আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভ্রমণ---- পশ্চিম বঙ্গের শিলিগুড়ি, দার্ঝিলিং এবং জলপাইগুড়ি



ঘুরে এলাম প্রতিবেশী দেশ ভারত। অনেক দিনের লালিত স্বপ্ন ছিল; একদিন ভারত সফর করবো। প্রতিবন্ধকতা ছিল অনেক। সময়-সুযোগ আর আর্থিক গুছগাছ ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতার জাল ভেদ করে এই তো সম্প্রতি ঘুরে এলাম পশ্চিম বঙ্গ। বাংলাদেশের উত্তর বঙ্গের বুড়িমারি (লালমনির হাট) বর্ডার দিয়ে ভারতের চেংরাবান্ধা চেকপোস্ট হয়ে ময়নাগুড়ি এলাম।

ভারতের পশ্চিম বঙ্গে রয়েছে ১৬টি জেলা, অল্প কয়েকদিনের সংক্ষিপ্ত সফরে মাত্র ৩টি জেলা ঘুরে দেখার সুযোগ মেলে। জলপাইগুড়ি, কোচবিহার আর দার্জিলিং এই তিনটি জেলার কয়েকটি বিশেষ বিশেষ দর্শনস্থান ঘুরেছি মাত্র ৪/৫ দিনে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দার্জিলিং জেলার অন্তর্গত গরুবাথান পাহাড়ি এলাকা,ডামডিম চা বাগান। মালবাজার আসার পূর্বে বিশাল এক অরন্য পাড়ি দিয়ে আসতে হয়। অনেক বড় বনভূমি দেখতে পাওয়া যায় এই এলাকায় জুড়ে।

শাল আর সেগুন দাড়িয়ে আছে বহুদিন ধরে এই বনভুমিতে। দুপুরের তপ্তরোদ আমাদের গায়ে লাগেনি যখন বনের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া লম্বা রাস্তা পার হতেছিলাম। এই বিশাল জঙ্গলে কেউ নেই। মটর বাইকটা একটু থামাতেই নিস্তব্ধ জঙ্গলের ভেতর থেকে ভেসে আসে এক ভয়ংকর জীবযন্তুর আওয়াজ । মনে হচ্ছিল এই বুঝি নেকড়ে বাঘ এসে ঘাড় চেপে ধরে।

ভরদুপুরেও সূর্যের মুখ দেখতে পেলামনা। হিম শীতল বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে বনের ভেতর দিয়ে। উচু উচু গাছের ছায়ায় ঢেকে গেছে বিশাল বনবভূমি। সুউচ্চ শাল-সেগুনের এক বিশাল অভয়ারন্যের মধ্যে দিয়ে আমরা এগিয়ে চলি মালবাজারের দিকে। মালবাজারের পরেই পাহাড়ি রাস্তার শুরু।

আমাদের গন্তব্য গরুবাথান। গরুবাথান যেতে হয় ডামডিমের উপর দিয়ে। ডামডিমের সমতল ভুমিতে চা বাগান দেখতে পাওয়া যায়। এখানের মাটি এবং আবহাওয়া দুটোই চা গাছের জন্য অত্যন্ত উপযুগী। চা বাগানকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে চা শিল্প কারখানা।

বিশাল এক জনগোষ্ঠী এই চা শিল্পের সাথে জড়িত। নয়নাভিরাম সবুজ চা বাগান দেখতে দেথকে পৌছে গেলাম গরুবাথান পাহাড়ি অঞ্চলে। নয়নাভিরাম পাহাড়, মাঝ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নেওড়া নদী পাহাড়িদের জুম চাষ দেখতে পাওয়া যায় গরুবাথান পাহাড়ি এলাকায় পাহাড় থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ জল। পাহাড়ি আদিবাসিদের পানীয় জলের একমাত্র উতস পাহাড়ি এই ঝর্নার জল। নীল আকাশ সাদা মেঘ পাথর আর উচু সবুজ গাছ অপূর্ব দৃশ্য।

আমাদের কিছুতেই ফিরে আসতে মন চায়নি গরুবাথান পাহাড়ি অঞ্চল থেকে। প্রত্যন্ত পাহাড়ি দুর্গম এলাকাতেও দেখতে পেলাম শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। স্কুল ছুটির পর পাহাড়ি ছেলেমেয়েরা ঘরে ফিরছে। কথা বললাম এই মেয়েটির সাথে। ওরা বাংলা বলতে পারেনা।

