সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি ও মৌলবাদের প্রতিপালকেরা
ফকির ইলিয়াস
===================================
আমি একজন শহীদের মাকে চিনি। দেশে থাকতে প্রতিটি বিজয় দিবসে আমি তাকে একগুচ্ছ ফুল উপহার দিতাম। সেই মা এখন ইমিগ্র্যান্ট হয়ে আমেরিকায়। এই শেষ বয়সে শান্তিতে কিছুদিন কাটাতে চান। তাই তার মেঝ ছেলে তাকে ইমিগ্র্যান্ট করে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে এসেছেন।
এখানে আসার পরও তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে আমার। গেলো সপ্তাহে এক পারিবারিক পুনর্মিলনীতে তার সঙ্গে আবারো দেখা হয়ে গেলো। আমাকে দেখেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ‘বাবা, তুমি কেমন আছো?’ আমি জানতে চাই আপনি কেমন আছেন? বলেন- ‘বিদেশে কি ভালো থাকা যায়?’
‘আচ্ছা বাবা, বর্তমান সরকার কি আলবদর-রাজাকারদের বিচার করতে পারবে?’ এই প্রশ্নটি করে শহীদমাতা আমাকে আবারো জড়িয়ে ধরেন। স্যাটেলাইটের কল্যাণে বাংলা টিভি চ্যানেল এখন আমেরিকার ঘরে ঘরে।
তাই ঢাকার প্রতিদিনের সংবাদ এখন যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালির আলোচনার বিষয়। শহীদমাতা আমাকে জিজ্ঞাসা করতেই থাকেন। ‘এদেরকে কি শাস্তি দেয়া যাবে বাবা?’
আমি তার তীব্র বেদনার কথা জানি। কারণ তার বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্তান রাজাকারদের হাতে ধৃত হয়েই নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন। এক গভীর রাতে শুধুমাত্র মাকে দেখার জন্যই বাড়িতে এসেছিলেন সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা আলমাস আলী।
কীভাবে এলাকার রাজাকার কমান্ডার কেরামত তা টের পেয়ে যায়। সে তার রাজাকার বাহিনী নিয়ে বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। তারপর সেই পরিচিত রাজাকাররাই আলমাস আলীকে ধরে নিয়ে যায়। শেষ যুদ্ধ যে আলমাস করেননি, তা কিন্তু নয়। এককভাবইে স্টেনগানের সবকটি গুলি শেষ করেছিলেন তিনি।
হত্যাও করেছিলেন তিনজন রাজাকারকে। নিজের চোখের সামনে পুত্রের এমন নির্মম শেষ বিদায় ধারণ করে বড় শোকে বেঁচে আছেন এই শহীদমাতা। আবারো অশ্র“সিক্ত নয়নে বললেন, ‘আমার শেষ ইচ্ছা এ দেশে রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের বিচার হবে এবং সেটাই যেন দেখে যেতে পারি। ’
যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে বাংলাদেশের রাজনীতি এখন সরগরম। প্রতিদিন বেরিয়ে আসছে নতুন নতুন তথ্য।
সম্প্রতি একটি টিভি চ্যানেলে একটি সেমিনারের সংবাদ দেখলাম। এটির আয়োজক ছিল ‘কর্মজীবী নারী’ নামের একটি সংগঠন। এই সেমিনারে জামাতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পনেরোটি ভিডিও ক্যাসেট দেখানো হয়েছে। সাঈদী কিভাবে এ দেশের কর্মজীবী নারী সমাজকে কর্মহীন করা কিংবা থামিয়ে দেয়ার জোরালো বক্তব্য রেখেছেন। তার বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছেন দেশের প্রগতিশীল মুক্তমনা বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিকরা।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. অজয় রায় বলেছেন, সাঈদীরা পর্দানশীনতার নামে মূলত রাষ্ট্রকে তালেবানি ধারার দিকেই ঠেলে দিতে তৎপর।
রাজনীতিক হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, মনজুরুল আহসান খান প্রমুখ মৌলবাদী বিষবাষ্পের বিরুদ্ধে জাতিকে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানিয়েছেন উদার কণ্ঠে। শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়-য়া বলেছেন, বর্তমান মহাজোট সরকার যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধীদের বিচার করবেই। নারীনেত্রী শিরিন আকতারের সভাপতিত্বে এই সেমিনারটি প্রমাণ করেছে জামাত নেতা সাঈদী কিভাবে ওয়াজের নামে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধকে তাদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন।
দুই.
