আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সৌরশক্তি

~~~কেমন যেন একটা উৎকন্ঠায় আছি.......
একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজের জন্য বিদ্যুৎ অপরিহার্য। আমাদের বিদ্যুতের ঘাটতি অনেক। শুধুমাত্র প্রচলিত পদ্ধতিতে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, এর পাশাপাশি জোর দিতে হবে নবায়নযোগ্য বা বিকল্প পদ্ধতির দিকে। ভবিষ্যতের চাহিদা শুধু গ্যাস ও কয়লা দিয়ে মেটানো সম্ভব হবে নয়, এজন্য প্রয়োজন বিকল্প পদ্ধতি। সৌরবিদ্যুৎ (সোলার সিস্টেম) এমনই একটি পদ্ধতি।

এই পদ্ধতিতে সূর্যের আলোর কণা সোলার মডিউলে পড়লেই সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। এ বিদ্যুৎ ব্যাটারিতে জমা হয়, সোলার হোম সিস্টেমে চার্জ কন্ট্রোলার ব্যাটারিকে অতিরিক্ত চার্জ ও ডিসচার্জ হওয়া থেকে রক্ষা করে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ বিতরণ করে। সৌরবিদ্যুতের প্যানেল থেকে পাওয়া যায় ডিসি (ডিরেক্ট কারেন্ট) বা সমবিদ্যুৎ। আমরা যে বিদ্যুতের সঙ্গে পরিচিত, এটি তার থেকে ভিন্ন। সব সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে থাকে একটি পরিবর্তক (ইনভার্টার), যা সমবিদ্যুৎ প্রবাহকে পরিবর্তী প্রবাহে (এসি) পরিণত করে।

২০ থেকে ৭৫ ওয়াটের হোম সিস্টেমে দুটি ফ্লোরোসেন্ট ও দুটি এলইডি বাতি থেকে ছয়টি ফ্লোরোসেন্ট এবং তিনটি এলইডি লাইট অথবা দুটি লাইটের পরিবর্তে একটি সাদাকালো টিভি চালানো যায়। দৈনিক চার ঘণ্টা চালানো যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ সংক্রান্ত গবেষণা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি কাউন্সিলের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ সালে সৌরবিদ্যুতে বিনিয়োগ ছাড়িয়েছে ৩৩৫০ কোটি ডলার। সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন ৫ বছরে বেড়েছে ৬ গুণ, আর বিনিয়োগ বেড়েছে ১৭২ গুণ।

উন্নত দেশগুলো প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে থাকলেও, সৌর বিদ্যুতের জনপ্রিয়তা বেশি বেড়েছে এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। বিশেষভাবে চীন, ভারত ও বাংলাদেশে। ইউরোপের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের সংগঠন ইপিআইএ সম্প্রতি জানিয়েছে, ২০০৯ সালে বিশ্বজুড়ে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বেড়েছে ৪৪ ভাগ। সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে গত বছরই বেড়েছে ৬ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট।

সৌর বিদ্যুতের ২০১০ সালের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এবছরও বিশ্বে সৌরবিদ্যুতে প্রবৃদ্ধি হবে ৪০ শতাংশের বেশি। সৌর শক্তির প্রযুক্তি আর ব্যবহারে ইউরোপ আছে শীর্ষে। তবে পিছিয়ে নেই যুক্তরাষ্ট্রও। ইউরোপ আমেরিকাকে ছাড়িয়ে শীর্ষে আসার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে চীন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঘোষণা করেছেন, ভারত ২০২২ সাল নাগাদ ২০ হাজার মেগাওয়াট সৌর শক্তি চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করবে।

কেবল নির্মাতা নয়, সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহারকারিদের তালিকাতেও দেশ হিসেবে শীর্ষে আছে জার্মানি। বিশ্বের বড় ৫০টি সোলার প্যানেলের তালিকায় আছে স্পেন আর জার্মানির দাপট। তবে এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড়, ৬০ মেগাওয়াটের সোলার প্যানেল আছে স্পেনের অমেডিলায়। ৫৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জার্মানির স্টার ব্রিকেন তার দ্বিতীয় অবস্থানটি সম্ভবত হারাতে যাচ্ছে। কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, ক্যালিফোর্নিয়ায় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সোলার প্যানেল স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন।

