চলার পথ অনেক, সত্য পথ একটাই
রমজানে প্রাপ্ত বয়স্ক প্রত্যেক নর-নারীর জন্য রোজা রাখা ফরজ। প্রায় ৮০% টাইপ-২, ডায়াবেটিস রোগী এবং ৪০% টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগী রমজান রোজা রাখে।
রমজান-চন্দ্রমাস হওয়াতে ২৯ বা ৩০ দিনে হয়। ভৌগোলিক অবস্থান এবং ঋতু ভেদে কমেবেশি প্রায় ১৬ ঘন্টা রোজা রাখতে হয়।
রোজা রাখলে শরীরে কি হয়?
খাবার খেলে অগ্নাশয় থেকে ইনসুলিন নিঃসৃত হয়।
যা লিভার এবং মাংসপেশীতে গস্নুকোজকে গস্নাইকোজেন হিসেবে জমা করে। রোজার সময় রক্তের গস্নুকোজের মাত্রা কমতে থাকে। যার কারণে ইনসুলিন নিঃসরণ কমে যায়। একই সময়ে গস্নুকাগন এবং কেটে-কোলামিন বেড়ে যায় যা গস্নুকোনিউজনিসের মাধ্যমে এবং গস্নাইকোজেন ভেঙ্গে গস্নুকোজের চাহিদা মিটায়। দীর্ঘ সময় খালি পেটে থাকলে গস্নাইকোজেন শেষ হয়ে যায় আর ইনসুলিনের মাত্রা কম থাকার কারণে এডিপোসাইট থেকে ফ্যাটি এসিড নিঃসরণ বেড়ে যায়।
মাংশপেশী, হ্নদপিন্ড, লিভার, কিডনি এবং এডিপোস টিসু ফ্লাটি এসিডকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে সাথে কিটোন তৈরি করে।
টাইপ-১ ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রে হাইপোগস্নাইইসেমিয়া প্রতিরোধে গস্নুকাগন নিঃসরণ চাহিদামত হয় না। ইনসুলিনের খুব বেশি ঘাটিত থাকলে সাথে দীর্ঘ সময় খালি পেটে থাকলে গস্নাইকোজেন বেশি পরিমাণে ভাঙ্গে। গস্নুকোনিউজেনেসিস এবং কিটোজেনেসিস বেড়ে যায়। যার কারণে হাইপার গস্নাইসিমিয়া এবং কিটো এসিডোসিস হয়।
টাইপ-২ ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রেও দীর্ঘ সময় খালি পেটে থাকলে একই ধরনের সমস্যা হতে পারে।
রোজার কারণে ডায়াবেটিক রোগীর যে ধরনের সমস্যা হতে পারে-
১। হাইপো গস্নাইসেমিয়া
২। হাইপার গস্নাইসেমিয়া
৩। ডায়াবেটিক কিটো এসিডোসিস
৪।
পানি শূন্যতা এবং থ্রম্বসিস।
বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে রমজান মাসে ডায়াবেটিক রোগীর হাইপো গস্নাইসোমিয়ার মাত্রা টাইপ-১ রোগীর ক্ষেত্রে ৪.৭ গুণটাইপ-২ রোগীর ক্ষেত্রে ৭.৫ গুণ বেড়ে যায়। আর হাইপার গস্নাইসেমিয়া টাইপ-২ রোগীর ক্ষেত্রে ৫ গুণ এবং টাইপ-১ রোগীর ক্ষেত্রে ৩ গুণ বেড়ে যায়।
দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকাই পানিশূন্যতার মূল কারণ। গরম এবং আর্দ্র আবহাওয়া এবং কঠোর পরিশ্রম সাথে হাইপোরগস্নাইসেমিয়ায় অতিরিক্ত প্রশ্রাবের কারণে পানি শূন্যতা এবং ইলেকট্রোলাইটের পরিমাণ কমে যেতে পারে।
বস্নাড পেশার কমে গিয়ে অজ্ঞান হওয়া, পড়ে গিয়ে আঘাত পাওয়া, হাড় ভেঙ্গে যাওয়া বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে।
চিকিৎসা
ধর্মীয় অনুভূতি এবং ডায়াবেটিস জনিত জটিলতার কথা বিবেচনায় রেখে রোগী নিজেই সিদ্ধান্ত নিবেন রোজা রাখবেন কিনা তবে জটিলতার ব্যাপারে ডাক্তারের সাথে বিস্তারিত আলোচনা অতীব জরুরি। রোজার কারণে যে সমস্ত রোগী ঝুঁকিপূর্ণ তাদের বিবরণ নিম্নে দেওয়া হলো-
