আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উপবৃত্তি এবং ক্ষুদ্রঋণ- আমরা কোন পথে যাচ্ছি।

যে জানেনা এবং জানে যে সে জানেনা সে সরল, তাকে শেখাও। যে জানেনা এবং জানেনা যে সে জানে না, সে বোকা-তাকে পরিত্যাগ কর।

আজকের এই লেখাটি দৈনিক প্রথম আলোর দুইটি রিপোর্টের শিরোনাম দিয়ে শুরু করি। ৪ আগস্ট ২০১০, বুধবারের প্রথম আলোর শেষ পৃষ্ঠায় ছাপানো রিপোর্টের শিরোনাম "ঝরে পড়া ও ফেল বিবেচনায় বিনিয়োগে সফলতা কম" এবং ৫ আগস্ট ২০১০, বৃহস্পতিবারের প্রথম আলোর ১৫ নং পৃষ্ঠায় ছাপানো রিপোর্টের শিরোনাম "ক্ষুদ্রঋণের ব্যাপক প্রসার হলেও দারিদ্র্য বিমোচন সন্তোষজনক নয়"। আপাত দৃষ্টিতে শিরোনাম দুইটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এবং দুই ধরনের সংবাদে পুষ্ট।

প্রথম রিপোর্টটি বিশ্লেষণ করলে যে ঘটনা বের হয়ে আসে তার সারমর্ম হচ্ছে দেশব্যাপী ছাত্রী উপবৃত্তি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে যাচ্ছে এবং দ্বিতীয় রিপোর্টটি থেকে আমরা জানতে পারি বাংলাদেশে ব্যাপক প্রসারিত ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্য বিমোচনে তেমন কার্যকরী কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি। দুটি সংবাদই আপাতত আমাদের জন্য অশনি সংকেত। এবার আসি শিরোনাম দুইটির বিশ্লেষণে। ১৯৯৩ সাল থেকে নারী শিক্ষার প্রসারকল্পে মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রীদের উপবৃত্তি কর্মসূচি চালু করা হয়। তারপর পর্যায়ক্রমে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়েও ২০০২ সাল থেকে ছাত্রী উপবৃত্তি কর্মসূচি চালু করা হয়েছে।

এই প্রকল্পগুলোতে এ পর্যন্ত প্রায় কয়েকশত কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু ফলাফল হতাশাব্যঞ্জক। আর ক্ষুদ্রঋণের বিষয়টি এদেশে জেঁকে বসেছে যেদিন থেকে এনজিওগুলো কাজ শুরু করেছে সেদিন থেকেই। এনজিওগুলোর বার্ষিক প্রতিবেদন দেখলে মনে হয় ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে এরা দেশে একটা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে। দারিদ্র্যকে যাদুঘরে নিয়ে যেতে আর বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না।

কিন্তু সরকারি এবং বেসরকারি এই দুইটি প্রচেষ্টা যে আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থাকে দিন দিন পঙ্গু করে দিচ্ছে তা বোধহয় আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) জরিপ পরিচালনা করে দেখেছে যে উপবৃত্তি কার্যক্রমের ফলে স্কুলগুলোতে মেয়েদের উপস্থিতির হার বেড়েছে। কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান বাড়েনি। এর কারণ খতিয়ে দেখতে আইএমইডি কাজ করে যাচ্ছে। উপবৃত্তি কর্মসূচি চালুর ফলে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেয়ে ও ছেলেদের ভর্তির অনুপাত দাঁড়িয়েছে ৫৩ : ৪৭।

অর্থাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের ভর্তির হার ছেলেদের তুলনায় বেড়েছে। সরকারের সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী ছাত্রীদের ঝরে পড়া ও অকৃতকার্য হওয়ার হার বিবেচনায় নিলে উপবৃত্তি কর্মসূচিতে বিনিয়োগ বহুলাংশে সফল হচ্ছে না। আর ক্ষুদ্রঋণের ব্যাপক প্রসার ঘটলেও দারিদ্র্য বিমোচনে তা কার্যকর কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। অর্থমন্ত্রীর মতে, দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ এখনো দারিদ্র্য সীমার নিচে। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচিতে বড় ধরনের কোন সমস্যার কারণে পরিসংখ্যান ও বাস্তবতার মধ্যে বিস্তর ফারাক বলে অর্থমন্ত্রীর অভিমত।

ছাত্রী উপবৃত্তি কর্মসূচি সরকারের একটি বিরাট অপচয় বলে আমি মনে করি। দরিদ্র ছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদানের ধারণা প্রবর্তন করা হয়েছিল এই কারণে যে, ছাত্রীরা ব্যাপক হারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবে। এতে করে নারী শিক্ষার হার বাড়বে, বাল্য বিবাহ রোধ হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু মাধ্যমিক পর্যায়ে ব্যাপকহারে ছাত্রীদের অকৃতকার্য হওয়ার হার দেখে মনে হয় এ উদ্দেশ্য সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। আমি এখানে কয়েকটি পয়েন্ট তুলে ধরছি কি কারণে এই উপবৃত্তি কর্মসূচি ব্যর্থ হয়েছে- ১. উপবৃত্তি পাওয়ার লোভে ছাত্রীরা স্কুল কলেজে ভর্তি হয় ঠিকই কিন্তু উপবৃত্তি বিতরণের দিন ব্যতিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তেমন একটা আসে না।

