জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান, সাবেক ফল রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও জাতীয় পার্টি
স্মৃতিতে আমার কারমাইকেল----হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ
কারমাইকেল আমার স্মৃতিতে মেশানো এক অমলিন অধ্যায়। আমার রংপুরের জীবন্ত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বার কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। এই কলেজে কেটে গেছে আমার শিক্ষা জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময়। জীবনের সেই শ্রেষ্ঠ সময়ে এই কারমাইকেল কলেজে আমার অতিবাহিত হয়েছে চারটি বছর। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০।
এই আমার কারমাইকেল জীবন।
এখানে বসে দেখেছি প্রায় দু’শ বছরের পরাধীনতার গ্লানি অবসানের দৃশ্য। আবার দেখেছি পূর্ব দিগন্তে নতুন সূর্য উঠার রক্তিম আভা। এই কারমাইকেল দিয়েছে আমাকে জীবনের সর্বোচ্চ শেখড়ে উঠার সোপান গড়ে। এই কারমাইকেল দিয়েছে দেশকে একজন রাষ্ট্রপতি উপহার।
তারই সিঁড়ি বেয়ে এসেছে রংপুরে তথা গোটা উত্তরবঙ্গে উন্নয়নের জোয়ার, যমুনার উপর সেতু নির্মানের সুচনা থেকে শুরু করে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন। “হাকাও গাড়ি চিলমারী বন্দর”- বলে এখন আর কান্ত গাড়িয়ালের নুহ্য দেহের ঘাম ঝরার দৃশ্য দেখতে হয় না। সে যুগের চার দিনের পথ অতিক্রম করতে এখন আর চার ঘন্টা সময়ও লাগে না।
তখন গোটা ভারতবর্ষে আন্দোলনে টাল-মাটাল। এ দেশ থেকে বৃটিশদের পালাই-পালাই অবস্থা।
বৃটিশ খেদাও-এর পাশাপাশি “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান”- শ্লোগানে দেশের নানা অংশের মতো রংপুরও উত্তাল। সেই সময়ের মধ্যে কারমাইকেল কলেজে আমার ভর্তি হওয়া। বাবার কড়া শাসন, মায়ের সতর্ক পর্যবেক্ষণ আর আদর ভালবাসার মধ্য দিয়ে কেটেছে আমার স্কুল জীবন।
কলেজ জীবনে এসে পেলাম জীবনের অন্যরকম স্বাদ। অনেকটা স্বাধীন জীবনের মতো।
বাড়ি থেকে প্রায় তিন মাইল হেঁটে যেতাম কলেজে। তারপর ঠিক হলো- কলেজের হোষ্টেলে থাকতে হবে আমাকে। কারণ বাড়িতে থাকার জায়গাও ছিলো না। অনেক ভাই-বোনসহ বড় পরিবারের মধ্যে আমার পড়াশুনার ব্যাঘাত ঘটতে পারে ভেবে বাবা আমাকে হোষ্টেলে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। মায়ের আঁচল ছেড়ে আলাদা থাকতে হবে- ভাবতেই মনটা হু-হু করে কেঁদে ওঠেছিলো।
মাও সহজে মেনে নিতে পারছিলেন না- আমি তাকে রেখে দুরে থাকবো। তথাপিও জীবন গড়ার অভিলাশে বাবার ইচ্ছায় যেতে হলো কারমাইকেলের ক্যাম্পাসে। শুরু হলো এখান থেকে আমার বিকাশের যাত্রা। অনেক দিনের কথা। সব মনে পড়েনা।
কখন প্রথম কবিতা লিখেছিলাম- সে স্মৃতিও এখন মলিন। যেমন করে কোনো সন্তানের মুখে কখন প্রথম মা ডাকটি উচ্চারিত হয়- তার দিন-ক্ষণ কারো মনে থাকেনা। তেমনি আমার কবিতাও। স্কুল জীবনেই শব্দে-বর্ণে-ছন্দের মিলন ঘটিয়ে ছোট ছোট ছড়া লিখতে লিখতে কবিতা লেখার হাতেখড়ি নিয়েছিলাম। কারমাইকেল কলেজে ঢোকার পর ঘটলো তার বিকাশ।
