সে অনেক অনেক কাল আগের কথা, এক দেশে ছিল এক রাজপুত্র। রাজপুত্রের এমনই রূপ যে তার রূপে রাজপুরীতে আলো ঝলমল করে। আর রাজপুত্রের গুণের কথা লোকের মুখে মুখে।
একদিন রাজপুত্রের মনে হলো, তার এখন দেশভ্রমণে যাওয়া উচিত। এই কথা শুনে রাজ্যের লোকের মন খারাপ হলো, রাণী আহার-নিদ্রা ছাড়লেন, কেবল রাজা বললেন,-"আচ্ছা, যাক।
"
তখন দেশের লোক দলে-দলে সাজলো,
রাজা চর-অনুচর দিলেন,
রাণী মণি-মাণিক্যের ডালা সাজিয়ে নিয়ে আসলেন।
রাজপুত্র লোকজন, মণি-মাণিক্য চর অনুচর কিছুই সঙ্গে নিলেন না।
নূতন পোশাক পরে, নূতন তলোয়ার ঝুলিয়ে রাজপুত্র দেশভ্রমণে বের হলেন।
যেতে যেতে যেতে, কত দেশ, কত পর্বত, কত নদী, কত রাজার রাজ্য ছেড়ে, রাজপুত্র এক বনের মধ্যে এসে পড়লেন "দেখলেন, বনে পাখ-পাখালীর শব্দ নেই, বাঘ-ভালুকের সাড়া নেই!
রাজপুত্র আবার চলতে লাগলেন।
চলতে চলতে, অনেক দূর গিয়ে রাজপুত্র দেখলেন, বনের মধ্যে বিশাল এক যে রাজপ্রাসাদ।
অমন রাজপ্রাসাদ রাজপুত্র আর কখনও দেখেননি। সব দেখে রাজপুত্র খুব অবাক হয়ে রইলেন।
রাজপুরীর সিংহদুয়ারের চূড়া আকাশ ছোয়া। কিন্তু সেখানে না আছে কোন নহবতখানা, না আছে দাররক্ষী।
রাজপুত্র আস্তে আস্তে রাজপুরীর মধ্যে গেলেন।
রাজপুরীর মধ্যে যেয়ে দেখেন, প্রাসাদের সব কিছু পরিস্কার, ঝকঝক তকতক করছে। কিন্তু এমন সুন্দর প্রাসাদের মধ্যে জন-মানুষ নাই, কোন কিছুই সাড়া-শব্দ পাওয়া যায় না, পুরী নিভাজ, নিঝুম, গাছের পাতাও পড়ে না, কুটাটুকু নড়ে না।
রাজপুত্র খুবই আশ্চর্য হয়ে গেলেন।
সে ঘুরেফিরে এদিক সেদিক দেখতে লাগলো। এক জায়গায় গিয়ে রাজপুত্র থমকে গেলেন!
দেখেন কি বিশাল বড় একটা আঙ্গিনা, আঙ্গিনা জুড়ে হাতী, ঘোড়া, সেপাই, লস্কর, দ্বাররক্ষী, সৈন্য-সামন্ত সব সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে।
রাজপুত্র হাঁক দিলেন "কেউ আছেন?"
