কর্মঠ লোক রাজা হবে কিন্তু অলস চিরকালই প্রজা থাকবে।
জাতীয় এবং আর্ন্তজাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো সেই সত্যকেই তুলে ধরেছিল। ইতিহাসও সেই সত্যকেই বহন করবে।
পৃথিবীর ইতিহাসে ক’জন নেতা দেশের মানুষের এত ভালোবাসা পেয়েছেন? কিন্তু পরিবর্তে তিনি জনগণকে আপন করে নিতে পারেননি।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টের বিপ্লব দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিল।
সমসাময়িক দেশ বিদেশের প্রতিক্রিয়াতেই তা লেখা রয়েছে। ইতিহাসেও তা থাকবে। আজ আর একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ৩৯ বছর আগে স্বাধীনতার যাত্রাকাল থেকে ক্ষমতাসীনরা যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করত, যদি সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা থাকত, যদি বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার, বাক স্বাধীনতা, রাজনৈতিক কার্যক্রম ও সংগঠনের স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকত, যদি অন্যায়-অত্যাচার, হত্যা-নির্যাতন না হত, যদি সরকার পরিবর্তনের নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বহাল থাকত তাহলে দুর্বিষহ যন্ত্রণা থেকে নাজাত পাওয়ার জন্য ’৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের প্রয়োজন হত না।
দুষ্কৃতিকারী কর্মী ও নেতারা তার কাছে আশ্রয় ও প্রশ্রয় পেয়েছে। পরিবারের অনেকের বিরুদ্ধে দুঃষ্কর্মের রিপোর্ট পেয়েও তিনি তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি।
কর্তৃত্বের প্রতি প্রবল আকর্ষণের জন্য তার চেয়ে অধিক রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিসম্পন্ন কাউকে তিনি বরদাস্ত করতে পারতেন না। তার চরিত্রে ধৈর্য্যের অভাবও ছিল যথেষ্ট। ফলে তিনি পরীক্ষিত ও গুনবান যোগ্য সহযোগীদের কান কথায় বিভিন্ন দায়িত্ব থেকে অপসারন করেন। তিনি এক পর্যায়ে আপন/পর, বিশ্বস্ত সহযোগী এবং নির্ভরশীল বন্ধু বিবেচনার শক্তিও হারিয়ে ফেলেন। শেখ মুজিবের এই মানসিকতাকে তার রাজনৈতিক জীবনের চরম ব্যর্থতা ও পরিণতির জন্য একটি বিশেষ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
যুব নেতাদের দৌরাত্ত্বে গোটা প্রশাসনযন্ত্র বিকল হয়ে যায়। দেশে দুর্ভিক্ষ। প্রতিদিন হত্যার খবর শুনতে হয় মানুষকে। প্রকাশ্য দিবালোকে নির্বিচারে হত্যাকান্ড প্রায় প্রতিদিন সংঘটিত হয়েছে তখন। বিরোধী দলগুলোকে নির্মূল করার জন্য রক্ষীবাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়া ছাড়াও দলীয় কর্মীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হয়েছিল।
পুরো দেশ এভাবেই একটা সীমাহীন নৈরাজ্যের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল। যে মানুষ একদিন মুজিবের কারামুক্তির জন্য রোজা রেখেছে; নফল নামাজ আদায় করেছে; সেই মানুষই আওয়ামী-বাকশালী শাসনামলে আল্লাহ্পাকের কাছে কেঁদে কেঁদে শেখ মুজিবের দুঃশাসন থেকে মুক্তি চেয়েছে। জনগন শোকের পরিবর্তে মিষ্ট বিলিয়েছে। তার মৃত্যুতে প্রকাশ্যে জনগনকে ইন্নালিল্লাহ টুকু পড়তে দেখা যায়নি। কিন্তু কেন ?কারন
আওয়ামী লীগ সরকারের অপশাসন শেখ মুজিবকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল।
বাকশালী একনায়কত্ব সৃষ্টি করে তিনি তার দলের মধ্যেও অন্তঃবিরোধ তীব্র করে তোলেন। তার এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেননি দলের অনেকেই।
বাকশাল গঠন করার আগে জোর প্রচারণা চালানো হল- শেখ মুজিব তার দল ও দলীয় কর্মীদের ক্ষমতার লোভ, লালসা ও দুর্নীতি সর্ম্পকে উদাসীন নন। তিনি বুঝতে পেরেছেন তার পার্টির চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে। এ পার্টি দ্বারা দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধন করা আর সম্ভব নয়।
