বাংলায় কথা বলি,বাংলায় লিখন লিখি, বাংলায় চিন্তা করি, বাংলায় স্বপ্ন দেখি। আমার অস্তিত্ব জুড়ে বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ।
পৃথিবীর ইতিহাসের এক অন্যতম দুর্ভাগা ব্যক্তির নাম শেখ মুজিব। যিনি ৭ কোটি মানুষকে একটি দেশ দিলেন সেই দেশবাসী তাকে দিল করুণ মৃত্যু। এক সময় যাকে ঘিরে থাকত হাজারো মানুষ- লোভী সেই সব মানুষ ১৫ আগস্ট কেউ মন্ত্রী হবার জন্য লবিং করছে, কেউ বা রাষ্ট্রদূত।
তার বদনাম করতে ছাড়েনি কেউ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে তিনি বাংলাদেশে ছিলেন একটি নিষিদ্ধ নাম। কি বেতার, কি টিভি, কি পত্রিকা কোথাও তার নাম নেয়া যেত না।
১৯৯০ সালে সেনাশাসক এরশাদের পতনের পর সীমিত পরিসরে সরকারী প্রচার মাধ্যমে মুজিব আবার ফিরে আসেন। কিন্তু সেই সময়েও তাকে অবজ্ঞা করা হতো।
সেই সময় কোন একদিন টিভি তে এক অনুষ্ঠানে চরমপত্রখ্যাত এম আর আখতার মুকুলের “আমি বিজয় দেখিছি ” বইটি নিয়ে আলোচনা হয়। সেই সময় উপস্থপাক বইটি এমন ভাবে দর্শকদের সামনে তুলে ধরেন যাতে মুজিবের ছবি না দেখা যায়। সেই সময়ের একটি বিখ্যাত সাপ্তাহিক যায় যায় দিন তার টিভি আলোচনায় বলেছিল: আমি বিজয় দেখেছি, মুজিব দেখিনি। “
সর্বত্র যখন মুজিব নিষিদ্ধ তখন বাংলা একাডেমীর কোন এক অনুষ্ঠানে ১৯৭৭ সালে কবি নির্মলেন্দু গুণ সর্বপ্রথম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উচ্চারণ করার দু:সাহস দেখান। তার সেই বিখ্যাত কবিতা ” আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি।
”
কবির জবানীতেই আসুন শুনি:
১৯৭৭ সালে, আমি লিখি ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’। কবিতাটি আমি পাঠ করি বাংলা একাডেমীতে কবিতা পাঠের আসরে, ২১ ফেব্রুয়ারি ভোরে। অন্য কোনো জায়গায় কবিতা পড়ার কোনো সুযোগ তখন ছিল না। নিষিদ্ধ ছিল সমস্ত রাজনৈতিক তত্পরতা। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে তাঁকে নিয়ে এই প্রথম সরাসরি একটি কবিতা পড়লাম।
তাঁর নাম কবিতাটিতে বার বার ফিরে আসছিল। সে ছিল এক অভাবনীয় ব্যাপার। শ্রোতারা আনন্দে করতালি দিয়ে আমাকে স্বাগত জানাচ্ছিল। একটি ছেলে উঠে এসে আমার গলায় একটি ফুলের মালা পরিয়ে দেয়। কবিতাটি শুনে নানা আশঙ্কায় চত্বর ছেড়ে কেউ কেউ চলে গিয়েছিলেন।
তখন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ছিলেন আশরাফ সিদ্দিকী। তিনি কাঁপতে কাঁপতে আমার কাছে এসে বললেন, ‘তুমি আমার চাকরিটা খাইছ। চলো, এখন আমার রুমে বসে একটু চা খাবে। ’ উত্তরে রসিকতা করে আমি বলি, ‘স্যার, চাকরি চলে গেলেও বেতন আপনি ঠিকই পাবেন। ’ তিনি আমাকে তাঁর কক্ষে নিয়ে যান।
সেখানে গিয়ে দেখি গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা সাদা পোশাকে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। একজন বললেন, ‘কবি সাহেব, আপনি তো সাংঘাতিক কবিতা লিখছেন। কপিটা দেন তো, দেখি। ’ বললাম, ‘আমার কাছে তো কবিতাটা নেই। অন্য এক লোক নিজেকে গোয়েন্দা পরিচয় দিয়ে কপিটা নিয়ে গেছে।
’ ওঁরা কথাটা বিশ্বাস করলেন। বললেন, ‘স্মৃতি থেকে কয়েকটা লাইন বলেন। ’ আমি বললাম, ‘আমার তো কবিতা মনে থাকে না। একটা লাইন শুধু মনে আছে, “আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি। ” লাইনটি পাঁচবার আছে।
’
ওখান থেকে বেরিয়ে আসার পর ওঁরা আমাকে ডিবি অফিসে নিয়ে যেতে চাইলেন। একদল শ্রোতা তখন আমাকে ঘেরাও করে রাখল। আমি জানতে চাইলাম, ‘কেন যাব। ’ ওঁরা আমাকে বললেন, ‘আমাদের এসপি সাহেবের কাছে বসে একটু চা খাবেন। ’ আমি বললাম, ‘আমি আর কত চা খাব?’ আমাকে গ্রেপ্তার করলে তো যেতেই হবে।
কিন্তু চা খেতে যেতে চাই না। ’ এক পর্যায়ে তাঁরা ওয়্যারলেসে কথা বললেন। তারপর আমাকে রেখে চলে গেলেন। আমি মহাদেবের বাসায় থাকাকালে সাদা পোশাকে গোয়েন্দারা আমার গতিবিধির ওপর লক্ষ রাখত। গোয়েন্দাদের একজনের সঙ্গে পরে আমার পরিচয় হয়।
বাংলা একাডেমীতে পড়া সেই কবিতার কয়েকটি লাইন:
সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ গতকাল
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
...
সমবেত সকলের মতো আমিও পলাশ ফুল খুব ভালোবাসি,
‘সমকাল’ পার হয়ে যেতে সদ্যফোটা একটি পলাশ গতকাল কানে কানে
আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
শাহবাগ অ্যাভিন্যুর ঘূর্ণায়িত জলের ঝর্ণাটি আর্তস্বরে আমাকে বলেছে,
আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
...
এই বসন্তের বটমূলে সমবেত ব্যথিত মানুষগুলো সাক্ষী থাকুক,
না-ফোটা কৃষ্ণচূড়ার শুষ্ক-ভগ্ন অপ্রস্তুত প্রাণের ঐ গোপন মঞ্জরীগুলো
কান পেতে শুনুক, আসন্ন সন্ধ্যার এই কালো কোকিলটি জেনে যাক;
আমার পায়ের তলার পুণ্য মাটি ছুঁয়ে
আমি আজ সেই গোলাপের কথা রাখলাম,
আমি আজ সেই পলাশের কথা রাখলাম,
আমি আজ সেই স্বপ্নের কথা রাখলাম।
আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি,
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।