শেষ বলে কিছু নেই
ওরা চারজন উদ্যানের পশ্চিমদিকের গেট দিয়ে বেরিয়ে এল রাস্তায়, সোডিয়াম আলোয়; কিছুদূর হেঁটে এসে ওরা একবার পেছন ফিরে তাকাল।
অনিন্দ্যর মনে হল, ঢাকা শহরটা একটা অথৈ সমুদ্র আর এই উদ্যানটি সেই সমুদ্রে একটা ভাসমান প্রবাল-দ্বীপ; দ্বীপটা ভাসতে ভাসতে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে; দূরে, আরো দূরে...এভাবে সরে যেতে যেতে একটা বিন্দু এবং তারপরও ভাবতে থাকল অনিন্দ্য; বিন্দুটি দিগন্তরেখা স্পর্শ করে এবং স্পর্শ করা মাত্রই বিস্ফোরিত হয়, বিস্ফোরণের ধোঁয়ায় ঢেকে যায় দশ দিগন্ত; তারপর ধীরে ধীরে ধোঁয়া মিলিয়ে যায় শূন্যে। পার্কটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল? পরক্ষণেই ধাতস্থ হয় অনিন্দ্য, পদার্থবিদ্যামতে কোন কিছুই নিশ্চিহ্ন হয় না, রূপের পরিবর্তন হয় মাত্র।
হাশিমের মনে হল, উদ্যানটি কোটি কোটি বছর আগে একটা দেদীপ্যমান নক্ষত্র ছিল, তারপর কবে যেন মরে গেছে, মরে গিয়ে একটা জায়ান্ট ব্লাকহোলে রূপ নিয়েছে; পরম কৃষ্ণরূপ; অসীম ঘনত্ব; অনন্ত ক্ষুধায় বিপুল টানে সবকিছু গিলে নেয়, এমনকি কামনা, এমনকি বাসনা...
ডেভিডের কিছুই মনে হল না, কেননা সে অতি সাধারণ টাইপের ছেলে, খোদাভক্ত; উদ্যানের দিকে তাকিয়ে সে হঠাৎ একটা সূক্ষè পাপবোধে আক্রান্ত হল এবং মনে মনে বলল, জেসাস ক্ষমা কর।
বাবুর মনে হল, পার্কটার আসলে কোন অস্তিত্ব নেই; ওটা একটা অপরবাস্তব জিনিস ছাড়া কিছু নয়; ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, কেবল অনুভব করা যায়।
অথবা এমনও হতে পারে, ওটা একটা ছবি- পরাবাস্তব ছবি, যার অংকন-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল নিওলিথিক যুগে এবং অদ্যাবধি চলছে...
অনিন্দ্য বলল, লেটস লিট দ্যা ক্যানাবিস ইন্ডিকা। স্টিকগুলান দাও দিকিন বাবা হাশিম।
হাশিম চটপট বুকপকেট থেকে দুটো রেডিমেড গঞ্জিকার স্টিক বের করে ফেলল; ঝটপট অগ্নি যোজিত হল; ওরা এখন পালাক্রমে টানতে টানতে হাঁটছে অথবা এভাবেও বলা যায় যে, ওরা হাঁটতে হাঁটতে টানছে; নিদারুণ মৌতাত জমে গেল; ওরা এখন প্রপেলারের মত ক্যাম্পাসময় ঘুরছে; ঘুরতে ঘুরতে ওদিকে রাত সকালের দিকে খানিকটা সরে গেল; যাক, কী এসে যায়?
ওরা একসময় ক্লান্তি বোধ করল এবং একটি ছাত্রী-হলের উল্টোদিকের যাত্রী-ছাউনির নিচে থামল; ওরা সার বেঁধে সিমেন্ট বাঁধানো বেঞ্চের উপর বসল।
শীত এখন ছোটগল্পের সংজ্ঞার মত অমীমাংসিত; যায় যায় করেও বাতাস থেকে হিম যায়না; রাত গভীরতর; ভূত্বক তাপ বিকিরণ করে সাপের মত ঠাণ্ডা; সব মিলিয়ে শীত নেই, অন্তর্গত হিমটা আছে। ওদের চোখে নেশার লু হাওয়া; নেশালু চোখের দৃষ্টিপথে সব কেমন অলৌকিক।
ওদের সামনে সামনে ছাউনির নিচে নিপাট শানের উপর একটি ৬/৭ বছরেরর বালক এক চিলতে কাঁথা-সদৃশ জিনিশের নিচে দিব্যি ঘুমাচ্ছে। এই দৃশ্যে কোন বিশেষত্ব নেই, কেননা এদেশে এরকম দৃশ্য সূর্যের পূর্বে ওঠা আর পশ্চিমে অস্তে যাওয়ার মতই স্বাভাবিক। কিন্তু যখনই অন্য এক সমবয়েসী বালক কোথা থেকে যেন ছুটে এসে প্রথমোক্ত বালকের কাঁথা-সদৃশ জিনিশটা হরণ করে তার পাশেই শুয়ে পড়ে, তখনই প্রবহমান গল্পটিতে এন্টিগাল্পীক একটা মাত্রা যুক্ত হয়ে যায়।
১ম বালক এখন পুরোপুরি উদোম, হিম এসে তাকে আঁকড়ে ধরেছে, কাঁপছে ঠক ঠক করে; ওদের ৪ জনের ঝাপসা দৃষ্টি পথে দৃশ্যটা করুণ বিষন্ন এক বিভায় উদ্ভাসিত; ওরা মানবিক কম্পনে কেঁপে ওঠে; ওদের মধ্যে মনুষ্যত্বের জল কোলাহল; ওদের কণ্ঠে জলজ ধারাপাত...