আর মহাপ্রাচীরের মতোই বিশ্বের সবকিছুতে সবচেয়ে বড় হওয়ার ইচ্ছাপূরণে চীন শুরু করেছে সবচেয়ে বড় সোলার প্যানেল বসানোর কাজ। মঙ্গোলিয়ার শিল্পনগরী অর্দোসে নির্মাণাধীন এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ২০১৯ সালের মধ্যে এই একটি প্রকল্প থেকেই পাওয়া যাবে ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। ওয়ার্ল্ড ওয়াচ ইনস্টিটিউট বাজার জরিপ করে বলেছে, এবছরের মধ্যেই চীন সৌর বিদ্যুতে ইউরোপ, আমেরিকা বা জাপানকে ছাড়িয়ে যাবে। সৌর বিদ্যুতের জন্য বাংলাদেশ খুবই সম্ভাবনাময় একটি দেশ। কারণ এখানে বছরে তিনশো দিনেরও বেশি রোদ থাকে।

বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুৎ সম্ভাবনাকে বাস্তব করতে ২০০৩ সাল থেকে কাজ করে আসছে বিভিন্ন কোম্পানি; তাদের মধ্যে ইডকল, গ্রামীণ শক্তি, ব্র্যাক, সৃজনী, ও ব্রিজ অন্যতম। ইনস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড (ইডকল) নামের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ সেক্টরে বিশ্বব্যাংক সামগ্রিক অর্থায়ন করে থাকে। সরকারি মালিকানার এই প্রতিষ্ঠান সারাদেশে সৌর বিদ্যৎ প্রসারের জন্য অর্থায়ন ও কারিগরী সহযোগিতা দিয়ে আসছে। ১৫টি অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ঋণের আওতায় এখন পর্যন্ত সাড়ে চার লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করেছে ইডকল। ২০১২ সালের মধ্যে ১০ লক্ষ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনের লক্ষ্য আছে তাদের।

বিচ্ছিন্ন, দুর্গম এবং অবহেলিত গ্রামীণ জনপদের অর্থনীতি ও জীবনমানে ইডকলের সৌরশক্তি বড়ো ধরনের আর্থ সামাজিক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। আবাসিক এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য স্থাপন করা এসব প্যানেল বদলে দিয়েছে বিদ্যুৎ বঞ্চিত গ্রামীণ জনপদের চেহারা। ইডকল অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক সাহায্য এবং সহজ শর্তে বা কম সুদে ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানগুলোর কারিগরি দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ, প্রচার প্রচারণার ব্যবস্থাও করে ইডকল। কৃষির বিকাশে সৌর বিদ্যুতে সেচ পাম্প চালানো ইডকলের আর একটি সাফল্য।

নওগাঁর সাপাহারে স্থাপন করা ১১.২ কিলোওয়াটের একটি সেচ পাম্প প্রতিদিন প্রায় আড়াই লাখ লিটার পানি সেচ করতে পারে। প্রকল্পের কাজ পুরো শেষ হলে এর মধ্যেমে ৩ মৌসুমে ৩ হেক্টর করে জমির সেচ কাজ করা সম্ভব হবে। ইডকলের আর একটি সেচ পাম্প স্থাপন করা হচ্ছে যশোরের বানিয়ালিতে। এর মাধ্যমে সাড়ে ২২ হেকটর জমিতে সেচসুবিধা দেয়া সম্ভব হবে। ইডকলের গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, এসব সেচ পাম্প প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সেচ বাবদ খরচ হওয়া বছরে ৮ হাজার লিটার ডিজেলের সাশ্রয় হবে।

সাম্প্রতিক সময়ে ইডকলের সবচেয়ে বড় উদ্যোগ ১০০ কিলোটওয়াট মাইক্রো গ্রিড বিদ্যুৎ প্রকল্প। চারটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার একটি কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে। সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে একটি এলাকাকে আলোকিত করতে নেয়া হয়েছে এই উদ্যোগ। বিদ্যুৎ উৎপাদনে চাহিদা এবং তার সাথে পাল্লা দিতে না পারায় ক্রমবর্ধমান ঘাটতিতে দেশ যখন ভয়াবহ সংকটে তখন সৌর বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তার দিকটি আলোচিত হচ্ছে জোরেশোরে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে স্থাপন করা হয়েছে সৌর বিদ্যুতের প্যানেল।