হিন্দি আর ইংরেজি বুঝতে পারে। আশ্চর্য লাগলো ওরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা করে। গুডবাই গরুবাথান, যদিও মন চায়নি এই অপূর্ব স্বর্গপুরি ছেড়ে আসতে। এবার চলুন কোচবিহার। কোচবিহার সম্বন্ধে কিছু জানতে হলে প্রথমে কোচবিহার রাজবংশের পরিচয় জানা প্রয়োজন।

চন্দ্রবংশীয় হৈহয়ের পরবর্তী রাজা সহস্রার্জুন বংশীয় দ্বাদশ ক্ষত্রিয় কুমার পরশুরামের ভয়ে পূর্বক "মেচ" এই পরিচয়ে পরিচিত হয়ে রত্নপীঠের অন্তর্গত চিকনায় বাস করতে থাকেন, তাদের বংশজাত ক্ষত্রিয় কুমারদের মধ্যে সুমতি সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন। কোচবিহার রাজগণের বংশাবলী--- সুমতি, ভদ্রাজিত, ভদ্রশ্রব্য, বসুদাম, দমাম্বুর এবং হরিদাস। ১৯৪৯ খৃ. ১২ই সেপ্টেম্বর কোচবিহার রাজ্য ভারত ইউনিয়নের সংগে যুক্ত হয় এবং ১৯৫০ খৃ. ১ লা জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা রূপে পরিগণিত হয়। আধুনিক কোচবিহারের রূপকার মহারাজ নৃপেন্দ্র নারায়ণ (১৮৬৩ খৃঃ - ১৯১১ খৃঃ) মহারাজ নৃপেন্দ্র নারায়ণ তার অসাধারন ব্যক্তিত্ব, গঠনমূলক প্রতিভা, দেশ ও প্রজাদের প্রতি গভীর ভালবাসা এবং তীব্র ইচ্ছা শক্তির প্রভাবে কোচবিহারের নব রূপ প্রদানে সক্ষম হয়েছিলেন। কোচবিহারের রাজ বংশীয়দের মধ্যে ২১ জন মহারাজার ইতিহাস পাওয়া যায়।

এদের মধ্যে মহারাজ নৃপেন্দ্র নারায়ণ উল্লেখযোগ্য। রাজা নৃপেন্দ্র নারায়নের অসাধারন প্রচেষ্টায় বিজ্ঞান সম্মত আধুনিক শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, পরিবহণ, রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছিল। কোচবিহারে অবস্থিত বর্তমান রাজপ্রাসাদটি ১৮৭২ খৃঃ ৬ই আগস্ট স্থপতি ই.জে. মার্টিনের নকশা অনুমোদন হয়। প্রাসাদের নির্মান কাজ শেষ হয় ১৮৮৭ খৃ.। রাজপ্রাসাদটি রোম, ভেনিস ও ফ্লোরেন্সে প্রচলিত মূলত ইতালীর স্থাপত্যের বিভিন্ন শৈলীর সমম্বয়ে গঠিত।

বাস্তবিক ক্ষেত্রে বলা যায় রাজপ্রাসাদটি ইংল্যান্ডের বাকিংহাম রাজপ্রাসাদের অনুকরন। রাজ দরবারের একটি ছবি---- মধ্যে উপবিষ্ট মহারাণী ইন্দিরা দেবী তার ডান পাশে বড় পুত্র মহারাজ জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ন ও বাম পাশে ছোটপুত্র ইন্দ্রজিত নারায়ণ। দ্বিতল বিশিষ্ট রাজাপ্রাসাদটিতের নীচ তলায় রয়েছে দরবার কক্ষ, তোষাখানা, তোরণদ্বার সমেত চব্বিশটি কক্ষ এবং ছয়টি স্নানাগার। দোতলায় পনেরটি শয়ন কক্ষ, তিনটি বৈঠকখানা, একটি বিলিয়ার্ড কক্ষ, তোষাখানা চারটি, স্নানাগার এগারটি, মহিলাদের দেখবার জন্য গ্যালারি একটি ও তোরণদ্বার একটি। প্রসাদটি পোর্টল্যান্ড সিমেন্টে গাঁথা লাল ইট দিয়ে তৈরি।