কৈশোরের চর্চা কাজে লাগলো এখানে। ফলে কলেজে ঢুকেই আমি হয়ে গেলাম সাহিত্য সম্পাদক। যে চার বছর কারমাইকেল কলেজে ছিলাম তার পুরোটা সময় সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে কলেজ ম্যাগাজিনগুলো আমিই প্রকাশ করতাম। শুধু সম্পাদনাই নয়- আমার প্রচুর লেখা থাকতো সেই ম্যাগাজিনে। সম্পাদকীয় বাদেও থাকতো আমার কবিতাগুচ্ছ।
তখনকার প্রকাশনা এখনকার মতো এমন সহজ ছিলনা। রংপুর শহরের মধ্যে তখন হাতে গোনা ছোট ধরনের দু/তিনটা প্রেস ছিলো। সিসার উল্টো অক্ষরগুলো সাজিয়ে এবং কাঠে খোদাই করা হরফে ছাপার কাজ করতে হতো। সে সব ছাপার মেসিন এখন পুরাতন ঐতিহ্যের স্মৃতিবহন করে আছে। কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয় যে, কলেজ জীবনে আমার সম্পাদিত সেই ম্যাগাজিনের একটি কপিও আমার সংগ্রহে নেই।
কলেজের সংরক্ষণ ভান্ডারে আছে কিনা তাও জানিনা।
কারমাইকেলে ভর্তি হয়ে আমি উঠেছিলাম সিএম হোষ্টেলের বিল্ডিং ব্লকে। তারপর কলেজ ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবে জিএল হোষ্টেলে সিঙ্গেল সিটের একটা কক্ষ বরাদ্দ পেলাম। মনে আছে, সেই করে নম্বর ছিলো ২১২। আমি মনিটরও ছিলাম ওই হোষ্টেলের।
মনে পড়ে, সেটাই ছিলো কোনো ব্যবস্থাপনা কাজে আমার প্রথম দায়িত্ব। তখন হোষ্টেলে কোনো বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ছিলো না। হেরিকেনের আলোতে আমাদের পড়াশুনা করতে হ’তো। কেরেসিনের স্টোভে সকালের নাস্তা করে খেতে হ’তো। রুটি বানানো, ডিম সিদ্ধ কিংবা অমলেট সবই নিজের হাতে করতাম।
তবে হাজার চেষ্টা করেও রুটি গোল বানাতে পারতাম না।
স্টোভ জ্বালানো নিয়ে মায়ের সাবধান বানীর শেষ ছিলো না। জ্বালাতে গিয়ে যেনো হাত পুড়ে না ফেলি। ঠিক মতো যেনো খাওয়া দাওয়া করি, আরো কত কি সতর্কবানী। আজ মনে হয়, কী যে সুবর্ন সময় পিছনে ফেলে এসেছি- তখন যেনো অনুভবও করতে পারিনি।
সেই কারমাইকেলের ক্যাম্পাসেও আজ আর আমি নেই- মায়ের সতর্ক বানীও শুনতে পাইনা।
সেদিন মনে হতো- মা অযথাই আমাকে সব কিছুতে আগে থেকে সাবধানতার কথা শুনায়। আমি কি এখন আর সেই ছোট্ট খোকাটি আছি! আজ মনে হয়- মায়ের সকর্ততা আর অভয় বানীর চেয়ে জীবনে বড় পাওয়ার আর কিছু নেই।
কলেজ জীবনে লেখাপড়ার পাশাপাশি সাহিত্য চর্চায় মন থাকলেও ক্রীড়া ক্ষেত্রেও আমার ছিলো সমান পদচারনা। কারমাইকেল কলেজে চার বছরের প্রতিবারেই আমি হয়েছি ক্রীড়া চ্যাম্পিয়ন।
এই সাফল্য আমি পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সৈনিক জীবনেও অক্ষুন্ন রাখতে পেরেছি। কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আমি ১০০ মিটার দৌড়, হার্ডেলস, হপষ্টেপ জাম্প, হাই জাম্প ও লং জাম্পে অংশ গ্রহন করতাম। এর প্রত্যেক ইভেন্টেই আমি প্রথম হতাম। ফলে প্রতি বছর আমিই কলেজ ক্রীড়া চ্যাম্পিয়ন। এ ছাড়া ফুটবল দলে তো অধিনায়ক হিসেবে থাকতামই।