দেশে গণহত্যার মূল নায়কদেরকে যখন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তখন একটি মহল এদেরকে বাঁচাতে বেশ তৎপর।
কদিন আগে একটি টিভিতে প্রজন্ম ’৭১-এর নেতা, বিশিষ্ট সাংবাদিক শাহীন রেজা নূরের একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার দেখেছি। তার একটি বিশেষ পরিচয় আছে। তিনি শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেনের পুত্র। শাহীন রেজা নূর খুব দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, এসব চিহ্নিত খুনি, বুদ্ধিজীবী হত্যার নায়কদের একাত্তরের গণহত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হোক। আসামি করা হোক।
আমরা জানি, বর্তমান সময়ে বসনিয়া-হার্জেগোভিনার গণহত্যা হুকুমদাতা নায়কদের খোঁজা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। নাৎসিবাদী হোতাদের খোঁজার কাজ এখনো শেষ হয়নি। ইতিহাসের নির্মম একটি গণহত্যা ছিল একাত্তরের হত্যাযজ্ঞ। সেই নীল নকশার দালাল এবং হুকুমদাতারা শুধু নেপথ্যেই ছিল না, এরা নিজেরা প্রকাশ্যে গণহত্যার নেতৃত্ব দিয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কারা তাদের চিনিয়ে দিয়েছিল, ধরে এনেছিলÑ তা বর্তমান প্রজন্মের মোটেই অজানা নয়।
এসব বিস্তারিত ইতিহাসের ইতিবৃত্ত আকরিক হিসেবেই রয়েছে। সম্প্রতি একাত্তরের নরঘাতকদের রিমান্ডে নেয়ার পর চৌকস গোয়েন্দা রাষ্ট্রের জনগণকে জানিয়েছেন এদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন কোনো কাজ নয় মোটেও। ভাবতে অবাক লাগে তারপরও দেশের ডানপন্থী রাজনৈতিক দল বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষেই অবস্থান নিতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিএনপির স্যুট-টাই পরা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এসব কুখ্যাত রাজাকারদের পক্ষেই কথা বলছেন। অথচ পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত এই ব্যারিস্টারের জানা উচিত, বাংলাদেশে এসব জঙ্গি-তালেবানিরা মদদ পেয়ে প্রতিষ্ঠিত হলে তারা এক সময় মওদুদের স্যুট-টাইও খুলে নেবে।
বলবে, টাই পরা হারাম। যে মৌলবাদীরা ‘নারী নেতৃত্ব হারাম’ ঘোষণা দিয়ে ওয়াজ করতো তারাই গাঁটছড়া বেঁধেছিল চারদলীয় জোট নেত্রীর সঙ্গে। এখন ক্রমশ বেরিয়ে আসছে এই মৌলবাদী জামাতি নেতৃত্বের যোগসাজশেই ১৭ আগস্ট গোটা দেশজুড়ে এক সঙ্গে বোমা হামলা চালানো হয়েছিল।
আমি একটা বিষয় ভেবে কূল পাই না, আর কতো হীনভাবে সত্যকে ঢেকে দেয়ার চেষ্টা করবে ডানপন্থী দল বিএনপি। এই দেশে শায়খ রহমান বাংলা ভাইয়ের জঙ্গি দানবের সশস্ত্র অবস্থান থাকার পরও জঙ্গিবাদের অস্তিত্ব স্বীকার করতে চায়নি খালেদা-নিজামীর জোট সরকার।
এখন জেএমপির ভারপ্রাপ্ত নেতা সাঈদুর রহমান, দিন-তারিখসহ মুজাহিদ-নিজামীর সঙ্গে বৈঠকের কথা দেশবাসীকে জানাচ্ছে।
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী ছোট ছোট সংগঠনগুলো জামাতের বি সি ডি টিম। তা এই দেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা বারবারই বলে আসছেন। ড. হুমায়ুন আজাদ ছিলেন এই ভাষ্যের অন্যতম প্রবক্তা। তাই তার ওপর সশস্ত্র আক্রমণ করা হয়।
ড. আজাদ আক্রান্ত হওয়ার পর সাঈদী কী বক্তব্য দিয়েছিল, তা খতিয়ে দেখা বর্তমান সময়ে খুবই জরুরি বিষয়। গোটা জাতি যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ তখন সেই মতলববাজ সামরিক ছাউনিতে বেড়ে ওঠা দলটিই নানা রকমের ভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে জাতিকে বোকা বানাতে চাইছে। মনে রাখা দরকার এরা জাতির জনকের স্বঘোষিত খুনিদের বিচার রহিত করেছিল। সেটাও সাধন করেছে এই বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ। এবার রাজাকারদের বিচারকেও তেমনি সাহসিকতার সঙ্গেই সম্পাদন করতে হবে।
বাংলাদেশে মওদুদীবাদী মৌলবাদীর সংখ্যা হাতেগোনা। তাই এরা নানাভাবে ধর্মীয় তমদ্দুন প্রতিষ্ঠার নামে শিকড় বিস্তৃতির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এদের অপতৎপরতা সম্পর্কে প্রজন্মকে সতর্ক থাকতে হবে।
পত্র-পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, বিডিআরের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থাও নাকি ‘পিলখানা হত্যাকাণ্ডের’ কথা আগাম জানতো। মনে রাখা দরকার, যে দেশে গোয়েন্দা সংস্থা এমন জঘন্য পরিকল্পনার কথা জানার পরও তা রোধে এগিয়ে আসে না, সে দেশে অনেক অঘটনই সম্ভব।
সরকারকে বিষয়গুলো গভীরভাবে বিবেচনায় রাখতে হবে। এই দেশে মৌলবাদের প্রতিপালকেরা নবরূপে আবির্ভূত হতেই থাকবে। সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি নিয়ে। এদেরকে প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমেই প্রজন্ম দাঁড়াতে পারবে শির উঁচু করে।
----------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ ।
ঢাকা । ১৭ জুলাই ২০১০ শনিবার প্রকাশিত
ছবি- মিশাল গর্ডন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।