২. উপবৃত্তির দায়িত্বপ্রাপ্ত অসাধু শিক্ষকরা শুধু অর্থের লোভে ছাত্রীদের ব্যাপকহারে উপস্থিতি দেখায় কিন্তু তাদের মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের বিষয়ে আগ্রহী হয় না। ৩. বই ক্রয়, পরীক্ষার ফি ইত্যাদি বাবদ যে অর্থ প্রদান করা হয় তাতে একজন শিক্ষার্থীর ন্যূনতম শিক্ষার ব্যয় মিটানো কোনোক্রমেই সম্ভব হয় না। তাই উপবৃত্তি প্রাপ্ত এই সামান্য অর্থ শিক্ষার্থীরা তাদের তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটাতেই ব্যয় করে ফেলে। ৪. মাঠ পর্যায়ে উপবৃত্তি বিতরণের দায়িত্বপ্রাপ্ত মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, ব্যাংক কর্মকর্তা এবং প্রতিষ্ঠান প্রধান উপবৃত্তি নামক এই অর্থের সিংহভাগ নিজের পকেটস্থ করতে তৎপর থাকে। উপবৃত্তির প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনের দিকে তাদের কোন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না।

৫. ক্রমবর্ধমান শিক্ষা ব্যয়ের ঘাটতি পোষাতে এই উপবৃত্তি সিন্ধুতে বিন্দু সম। তাই অভিভাবকরা শুধু এই সামান্য অর্থ পাওয়ার জন্য সন্তানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে উৎসাহী হয় না। এবার ক্ষুদ্রঋণ বিষয়টির দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক। ক্ষুদ্রঋণের উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজের দরিদ্র শ্রেণীকে আত্মকর্মসংস্থানে উদ্বুদ্ধ করা। ছোট ছোট ঋণ নিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ছোট ছোট ব্যবসায় স্থাপন করবে।

তার লাভ থেকে কিস্তিতে কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করবে। কিন্তু একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য এই ঋণ কোনভাবেই সুফল বয়ে আনতে পারছে না। আমার মতে এই ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি ব্যর্থ হওয়ার কারণ নিম্নরূপ- ১. যারা এই ঋণ নেয় তারা এতই দরিদ্র যে এই ঋণের অর্থ দিয়ে তাদের তাৎক্ষণিক কোন প্রয়োজন মেটানোর জন্যই তা ব্যয় করে ফেলে। ২. ঋণের কিস্তি পরিশোধ করার সময় আসলে তারা আবার অন্য কোন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে কিস্তি পরিশোধ করে। এভাবে এই জনগোষ্ঠী ক্রমান্বয়ে ঋণের দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খেতে খেতে ৫/৭ টি এনজিওর কাছে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

৩. গ্রামে গ্রামে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে বিভিন্ন এনজিও ঋণ প্রদানের জন্য একেবারে মুখিয়ে থাকে। ঋণ প্রদানের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে তারা তেমন কার্যকরী কোন ভূমিকা পালন করে না। ফলে যে কোন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে এই ঋণ তেমন কার্যকরী হয় না। ৪. ঋণের পরিমাণ এতই অল্প হয় যে তা সৃজনশীল কোন উদ্যোক্তার প্রয়োজন মেটাতে পারে না। ফলে ব্যবসায় শুরু করতেই পুঁজি শেষ হয়ে যায়।

এবার আসি আমার আসল বক্তব্যে। ছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদান আমার কাছে একটি খয়রাতি সাহায্য বলেই মনে হয়। এই শত কোটি টাকা অপচয় না করে এই অর্থটুকু পরিকল্পিতভাবে কর্মসংস্থানমূলক শিক্ষায় ব্যয় করা উচিত। আমাদের দেশে অনেক মেয়ে শিক্ষার্থী আছে যারা হাতের কাজে পারদর্শী। লোকাল কারিকুলাম প্রণয়ন করে এই শিক্ষার্থীদের পেছনে পরিকল্পিতভাবে এই অর্থ ব্যয় করলে অনেক সুফল পাওয়া যাবে।

এ ব্যাপারে আমার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা মঙ্গলধ্বনিতে প্রকাশিত হয়েছে। কর্মসংস্থানমূলক শিক্ষা আর এনজিওগুলোর ধান্ধাবাজির ব্যাপারে লিখতে গেলে লেখাটি অনেক বড় হয়ে যাবে। অবশ্য সব এনজিওর ব্যাপারে আমি এই ঢালাও মন্তব্য করছি না। এখন একটা ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে কিছু না করতে পারলে এনজিও প্রতিষ্ঠা কর। এনজিও গড়ে তোলে বিদেশ থেকে সাহায্য এনে সেই অর্থ কি করা হয় তা আমার চেয়ে আপনারাই ভাল জানেন।

দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অর্থ সাহায্যের নামে এনজিওগুলোর এই অপতৎপরতা যারা বন্ধ করবে তারাই এগুলো থেকে সুবিধা নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। আর এনজিওর ছত্রছায়ায় ক্ষুদ্রঋণ নামের একটি বিষফোঁড়া সমাজে দিন দিন স্ফীত থেকে স্ফীততর হচ্ছে। দরিদ্র জনগণ এই ক্ষুদ্রঋণের যাঁতাকলে পড়ে কিভাবে নিষ্পেষিত হচ্ছে তা পত্র পত্রিকায় চোখ বুলালেই টের পাওয়া যায়। এনজিওগুলোর কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। পরিশেষে প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এই দুইটি শিরোনামের এই লেখাটির মূল্যায়ন করতে চাই আমি এভাবে- ১. উপবৃত্তি নামক এই খয়রাতি সাহায্য অবিলম্বে বন্ধ করে কর্মসংস্থানমূলক শিক্ষায় বিনিয়োগ সম্প্রসারিত করা হোক।

২. ক্ষুদ্রঋণ নামক দরিদ্র শোষণের এই প্রক্রিয়াটিকে বন্ধ করে দিয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানে উদ্বুদ্ধ করা হোক।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।