কলেজ জীবনে সাহিত্য ও ক্রীড়া ক্ষেত্রের সাফল্য নিয়েই আমি ব্যস্ত থাকতাম না। আমার প্রধান লক্ষ্য ছিলো লেখা পড়ায় আমাকে ভালো করতেই হবে। আই. এ. পরীক্ষায় আমি কলেজের মধ্যে প্রথম হয়েছিলাম। তার জন্য আমি বৃত্তিও পেয়েছি। সে সময় আমার মাসিক বৃত্তি ছিলো ১২ টাকা।
এই টাকার মূল্য ছিলো অনেক। আমার মাসিক লেখাপড়া ও খাওয়া খরচ চলে যেতো বৃত্তির টাকায়। আমার আই. এ. পরীক্ষার বছরে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন তো গোটা ভারতবর্ষ জুড়েই ছিলো বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। রংপুরেও সেই আন্দোলন পিছনে পড়ে ছিলোনা।
মাঝে মধ্যে “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান”- স্লোগান মুখে নিয়ে আমিও মিছিলে নেমে যেতাম।
তবে রাজনীতি তখন আমার মধ্যে কোনো প্রভাব বিস্তার করেনি। আমি লেখা-পড়া- খেলাধুলা আর সাহিত্য-চর্চা নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। আমরা তখন এক নতুন নামের দেশের নাগরিক হয়ে গেছি। নতুন আশা, নতুন চেতনায় এ দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী তখন বুক বেঁধে দাঁড়িয়েছিলো।
আমিও তখন সেই চেতনায় উজ্জিবীত। নিজেকে দেশের একান্ত প্রয়োজনীয় নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার সংগ্রামে অবতীর্ণ হলাম। পড়াশোনায় আরো মনোযোগী হয়ে গেলাম। ফলে ১৯৫০ সালে আমি কৃতিত্বের সাথে বিএ পাশ করলাম। আনন্দাশ্রু চোখে নিয়ে বিদায় জানাতে হলো- অমলিন স্মৃতি বিজরিত কারমাইকেল কলেজকে।
আমার জীবনের গতিধারায় বাঁকে বাঁকে পরিবর্তন হয়েছে। কারমাইকেল থেকে বিদায় নিয়ে ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুরু জীবনের নতুন অধ্যায়। সেই জীবনের কথা আজ এখানে আর নয়। স্মৃতিপটে এখন কারমাইকেল কলেজ।
মনে পড়লেই নষ্টালজিয়া হয়ে যাই। এই কারমাইকেল আমার কাছে এমন এক স্মৃতির পাদপীট- যেখানে দাঁড়িয়ে আমি দেখতে পাই আমার সুবর্ন অতীতকে। এই স্মৃতি মিশে আছে আমার হৃদয়ে, অন্তরের অন্তঃস্থলে, জড়িয়ে আছে সকল অঙ্গে। কারমাইকেলকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবী উঠেছিলো। আমার দাবীটি ছিলো রংপুরের ঐতিহ্য কারমাইকেল কলেজের অবস্থান ঠিক রেখে রংপুরে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় দিতে হবে।
আশার কথা যে, রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হচ্ছে। কারমাইকেল কলেজ টিকে থাকবে যুগ-যুগ থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। কারমাইকেল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগ চালু করা উচিত। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সম্মান চালু করা হয়নি। এটাও অবিলম্বে চালু করা উচিত বলে মনে করি।
আমার প্রত্যাশা, এই বিদ্যাপীট থেকে বেরিয়ে আসবে জাতীয় পরিমণ্ডল হতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যশ-খ্যাতি ছড়িয়ে দেয়া সন্তানেরা। আজ এই ক্ষণে কারমাইকেল কলেজের স্মৃতি মন্থন করে মনে হলো- অজান্তেই যেনো মিশে গেছি কলেজ ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের মাঝে।