কিন্তু কেউ কথা বললো না, কেউ তাঁর দিকে ফিরেও তাকালো না।
অবাক হয়ে রাজপুত্র কাছে গিয়ে দেখলেন, কাতারে কাতারে সিপাই, লস্কর, কাতারে কাতারে হাতী ঘোড়া সব কোন এক যাদুবলে পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে! কারও চেখের পলক পড়ে না, কারও গায়ে চুল নড়ে না। রাজপুত্র আশ্চর্য হইয়া দাঁড়িয়ে রইলেন।
এরপর রাজপুত্র ধিরে ধিরে তখন রাজপুত্র রাজপ্রাসাদের ভেতরে মধ্যে গেলেন।
এক ঘরে গিয়া দেখলেন, ঘরের মধ্যে কত রকমের ঢাল তলোয়ার, তীর, ধনুক সব হাজারে হাজারে টানানো রহিয়াছে।
পাহারাদ্বারদের পাথরের মূর্তি, সিপাইদের পাথরের মূর্তি। এবার রাজপুত্র একটু হকচকিয়ে গেলেন, তিনি তখন তলোয়ার হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে চলে আসলেন ওখানে থেকে।
আর এক ঘরে যেয়ে দেখলেন, মস্ত এক রাজদরবার। রাজদরবারে সোনার প্রদীপে ঘিয়ের বাতি জ্বল্ জ্বল্ করে জ্বলছে, চারিদিকে মণি-মাণিক্য ঝক্ঝক্ করছে। কিন্তু এখানেও রাজসিংহাসনে রাজা পাথরের মূর্তি, মন্ত্রীর আসনে মন্ত্রী পাথরের মূর্তি, পাত্র-মিত্র, ভাট বন্দী, সিপাই লস্কর যে যেখানে, সে সেখানে পাথরের মূর্তি হয়ে আছে।
কারও চোখে পলক নেই, কারও মুখে কথা নাই।
রাজপুত্র দেখিলেন, রাজার মাথায় রাজছত্র হেলিয়া আছে, দাসীর হাতে চামর ঢুলিয়া আছে,-সাড়া নাই, শব্দ নাই, সব ঘুমে নিঝুম। রাজপুত্র মাথা নোয়াইয়া চলিয়া আসিলেন।
আর এক ঘরে যেয়ে দেখলেন, যেন কত শত প্রদীপ একসঙ্গে জ্বলছে, কত রকমের ধন-রত্ন, কত হীরা, কত মাণিক, কত মোতি, ঘরে একেবারে উপচে পড়ছে! রাজপুত্র কিছু ছুয়ে দেখলেন না, অন্য এক ঘরে চলে গেলেন।
সে ঘরে যেতে না যেতে হাজার হাজার ফুলের গন্ধে রাজপুত্র বিভোর হয়ে উঠলেন।
কোথা থেকে এমন ফুলের গন্ধ আসে?
রাজপুত্র ঘরের মধ্যে যেয়ে দেখিলেন, পানিটানি কিছুই নেই কিন্তু ঘরের মাঝখানে লাখে লাখে পদ্মফুল ফুটে আছে! পদ্মফুলের গন্ধে ঘর ম'-ম' করছে। রাজপুত্র ধীরে ধীরে ফুলবনের কাছে গেলেন।
ফুলবনের কাছে গিয়া রাজপুত্র দেখেন, ফুলের বনে সোনার খাঁট, সোনার খাটে হীরার ডাঁট, হীরার ডাঁটে ফুলের মালা ঝুলানো। সেই মালার নিচে, হীরার নালে সোনার পদ্ম, সোনার পদ্মে এক পরমা সুন্দরী রাজকন্যা বিভোরে ঘুমাচ্ছে। ঘুমন্ত রাজকন্যার হাত দেখা যায় না, পা দেখা যায় না, কেবল চাঁদের কিরণ মুখখানি সোনার পদ্মের সোনার পাঁপ্ড়ির মধ্যে টুল্-টুল্ করছে।
রাজপুত্র অবাক হয়ে তাকে দেখতে লাগলেন।
দেখতে দেখতে, দেখতে, দেখতে, কত বছর যে চলে গেল!!!
রাজকন্যার আর ঘুম ভাঙ্গে না, তাই রাজপুত্রেরও চোখে আর পলক পড়ে না। রাজকন্যা অঘোরে ঘুমাচ্ছেন আর রাজপুত্র বিভোর হইয়া দেখছেন।
হঠাৎ একদিন রাজপুত্র দেখলেন, রাজকন্যার মাথার কাছে এক সোনার কাঠি! রাজপুত্র আস্তে আস্তে সোনার কাঠিটা তুলে নিলেন।
সোনার কাঠি তুলে নিতেই দেখলেন, আর এক দিকে এক রূপার কাঠি।
রাজপুত্র আশ্চর্য হয়ে রূপার কাঠিও তুলে নিলেন, দুই কাঠি হাতে নিয়ে রাজপুত্র নাড়ে চেড়ে দেখতে লাগলেন।
দেখতে দেখতে, সোনার কাঠিটা হঠাৎ টুক করে ঘুমন্ত রাজকন্যার মাথায় ছুঁয়ে গেল! অমনি পদ্মের বন 'সরোগোল উঠলো, সোনার খাট নড়ে উঠলো; সোনার পাঁপ্ড়ি ঝরে পড়ল, রাজকন্যার হাত হলো; পা হলো; গায়ের আলস ভাঙ্গে, চোখের পাতা কচলে ঘুমন্ত রাজকন্যা চমকে উঠে বসলেন।
আর অমনি রাজপুরীর চারিদিকে পাখি ডেকে উঠলো, দ্বারোয়ান দরজার এসে হাঁক ছাড়লো। উঠোনে হাতী ঘোড়া ডাক ছাড়ল, সিপাইয়ের তলোয়ার ঝন ঝন করে উঠল; রাজদরবারে রাজা জাগলেন, মন্ত্রী জাগলেন, পাত্র জাগলেন। হাজার বছরের ঘুম হতে, সে যেখানে ছিলেন, জেগে উঠলেন-লোক লস্কর, সৈন্য সামন্ত তীর তলোয়ার নিয়ে লাফিয়ে উঠে দাড়ালো।
সবাই অবাক হয়ে ভাবলো কে আসলো রাজপুরীতে?