যারা খুব বেশি ঝুঁকিপূর্ণ
১। রমজানের পূর্বে বিগত ৩ মাসের মধ্যে খুব বেশি হাইপোগস্নাইসেমিয়া হয়েছিল।
২।
যাদের বার বার হাইপো গস্নাইসেমিয়া হয়।
৩। যারা হাইপোগস্নাইসেমিয়া বুঝতে পারে না।
৪। যাদের দীর্ঘদিন ঘরে অনিয়মিত ডায়াবেটিস।
৫। বিগত ৩ মাসের মধ্যে (রমজানের পূর্বে) যাদের কিটোএসিডোসিস হয়েছিল।
৬। যারা টাইপ-১ ডায়াবেটিক রোগী।
৭।
যাদের অন্যান্য অসুস্থতার মাত্রা অধিক।
৮। যারা বিগত ৩ মাসের মধ্যে ডায়াবেবিস বাড়ার কারণে অজ্ঞান হয়েছিল।
৯। যারা অধিক পরিমাণে পরিশ্রম করে।
১০। গর্ভাবস্থা।
১১। যারা ডায়ালাইসিসের রোগী।
বেশি ঝুঁকি পূর্ণ
১।
যাদের ডায়াবেটিস ৮.৩-১৬.৭ মিলিমোল/ লিটার এর মধ্যে এবং এইচবিএ, সি ৭.
৫-৯% এর মধ্যে।
২। যাদের কিডনিতে সমস্যা (রেনাল ইনসাফিসিয়েন্সি) আছে।
৩। যাদের অর্ধাঙ্গ, পক্ষাঘাত অথবা এমআই, আইএইচডি ইত্যাদি আছে।
৪। যারা একা থাকেন এবং ইনসুলিন নেয় বা গিস্নবেন ক্লামাইড/ গিস্নকাজাইড ইত্যাদি ওষুধ সেবন করেন।
৫। যারা একা থাকেন।
৬।
যাদের অন্যান্য জটিলতা আছে।
৭। যাদের বয়স বেশি ও স্বাস্থ্য খারাপ।
পরিমিত ঝুঁকিপূর্ণ
যাদের ডায়াবেটিস খুব ভালভাবে নিয়ন্ত্রিত এবং যাদের জবঢ়ধমষরহরফব/ঘবঃরমষরহরফব জাতীয় ওষুধে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে।
কম ঝুঁকিপূর্ণ
যাদের খাদ্য নিয়ন্ত্রণেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে অথবা মেটফরমিন বা পাইওগিস্নটাজন জাতীয় ওষুধে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে এবং শারীরিকভাবে সুস্থ।
১। রমজান মাসে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ এবং ডায়াবেটিস জনিত জটিলতার ব্যবস্থাপত্র রোগীভেদে বিভিন্নরকম।
২। যে সব রোগী খুব বেশি ঝুঁকিপূর্ণ তাদের রক্তে গস্নুকোজের মাত্রা দিনে ২/৩ বার করে পরিমাণ করতে হয়।
৩।
পুষ্টিঃ ৫০-৬০% ডায়াবেটিসের রোগীর রমজান মাসে শরীরের ওজন অপরিবর্তিত থাকে। ২০-২৫% রোগীর হয় ওজন বাড়ে না হয় ওজন কমে, মাঝে মাঝে ৩ কেজির বেশি ওজন কমে যায়। সাধারণতঃ ইফতারির সময় জটিল শর্করা ও চর্বি জাতীয় খাবার রোগীরা বেশি খেয়ে থাকে, তা পরিত্যাগ করা উচিত। কারণ এইসব খাবার পরিপাক হতে অনেক সময় লেগে যায়। তাই জটিল শর্করা জাতীয় খাবার সেহেরীর সময় এবং অধিকতর সরল শর্করা জাতীয় খাবার ইফতারিতে খাওয়াই ভাল।
ইফতারি থেকে সেহরি পর্যন্ত সময়ে বেশি পরিমাণ পানি/পানি জাতীয় খাবার খাওয়া উচিত। সেহরির খাবার শেষ সময়ের একটু পূর্বে খাওয়াই ভাল।
ব্যায়াম
সাধারণত কায়িক পরিশ্রম করা যায়। অতিরিক্ত পরিশ্রম করলে হাইপোগস্নাইসেমিয়ার ঝুকি বেড়ে যায়। তাই পরিহার করতে হবে।
বিশেষ করে বিকেল বেলা বিশ্রামে থাকা উচিত। তারাবির নামাজ ব্যয়ামাকের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। টাইপ-১ রোগী ডায়াবেটিস বেশি থাকাবস্থায় ব্যয়াম করলে ডায়াবেটিস আরো বেড়ে যেতে পারে।