কারমাইকেল আমার স্মৃতিতে মেশানো এক অমলিন অধ্যায়। আমার রংপুরের জীবন্ত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বার কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। এই কলেজে কেটে গেছে আমার শিক্ষা জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময়।
জীবনের সেই শ্রেষ্ঠ সময়ে এই কারমাইকেল কলেজে আমার অতিবাহিত হয়েছে চারটি বছর। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০। এই আমার কারমাইকেল জীবন।
এখানে বসে দেখেছি প্রায় দু’শ বছরের পরাধীনতার গ্লানি অবসানের দৃশ্য। আবার দেখেছি পূর্ব দিগন্তে নতুন সূর্য উঠার রক্তিম আভা।
এই কারমাইকেল দিয়েছে আমাকে জীবনের সর্বোচ্চ শেখড়ে উঠার সোপান গড়ে। এই কারমাইকেল দিয়েছে দেশকে একজন রাষ্ট্রপতি উপহার। তারই সিঁড়ি বেয়ে এসেছে রংপুরে তথা গোটা উত্তরবঙ্গে উন্নয়নের জোয়ার, যমুনার উপর সেতু নির্মানের সুচনা থেকে শুরু করে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন। “হাকাও গাড়ি চিলমারী বন্দর”- বলে এখন আর কান্ত গাড়িয়ালের নুহ্য দেহের ঘাম ঝরার দৃশ্য দেখতে হয় না। সে যুগের চার দিনের পথ অতিক্রম করতে এখন আর চার ঘন্টা সময়ও লাগে না।
তখন গোটা ভারতবর্ষে আন্দোলনে টাল-মাটাল। এ দেশ থেকে বৃটিশদের পালাই-পালাই অবস্থা। বৃটিশ খেদাও-এর পাশাপাশি “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান”- শ্লোগানে দেশের নানা অংশের মতো রংপুরও উত্তাল। সেই সময়ের মধ্যে কারমাইকেল কলেজে আমার ভর্তি হওয়া। বাবার কড়া শাসন, মায়ের সতর্ক পর্যবেক্ষণ আর আদর ভালবাসার মধ্য দিয়ে কেটেছে আমার স্কুল জীবন।
কলেজ জীবনে এসে পেলাম জীবনের অন্যরকম স্বাদ। অনেকটা স্বাধীন জীবনের মতো। বাড়ি থেকে প্রায় তিন মাইল হেঁটে যেতাম কলেজে। তারপর ঠিক হলো- কলেজের হোষ্টেলে থাকতে হবে আমাকে। কারণ বাড়িতে থাকার জায়গাও ছিলো না।
অনেক ভাই-বোনসহ বড় পরিবারের মধ্যে আমার পড়াশুনার ব্যাঘাত ঘটতে পারে ভেবে বাবা আমাকে হোষ্টেলে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। মায়ের আঁচল ছেড়ে আলাদা থাকতে হবে- ভাবতেই মনটা হু-হু করে কেঁদে ওঠেছিলো। মাও সহজে মেনে নিতে পারছিলেন না- আমি তাকে রেখে দুরে থাকবো। তথাপিও জীবন গড়ার অভিলাশে বাবার ইচ্ছায় যেতে হলো কারমাইকেলের ক্যাম্পাসে। শুরু হলো এখান থেকে আমার বিকাশের যাত্রা।
অনেক দিনের কথা। সব মনে পড়েনা। কখন প্রথম কবিতা লিখেছিলাম- সে স্মৃতিও এখন মলিন। যেমন করে কোনো সন্তানের মুখে কখন প্রথম মা ডাকটি উচ্চারিত হয়- তার দিন-ক্ষণ কারো মনে থাকেনা। তেমনি আমার কবিতাও।
স্কুল জীবনেই শব্দে-বর্ণে-ছন্দের মিলন ঘটিয়ে ছোট ছোট ছড়া লিখতে লিখতে কবিতা লেখার হাতেখড়ি নিয়েছিলাম। কারমাইকেল কলেজে ঢোকার পর ঘটলো তার বিকাশ। কৈশোরের চর্চা কাজে লাগলো এখানে। ফলে কলেজে ঢুকেই আমি হয়ে গেলাম সাহিত্য সম্পাদক। যে চার বছর কারমাইকেল কলেজে ছিলাম তার পুরোটা সময় সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে কলেজ ম্যাগাজিনগুলো আমিই প্রকাশ করতাম।