আচ্ছা অনিন্দ্য, বলতে পারবি এরা কারা? প্রশ্নটা হাশিমের।
অনিন্দ্য পান্ডিত্ব ফলিয়ে বলল, এরা- আমি যেটা বলব তা হচ্ছে কেউনাদের দলে-।
হাশিম বলল, দ্যাট মিন্স...
দ্যাট মিন্স, এদের মা আছে কিন্তু গ্রাম্যাটিক্যালি বাপ নেই।
কথাটা সাররিয়ালিস্টিক ফর্মের হয়ে গেল না! বাপ নেই তবে কী ওরা ঈশ্বরপুত্র? বাবুর প্রশ্ন।
স্টপ ইট! এখানে যীশুকে টানবি না, তীব্র প্রতিবাদ করল ডেভিড।
অনিন্দ্য ওকে সাপোর্ট দিল। ইউ আর অল রাইট।
তবে কিনা বাবু, এদের বাপ আছে জানিস...। বাট দেয়ার ফাদারস আর নট আইডেন্টিফাইড এট অল। কামলা থেকে আমলা, চুনোপুটি থেকে রাঘব বোয়াল পর্যন্ত এদের পিতা হতে পারে, ইভেন..., একটু থেমে নিজের বুকে একটা চাপড় মেরে অনিন্দ বলল, আমিও হতে পারি, হু নোজ?
ওহ্ জেসাস! ব’লে ডেভিড চোখ উল্টিয়ে ফেললে অনিন্দ্য বলল, ইভেন...তুইও হতে পারিস ডেভিড, আবার হাশিম বাবু যে কেউই হতে পারে।
হাশিম তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ জানাল, নো নেভার, আমি কোন পিতাটিতা নই।
ডেভিড বলল, ইয়েস, আমিও কোন বাপ-টাপের মধ্যে নেই।
বাবু বলল, তবে আমি ক্যানো ওসবের মধ্যে থাকব? আমার কি মা মরে মর্গে পড়ে আছে? আমি পিতা না...টিতাও না
অনিন্দ্য বলল, তবে আমিও না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে...কে পিতা?
হাশিম বলল, কে পিতা?
ডেভিড বলল, কে পিতা?
বাবু হাঠাৎ ঘোষণার ভঙ্গিতে বলল, তোদের পিতা নিয়ে খুব প্রব্লেম হচ্ছে? যাহ্ তবে আমিই পিতা।
হাশিম চীৎকার করে বলল, তুই একা কেন পিতা হতে যাবি রে শালা? আমিও পিতা...
ডেভিড দ্বিগুণ জোরে চীৎকার করে বলল, যীশুর কিরে! আমি হচ্ছি পৃথিবীর উৎকৃষ্টতম বাবা।
অনিন্দ্য ওকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল। কবিতার কসম! আমার থেকে উৎকৃষ্ট পিতা পৃথিবীতে কেউ কোনদিন ছিল না, নেই এবং থাকবে না।
অতঃপর ওরা ৪ জন যেন কনসেনসাস হয়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে পরস্পরের হাতে হাত রাখল এবং রবি ঠাকুরের একটি গানের প্যারোডি করেগাইতে শুরু করল:
আমরা সবাই পিতা আমাদের এই পিতার রাজত্বে/ নইলে মোদের পিতার সনে মিলব কী শর্তে...
গাইতে গাইতে ওরা নাচতে আরম্ভ করল; দুটি ছিন্নমূল বালককে ঘিরে চলতে থাকল উদ্দাম নৃত্যগীতি; একসময় ফেটে গেল ওদের পিতৃত্বের গোপন বালতি; আর বালতি ফেটে স্নেহের জলস্রোতে ভেসে যেতে থাকল চারদিক; প্লাবন, মহাপ্লাবন। ওদের মনে হল, আনন্দে-বিষাদে আকাশ থেকে এই ফাঁকে টুপ টাপ করে খসে গেল কয়েকটি নক্ষত্র...
এবার শুরু হল বস্ত্র-বৃষ্টি; ওরা ওদের গা থেকে সোয়েটার গেঞ্জি শার্ট এইসব খুলে খুলে ছুড়ে দিতে থাকল শীতার্ত ২ বালকের উপর, আর জামা- কাপড়ের ওমে ওরা আরো গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে থাকল...
(শেষ)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।