৫। যদি রক্তে গস্নুকোজের মাত্রা ৩.৩ মিলিমোল/ লিটার বা ৬০ মিলিগ্রাম/ ডিএল এর নিচে থাকে তবে রোজা ভেঙ্গে ফেলাই উচিত।
যদি দিনের শুরুতে রক্তে গস্নুকোজের মাত্রা ৩.৯ মিলি মোল/ লিটার বা ৭০ মিলিগ্রাম/ ডিএল এর নিচে থাকে তবে রোজা ভেঙ্গে ফেলাই উচিত। বিশেষ করে রোগী যদি ইনসুলিন নির্ভর বা গিস্নবেনক্লাইমাইড, গিস্নক্লাজাইড, গিস্নমিপিরাইড, ত্রিপিজাইড জাতীয় ওষুধ সেবন করে। আবার রক্তে গস্নুকোজ ১৬.৭ মিলিমোল/লিটার বা ৩০০ মিলিগ্রাম/ডি.এল এর উপরে থাকলে রোজা ভেঙ্গে ফেলাই উচিত। অসুস্থ অবস্থায় রোজা না রাখাই উচিত।
৬।
টাইপ-১ ডায়াবেটিক রোগীর জন্যঃ খালি পেটে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকলে খাবার পর ডায়াবেটিস খুব বেশি বাড়ে না। তাই খালি পেটে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য ইনসুলিন এনপিএইচ দিনে ২ বার ইফতারি ও সেহরিতে নিতে হয়। খাওয়ার পরবর্তী ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য সলিউবল ইনসুলিন ইফতারি ও সেহরিতে নিতে হয়।
৭। টাইপ-২ রোগীর জন্যঃ যে সব রোগীর ডায়াবেটিস পরিমিত খাদ্য ও নিয়মিত ব্যায়ামের নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় আছে, তাদের রোজার নির্দিষ্ট খাদ্য তালিকা মেনে চলা উচিত বা ডায়াবেটিক হাসপাতালে পাওয়া যায়।
নিয়মিত ব্যায়াম ইফতারীর ২ ঘন্টা পর করা উচিত।
যে সব রোগী ওষুধ সেবন করেন তাদের ক্ষেত্রে মেটফরমিন তিন ভাগের দুই ভাগ ইফতারীর পর এবং তিনভাগের এক ভাগ সেহরির পর খাওয়া ভাল।
পায়োগিস্নটাজোনের ডোজ পরিবর্তন না করলেও চলে।
গিস্নমিপিরাইড/গিস্নকাজাইড এমআর/গিস্নবেনক্লেমাইড-দিনে ১ বার ইফতারির সময়।
গিস্নকাজাইড (৮০ এমজি) ইফতারিতে সকালের ডোজ আর সেহরিতে রাতের ডোজের অর্ধেক।
রিপাগিস্ননাইড/নেটিগিস্ননাইড-দিনে ২ বার ইফতারি ও সেহরি খাওয়া যায়।
৮। ইনসুলিন নির্ভর রোগীর জন্যঃ ইনসুলিন গস্নারজিন রাতে ঘুমানোর আগে ১ বার অথবা ইনসুলিন এনপিএইচ ইফতারি ও সেহরিতে দিনে দুই বার নিলে ডায়াবেটিস নিয়ন্তণে থাকে। তবে অধিকাংশ রোগীরা ইফতারীর সময় বেশি ক্যালরীর খাবার খায় বলে অতিরিক্ত সলিউবল ইনসুলিন নিতে হয়।
যে সব রোগী ৭০/৩০ প্রিমিক্সড ইনসুলিন নিয়ে থাকেন তাদের ক্ষেত্রে ইফতারীর সময় সকালের ডোজ এবং সেহেরীতে রাতের ডোজের অর্ধেক নিবেন।
রোজার সময় পানি শূন্যতা, রক্তের আয়তন কমে গিয়ে হাইপো টেনশন হতে পারে। তাই প্রেসারের ওষুধগুলো মাত্রা পুনঃনির্ধারন জরুরি, কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার রক্তে চর্বি থাক বা না থাক ডায়াবেটিস রোগীর জন্য সর্বদা বর্জন করা উচিত।
**************************
ডাঃ গিয়াস আল মামুন
কনসালটেন্ট ডায়াবেটলজিস্ট
চট্টগ্রাম ডায়াবেটিস হাসপাতাল কমপ্লেক্স
দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ সেপ্টেম্বর।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।