শুধু সম্পাদনাই নয়- আমার প্রচুর লেখা থাকতো সেই ম্যাগাজিনে। সম্পাদকীয় বাদেও থাকতো আমার কবিতাগুচ্ছ। তখনকার প্রকাশনা এখনকার মতো এমন সহজ ছিলনা। রংপুর শহরের মধ্যে তখন হাতে গোনা ছোট ধরনের দু/তিনটা প্রেস ছিলো। সিসার উল্টো অক্ষরগুলো সাজিয়ে এবং কাঠে খোদাই করা হরফে ছাপার কাজ করতে হতো।
সে সব ছাপার মেসিন এখন পুরাতন ঐতিহ্যের স্মৃতিবহন করে আছে। কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয় যে, কলেজ জীবনে আমার সম্পাদিত সেই ম্যাগাজিনের একটি কপিও আমার সংগ্রহে নেই। কলেজের সংরক্ষণ ভান্ডারে আছে কিনা তাও জানিনা।
কারমাইকেলে ভর্তি হয়ে আমি উঠেছিলাম সিএম হোষ্টেলের বিল্ডিং ব্লকে। তারপর কলেজ ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবে জিএল হোষ্টেলে সিঙ্গেল সিটের একটা কক্ষ বরাদ্দ পেলাম।
মনে আছে, সেই করে নম্বর ছিলো ২১২। আমি মনিটরও ছিলাম ওই হোষ্টেলের। মনে পড়ে, সেটাই ছিলো কোনো ব্যবস্থাপনা কাজে আমার প্রথম দায়িত্ব। তখন হোষ্টেলে কোনো বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ছিলো না। হেরিকেনের আলোতে আমাদের পড়াশুনা করতে হ’তো।
কেরেসিনের স্টোভে সকালের নাস্তা করে খেতে হ’তো। রুটি বানানো, ডিম সিদ্ধ কিংবা অমলেট সবই নিজের হাতে করতাম। তবে হাজার চেষ্টা করেও রুটি গোল বানাতে পারতাম না।
স্টোভ জ্বালানো নিয়ে মায়ের সাবধান বানীর শেষ ছিলো না। জ্বালাতে গিয়ে যেনো হাত পুড়ে না ফেলি।
ঠিক মতো যেনো খাওয়া দাওয়া করি, আরো কত কি সতর্কবানী। আজ মনে হয়, কী যে সুবর্ন সময় পিছনে ফেলে এসেছি- তখন যেনো অনুভবও করতে পারিনি। সেই কারমাইকেলের ক্যাম্পাসেও আজ আর আমি নেই- মায়ের সতর্ক বানীও শুনতে পাইনা।
সেদিন মনে হতো- মা অযথাই আমাকে সব কিছুতে আগে থেকে সাবধানতার কথা শুনায়। আমি কি এখন আর সেই ছোট্ট খোকাটি আছি! আজ মনে হয়- মায়ের সকর্ততা আর অভয় বানীর চেয়ে জীবনে বড় পাওয়ার আর কিছু নেই।
কলেজ জীবনে লেখাপড়ার পাশাপাশি সাহিত্য চর্চায় মন থাকলেও ক্রীড়া ক্ষেত্রেও আমার ছিলো সমান পদচারনা। কারমাইকেল কলেজে চার বছরের প্রতিবারেই আমি হয়েছি ক্রীড়া চ্যাম্পিয়ন। এই সাফল্য আমি পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সৈনিক জীবনেও অক্ষুন্ন রাখতে পেরেছি। কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আমি ১০০ মিটার দৌড়, হার্ডেলস, হপষ্টেপ জাম্প, হাই জাম্প ও লং জাম্পে অংশ গ্রহন করতাম। এর প্রত্যেক ইভেন্টেই আমি প্রথম হতাম।
ফলে প্রতি বছর আমিই কলেজ ক্রীড়া চ্যাম্পিয়ন। এ ছাড়া ফুটবল দলে তো অধিনায়ক হিসেবে থাকতামই। কলেজ জীবনে সাহিত্য ও ক্রীড়া ক্ষেত্রের সাফল্য নিয়েই আমি ব্যস্ত থাকতাম না। আমার প্রধান লক্ষ্য ছিলো লেখা পড়ায় আমাকে ভালো করতেই হবে। আই. এ. পরীক্ষায় আমি কলেজের মধ্যে প্রথম হয়েছিলাম।