এই প্রাসাদের দর্শনীয় এবং লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে লৌহ ধাতু নির্মিত গম্বুজ। এই গম্বুজটি দরবার কক্ষের উপর অবস্থিত। এর উচ্চতা ১২৪ ফুট ১০ ইঞ্চি। বহুদূর থেকে এই গম্বুজ দেখা যায়। এটি গোলাকার এবং খাঁজে খাঁজে কাঁচ দিয়ে আবৃত, এজন্য এর ভিতর দিয়ে সূর্যের আলো এসে দরবার কক্ষকে আলোকিত করে।

এবার চলুন অন্য কোথাও। জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত ময়নাগুড়ি উপশহরটিতে আনাগোনা ঘটে অত্র অঞ্চলের অনেক লোকজনের। ময়নাগুড়ি এসে দেখা হলো শতবর্ষ পুরোনো একটি গন্থাগার। নাম রাধিকা লাইব্রেরী। ১৯১০ সালে লাইব্রেরীটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

অনেক বিরল এবং পুরোনো বই-পুস্তক সংরক্ষিত আছে এই লাইব্রেরিটিতে। পুরোনো এই লাইব্রেরিটি ছিল অত্র অঞ্চলের একটি স্বনাম ধন্য বিদ্যা চর্চার স্থান। এখানে রয়েছে কয়েক হাজার বিরল বইয়ের সম্ভার। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে লাইব্রেরিটি পেতে পারে তার পুরোনো ঐতিহ্য। বই পড়ে জ্ঞানার্জন হয় আধুনিক জেনারেশন কথাটি ভুলেই গেছে।

কথাগুলো জানতে পাই রাধিকা লাইব্রেরির কর্তব্যরত ব্যক্তিদের কাছ থেকে। এবার আপনাদের নিয়ে যাবো দার্জিলিং জেলার অন্তর্গত সেভকে। সেভক যেতে হলে শিলিগুড়ি হয়ে যেতে হবে। শিলিগুড়ি থেকে সেভকের দূরত্ব প্রায় ২০ কি.মি. । দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা।

পাহাড়ের উপর দিয়ে আঁকাবাঁকা পিচঢালা পথ। রাস্তার ডান পাশেই গহীন পাহাড়ী ঢাল। সেভক পৌছে গেলাম। ওয়াও ! কি অপূর্ব চিত্রপট ! মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলছে দুটি পাহাড়। পাহাড়ী সবুজ বনো উচু গাছ মেঘের সাথে পেতেছে মিতালী সেভকের এই স্পটটি পর্যটকদের ভীড় জমে বিশেষ করে এই বর্ষা মৌসুমে বেশি।

দুই পাহারের মাঝে ঝুলছে সুন্দর একটি ব্রীজ। কল কল করে বয়ে যাচ্ছে নদী। হিম শীতল নদীর জল। উজানে রয়েছে সিকিম। সিকিমের পাহাড় থেকে বরফ গলা জলই এই নদী দিয়ে বয়ে যাচ্ছে।

ব্রীজের অপর প্রান্তে গিয়ে ধীরে ধীরে আমরা নেমে এলাম নদীর তীরে। বড় বড় পাথর রয়েছে নদীর তীরে। অপূর্ব দেখতে মসৃন পাথরগুলো। সুউচ্চ পাহাড় আর নদীর স্বগর্জন কি অসম্ভব সৌন্দয্য লুকিয়ে আছে এই খানে। পৃথিবীর সব সুখ একসাথে ধরা দেয় দুহাত ভরে।

ভ্রমনের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয় প্রাকৃতিক নৈস্বর্গ। পাহাড়ের মতো উদার হয়ে উঠে দেহমন। সংক্ষিপ্ত ভ্রমন কাহিনীটুকু আপনাদের সাথে শেয়ার করতে পেরে খুব ভাল লাগছে। আপনাদের মন্তব্য জানাবেন। ধন্যবাদ সবাইকে।

টিকা--- ১। রাজপ্রাসাদের তথ্য ও ছবিঃ কোচবিহার রাজবংশাবলী ও বর্তমান রাজপ্রাসাদ, লেখক-হিমাদ্রি শঙ্কর ভট্টাচার্য ২। কৃতজ্ঞতা প্রকাশঃ অমিত সরকার, শীতল চন্দ্র সরকার এবং সুজন মল্লিক।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।