তাই তিনি পার্টির বিলুপ্তি ঘোষণা করে একদলীয় সরকার কায়েম করে দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনা করতে যাচ্ছেন। লোকজন ভাবল, তার এই পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে কলুশিত লোকজন ক্ষমতাচ্যুত হবে এবং সে জায়গায় নিয়োগ করা হবে ভালো লোকজনদের। কিন্তু সে আশা অল্প সময়েই কর্পুরের মত বিলীন হয়ে গেল। দেখা গেল পার্টির বিলুপ্তি ঘোষণা করে তিনি যে বাকশাল গঠন করলেন সেখানে ক্ষমতাবলয়ে স্থান পেলো ধিকৃত গাজী গোলাম মোস্তফা, মনসুর আলী এবং শেখ মনি এন্ড গংরাই। তারাই হয়ে উঠল মুখ্য প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ।
যাদের অপকর্মের বদৌলতে আওয়ামী লীগ সংগঠন হিসাবে জনগণের আস্থা হারিয়েছিল; তাদের নিয়েই ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ যাত্রা শুরু করলেন শেখ মুজিব। জনগণ হতাশ হয়ে পড়ল। পার্টি বিলুপ্ত করলেও চাটার দলকে বাদ দিতে পারলেন না শেখ মুজিব। বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে আর একটি জিনিস পরিষ্কার হয়ে উঠল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাবলয়ে পাকাপোক্তভাবে অধিষ্ঠিত করা হল তার পরিবারবর্গকে।
ব্যাপারটা এমনই যেন- পুরো দেশটাই শেখ পরিবারের ব্যক্তিগত জমিদারী!
১৬ই আগষ্ট ১৯৭৫ দৈনিক ইত্তেফাকে ‘ঐতিহাসিক নবযাত্রা’ নামে সম্পাদকীয়ের অংশবিশেষ পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি:- “দেশ ও জাতির এক ঐতিহাসিক প্রয়োজন পূরণে ১৫ই আগষ্ট শুক্রবার প্রত্যুষে প্রবীণ জননায়ক খন্দোকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সরকারের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করিয়াছেন। পূর্ববর্তী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হইয়াছেন এবং এক ভাবগম্ভীর অথচ অনাড়ম্ভর অনুষ্ঠানে খন্দোকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করিয়াছেন। দেশের আইন-শৃংখলাকারী সংস্থাসমূহ যথা: বাংলাদেশ রাইফেলস, পুলিশ এবং রক্ষীবাহিনী প্রধানগণও নতুন সরকারের প্রতি তাদের অকুন্ঠ আনুগত্য জ্ঞাপন করিয়াছেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জীবনে এই পরিবর্তনের এক বিষাদময় পটভূমি রহিয়াছে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত ও অসংখ্য মা-বোনের পবিত্র ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা একদিন যে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম সেখানে আমাদের আশা ও স্বপ্ন ছিল অপরিমেয়।
কিন্তু বিগত সাড়ে তিন বছরেরও উর্ধ্বকালে দেশবাসী বাস্তব ক্ষেত্রে যাহা লাভ করিয়াছে তাহাকে এক কথায় হতাশা ও বঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সত্যিকার আশা-আকাংখা রূপায়নে খন্দোকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে সেই ঐতিহাসিক দায়িত্ব নিতে আগাইয়া আসিতে হইয়াছে। তারও কারণ ছিল। পূর্ববর্তী শাসকচক্র সাংবিধানিক পথে ক্ষমতা হস্তান্তরের সমস্ত পথ রুদ্ধ করিয়া রাখিয়া সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপকে অনিবার্য করিয়া তুলিয়াছিল। কিন্তু ইতিহাসের গতিকে কোনদিন ক্ষমতা লিপ্সার বাধ দিয়া ঠেকাইয়া রাখা যায় না।
আজকের এই ঐতিহাসিক মুহুর্তে আমাদের দায়িত্ব অনেক। বাংলাদেশের এক মহা ক্রান্তিলগ্নে জননায়ক খন্দোকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনী যে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করিয়াছে তাহাকে সুসংহত করিতে হইলে জনগণের প্রতি অর্পিত ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে আমাদের সকলকে আজ ঐক্যবদ্ধভাবে আগাইয়া যাইতে হইবে। ”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।