আর ওদিকে রাজপুত্র অবাক হয়ে রাজকন্যার দিকে তাকিয়ে রইলেন, রাজকন্যা অবাক হয়ে রাজপুত্রের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
রাজপুরীর চারদিকে ঢাক-ঢোল, শানাই-নাকাড়া বেজে উঠল!
রাজা বললেন,-"তুমি কোন দেশের ভাগ্যবান রাজার রাজপুত্র, আমাদের মরণ-ঘুমের হাত থেকে বাঁচালে!"
রাজপুত্র মাথা নামিয়ে চুপ করে রইলেন।
রাজা বললেন,-"আমার কি আছে, কি যে তোমাকে দেবো? নাও, রাজকন্যা তোমার হাতে দিলাম, এই রাজত্ব তোমাকে দিলাম। "
চারিদিকে ফুল-বৃষ্টি, চারিদিকে চন্দন-বৃষ্টি; ফুল ফোটে, খৈ ছোটে,-রাজপুরীর হাজার ঢালে 'ডুম-ডুম' করে ঢাকের কাঠি বেজে উঠলো।
দুয়ারে দুয়ারে মঙ্গল ঘড়া
পাঁচ পল্লব ফুলের তোড়া;
আল্পনা বিলিপনা, এয়োর ঝাঁক,
পাঠ-পিঁড়ি আসনে ঘিরে', বেজে ওঠে শাঁখ।
সে যে কি শোভা চারিদিকে!!
তারপর, ফুটফুটে' চাঁদের আলোয় আগুন-পুরুতে সামনে, পানসুপারি, রাজ-রাজত্ব যৌতুক দিয়ে, রাজা পঞ্চরত্ন মুকুট পরিয়ে রাজপুত্রের সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ে দিলেন। চারিদিকে জয়ধ্বনি উঠলো।
ওদিকে এক বছর, দুবছর, বছরের পর বছর কত বছর গেল,-দেশভ্রমণে গেছেন, রাজপুত্র আর ঘরে ফেরেন না। কেঁদে কেঁদে, মাথা কুটে রাণী বিছানা নিয়েছেন। ছেলের কথা ভেবে ভেবে চোখের জল ফেলতে ফেলতে রাজা অন্ধ হয়ে গেছেন।
রাজ্য অন্ধকার, রাজ্যে হাহাকার।
একদিন ভোর হতে না হতেই রাজদুয়ারে ঢাক-ঢোল বেজে উঠলো, হাতী ঘোড়া সিপাই সান্ত্রীর হাঁকে দুয়ার কেঁপে উঠিল।
রাণী বলিলেন,-"কি হলো কি হলো?"
রাজা বলিলেন,-"কে এলো , কে এলো?"
রাজ্যের প্রজারা সব ছুটে আসিল।
ঘটনা আর কিছুই না, রাজপুত্র- রাজকন্যা বিয়ে করে নিয়ে ফিরে এসেছেন!!
আবাক খুশিতে কাঁপতে কাঁপতে রাজা এসে রাজপুত্রকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। পড়িতে পড়িতে রাণী এসে রাজকন্যাকে বরণ করে নিলেন।
প্রজারা আনন্দধ্বনি করে উঠলো।
রাজপুত্র রাজার চোখে সোনার কাঠি ছোঁয়ালেন, রাজার চোখ ভাল হয়ে গেলো। । ছেলেকে পেয়ে, ছেলের বউ দেখে রাণীর অসুখ সেরে গেল।
তখন, রাজপুত্র নিয়ে, ঘুমন্ত পুরীর রাজকন্যা নিয়ে, রাজা-রাণী সুখে রাজত্ব করতে লাগলেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।