তার জন্য আমি বৃত্তিও পেয়েছি। সে সময় আমার মাসিক বৃত্তি ছিলো ১২ টাকা। এই টাকার মূল্য ছিলো অনেক। আমার মাসিক লেখাপড়া ও খাওয়া খরচ চলে যেতো বৃত্তির টাকায়। আমার আই. এ. পরীক্ষার বছরে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়।
তখন তো গোটা ভারতবর্ষ জুড়েই ছিলো বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। রংপুরেও সেই আন্দোলন পিছনে পড়ে ছিলোনা। মাঝে মধ্যে “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান”- স্লোগান মুখে নিয়ে আমিও মিছিলে নেমে যেতাম।
তবে রাজনীতি তখন আমার মধ্যে কোনো প্রভাব বিস্তার করেনি। আমি লেখা-পড়া- খেলাধুলা আর সাহিত্য-চর্চা নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম।
আমরা তখন এক নতুন নামের দেশের নাগরিক হয়ে গেছি। নতুন আশা, নতুন চেতনায় এ দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী তখন বুক বেঁধে দাঁড়িয়েছিলো। আমিও তখন সেই চেতনায় উজ্জিবীত। নিজেকে দেশের একান্ত প্রয়োজনীয় নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার সংগ্রামে অবতীর্ণ হলাম। পড়াশোনায় আরো মনোযোগী হয়ে গেলাম।
ফলে ১৯৫০ সালে আমি কৃতিত্বের সাথে বিএ পাশ করলাম। আনন্দাশ্রু চোখে নিয়ে বিদায় জানাতে হলো- অমলিন স্মৃতি বিজরিত কারমাইকেল কলেজকে।
আমার জীবনের গতিধারায় বাঁকে বাঁকে পরিবর্তন হয়েছে। কারমাইকেল থেকে বিদায় নিয়ে ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুরু জীবনের নতুন অধ্যায়।
সেই জীবনের কথা আজ এখানে আর নয়। স্মৃতিপটে এখন কারমাইকেল কলেজ। মনে পড়লেই নষ্টালজিয়া হয়ে যাই। এই কারমাইকেল আমার কাছে এমন এক স্মৃতির পাদপীট- যেখানে দাঁড়িয়ে আমি দেখতে পাই আমার সুবর্ন অতীতকে। এই স্মৃতি মিশে আছে আমার হৃদয়ে, অন্তরের অন্তঃস্থলে, জড়িয়ে আছে সকল অঙ্গে।
কারমাইকেলকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবী উঠেছিলো। আমার দাবীটি ছিলো রংপুরের ঐতিহ্য কারমাইকেল কলেজের অবস্থান ঠিক রেখে রংপুরে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় দিতে হবে। আশার কথা যে, রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হচ্ছে। কারমাইকেল কলেজ টিকে থাকবে যুগ-যুগ থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। কারমাইকেল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগ চালু করা উচিত।
এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সম্মান চালু করা হয়নি। এটাও অবিলম্বে চালু করা উচিত বলে মনে করি। আমার প্রত্যাশা, এই বিদ্যাপীট থেকে বেরিয়ে আসবে জাতীয় পরিমণ্ডল হতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যশ-খ্যাতি ছড়িয়ে দেয়া সন্তানেরা। আজ এই ক্ষণে কারমাইকেল কলেজের স্মৃতি মন্থন করে মনে হলো- অজান্তেই যেনো মিশে গেছি কলেজ ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের মাঝে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।