সম্প্রতি নিজেদের ছাদে দেশের সবচেয়ে বড় সৌর প্যানেল স্থাপন করে চমক দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশ্বের বড় বড় কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও যা নেই, এবার সূর্যের আলোয় নিজেরা আলোকিত হয়ে তা করে দেখিয়েছে তারা। কেবল গ্রামাঞ্চল বা বিচ্ছিন্ন জনপদ নয়, খোদ রাজধানীতে সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার উৎসাহিত করতে দেশের সবচেয়ে বড় সোলার প্যানেল স্থাপন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সারা বিশ্বে কোন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এই প্রথম এধরনের উদ্যোগ নেয়া হলো। এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সারা দেশে জানিয়ে দিচ্ছে, কিভাবে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা যায়, পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণ বন্ধ করে পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধ থাকা যায়।

সর্বত্র বলা হচ্ছে সৌরবিদ্যুতের জয় গাঁথা। কিন্তু এই পদ্ধতির সীমাবদ্ধতাও কম নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো ঘর গৃহস্থালীর কিছুটা সংকট লাঘব করে মাত্র এই সৌর শক্তির প্লান্ট গুলো। তার উপর সৌরশক্তির বিদ্যুত প্লান্ট এর দাম গত কয়েক বছরে কিছুটা কমলেও এখনও তা সাধারণের নাগালের বাইরে, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় এটা ব্যবহার করাও ব্যয় সাধ্য। ঘরে স্থাপন করার মত একটি সোলার প্যানেলের মূল্য ৪০,০০০ থেকে ৭০,০০০টাকারও উপরে।

এসব সোলার প্যানেলের সবগুলোই বিদেশ থেকে আমদানী করা। যা দেশে উৎপাদন করা গেলে খরচ কিছুটা হ্রাস করা যেত। নবায়নযোগ্য জ্বালানীর দিকে ঝুঁকতে হবে আমাদের,কিন্তু তার মানে এই নয় যে সোলার এনার্জীই বিদ্যুতের বিকল্প হয়ে দাড়াতে পারবে। নবায়নযোগ্য শক্তি হিসেবে সৌর শক্তির কথা বলা হলেও আসলে বাংলাদেশ কেন বিশ্বের কোন দেশের প্রেক্ষাপটেই সৌর শক্তি বিদ্যুতের বিকল্প হতে পারে না। হতে পারে সাময়িক সংকট মেটানোর সহায়ক উপকরণ, যা সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে।

নবায়নযোগ্য শক্তি হিসেবে সৌর শক্তির ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ অবশ্যই ভাল। তবে তা এখনও বিদ্যুতের এক মাত্র বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করার মত অবস্থায় নয়। সৌর শক্তি থেকে বিদ্যুত পাওয়ার জন্য দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নেয়া যেতে পারে। একথা সত্যি যে, আমাদের দেশে সৌরবিদ্যুতের প্রসার ঘটেছে, কিন্তু যে দেশের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে বাস করে আর সম্পদের ৯০% যখন ১০% মানুষের হাতে বন্দি সে দেশে যেকোন রকমের উদ্যোগ রাষ্ট্রীয়ভাবেই নিতে হবে, আর তা বাস্তবায়ন করতে হবে দেশের আপামর জন সাধারনের সামর্থের কথা ভেবেই। বিদ্যুত সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য দেশের সব বিদ্যুত কেন্দ্র এবং কয়লা ও গ্যাস ক্ষেত্রের কর্তৃত্ব সরকারের হাতে নেয়া উচিত।

সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে দেশের জ্বালানী খাতকে এখনও উদ্ধার করা না গেলে জ্বালানী খাত নিয়ে আরো ভয়াবহ সংকটে পড়তে হতে পারে। দেশের জ্বালানী সংকট মেটাতে এখনই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে সরকারকে। আর তার ব্যতয় হলে, টিকে থাকার তাগিদে জনগণ তাদের ন্যায্য দাবী আদায়ে বার বার রাজপথে আসবেই। । মূল লেখা মঙ্গলধ্বনি'তে
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.