উৎপাদিত হচ্ছে। প্রতিদিন ২২৮ কোটি লিটার চাহিদার বিপরীতে বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা ২১৯ কোটি লিটার। বিদ্যুতের সমস্যা থাকলেও অনেক পাম্পে বিদ্যুতের যুগ্ম সংযোগ নেওয়ায় প্রতিদিন কমবেশি ২০০ কোটি লিটার পানি উৎপাদিত হচ্ছে। কাজেই পাইপলাইনে পানি না থাকার কোনো কারণ নেই।

তাহলে কেন পানিবাণিজ্য হবে?' হাসপাতালের অনেকেও মনে করেন, পাইপলাইনে পানি ঠিকই আছে। এর প্রমাণ দিতে গিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, কিছুদিন আগে ওয়াসার এক প্রকৌশলী হাসপাতালে ভর্তি হন। তিনি চাহিদামতো পানি না পেয়ে হাসপাতাল প্রশাসনের ওপর চড়াও হন। কর্তৃপক্ষ সমস্যার কথা জানালে ওই প্রকৌশলী হাসপাতালের পানি সমস্যার পূর্ণ সমাধানের আশ্বাস দেন। তখন কয়েক দিন লাইনে পানি মেলে।

তিনি সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছাড়ার পরই পুরনো অবস্থা ফিরে আসে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কর্মকর্তা জানান, পাইপলাইনে পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের একটি চাবি ওয়াসার কর্মচারীদের হাতে থাকে। 'পানিবাণিজ্য' চালাতে তারাই সেই চাবি অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখে, যাতে হাসপাতালের লাইনে পানি না যায়। কিছুদিন আগে ওয়াসার কয়েকজন লোক হাসপাতালে গিয়ে জানায়, প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকা দিলে পানির ওই চাবি হাসপাতালের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হবে। তাহলে লাইনেই নিয়মিত পানি পাওয়া যাবে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাতে রাজি হয়নি। এ বিষয়টিও ওয়াসার চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে লিখিতভাবে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ফল মেলেনি। তবে আগারগাঁও এলাকার পানি সরবরাহের দায়িত্ব পালনকারী ও ঢাকা ওয়াসার অঞ্চল-৪-এর নির্বাহী প্রকৌশলী ওয়াহিদুল ইসলাম মুরাদ দাবি করেন, ওই এলাকার পানির পাম্পটির উৎপাদনক্ষমতাই কমে গেছে। এ জন্য পানির সমস্যা কিছুটা আছে।

তিনি আরো বলেন, 'এক গাড়ি পানির দাম ৪০০ টাকার পরিবর্তে ৯০০ টাকা নিলে, সেটা বরদাশত করা হবে না। যারা ঘুষ নেয়, তাদের নাম উল্লেখ করে জানালে তদন্ত করে সঙ্গে সঙ্গে বরখাস্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারণ, এটা হাসপাতাল। এখানে মানুষ সেবা নেওয়ার জন্য আসে। সেখানে অনিয়ম সহ্য করা হবে না।

' হাসপাতাল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাসপাতালের ৮৪টি শয্যার প্রায় প্রতিটিতেই প্রতিদিন রোগী থাকে। এ ছাড়া প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ রোগী দিনে চিকিৎসা নিয়ে চলে যায়। হাসপাতালের সঙ্গেই আছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের একটি শাখা। সব মিলিয়ে সহস্রাধিক লোকের চাহিদা গাড়ির পানি দিয়ে মেটানো খুবই কঠিন। এক কর্মকর্তা বলেন, পানির জন্য অগ্রিম টাকা দেওয়া হয়।

এর পরও মাঝেমধ্যে পানি পেতে দেরি হয়। তখন রোগীর অপারেশন বন্ধ রেখে পানির অপেক্ষায় থাকতে হয়। হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট লোকজন জানান, গত প্রায় আট মাসে পানির জন্য পাঁচ লাখ টাকার বেশি বিল গুনতে হয়েছে। ৪০০ টাকা গাড়ি ধরলে এ পানির দাম সোয়া দুই লাখ টাকার বেশি হতো না। হাসপাতালের প্রশাসন শাখার এক কর্মকর্তা জানান, পাইপলাইনে পানি নেই।

এর পরও প্রতি মাসে ওয়াসা ১০-১২ হাজার টাকার পানির বিল দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবাদ করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। সংযোগ বিচ্ছিন্নের ভয়ে সেগুলো পরিশোধও করতে হচ্ছে। জানা গেছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পার্শ্ববর্তী আবহাওয়া অফিসের নিজস্ব পাম্প থেকে কিছুটা পানি হাসপাতালে সরবরাহ করার জন্য আবেদন করেছিল। কিন্তু 'নিয়ম অনুযায়ী সম্ভব নয়' বলে আবহাওয়া অফিস জানিয়ে দেয়।

হাসপাতালের পাশেই অবস্থিত এলজিইডি ভবন কর্তৃপক্ষের কাছেও পানি চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।