h
সেই সুদুর তপ্ত মরুভুমির বুকে আরব ব-দ্বীপে জন্ম নেয়া ইসলাম ধর্ম একশত বছরের মধ্যেই সম্পুর্ণ আরব, মেসপটেমিয়া, পারসিয়া থেকে শুরু করে উত্তর আফ্রিকা অতিক্রম করে স্পেন পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। বিশ্বের ইতিহাসে আর কোন ধর্মই এত দ্রুত বিস্তার লাভ করেনাই। ধীরে ধীরে পারসিয়া থেকে ট্র্যান্সক্সিয়ানা, সিন্ধু থেকে সিসিলি, সমরখন্দ থেকে সেভিল, ককেশাস থেকে আফ্রিকা, অক্সাম থেকে আনাতোলিয়া, আলেকজান্দ্রিয়া থেকে ইন্দোচীন,প্যাসিফিক থেকে আটলান্টিক সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে ইসলামের বাণী। ইসলাম এত দ্রুত কিভাবে ছড়িয়ে পড়ল সেটা নিয়ে পন্ডিত ও দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। ইসলাম বিশারদদের মতে ইসলামের সুফিবাদ-ই এত দ্রুত ইসলাম সম্প্রসারনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
অপরদিকে অন্ধকার যুগের ইউরোপিয় পন্ডিতদের মতে ইসলাম সম্প্রসারিত হয়েছে তরবারি দ্বারা। অবশ্য এটা ঠিক, কোন অঞ্চল বা দেশ মুসলিম শাসক দ্বারা জয়ের পড়েই সেখানে সাধক ও সুফিরা নির্বিঘ্নে ইসলাম সম্প্রসারন করতে পেরেছে, তা না হলে এটা সম্ভব ছিল না। অর্থাৎ মুসলমানদের দেশ জয় ও সুফিদের দ্বারা ইসলাম সম্প্রসারন পরস্পর ফ্যাক্টর রূপে কাজ করেছে। অবশ্য সবক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়, কারন ইন্দোচীনে মুসলিম শাসক দেশ জয় করেনি বরঞ্চ আরব বণিকদের মাধ্যমে সেখানে ইসলাম প্রচার হয়, ঠিক যেমনটি হয়েছিল তুর্কি দ্বারা বিজয়ের পূর্বে বাংলায়।
বাংলায় মুসলিম আধিপত্য বিস্তৃতি শুরু হয় ১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজির বাংলা আক্রমনের মধ্যে দিয়ে।
এরপর ইতিহাসের ধারা অনুযায়ী ক্ষমতার হাতবদল হতে থাকে। ১২০৫ খৃঃ থেকে শুরু করে ১৩৩৮ খৃঃ পর্যন্ত দিল্লির শাসনাধিনে খিলজি, ইলবারি ও করৌনাহ বংশ দ্বারা বাংলা শাসিত হয়েছিল। এরা তখন নিজেদের সিংহাসন ও প্রাসাদ রাজনীতি নিয়েই বেশি ব্যস্তছিল। ধর্ম নিয়ে তাদের তেমন একটা মাথা ব্যাথা ছিলনা, আশ পাশের হিন্দু রাজাদের থেকে মূল্যবান উপঢৌকন পেয়েই তারা খুশি ছিল। পরবর্তি শতাব্দী ছিল বাংলার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ দিল্লির অধিনতা অস্বীকার করে স্বাধীন বাংলা ঘোষনা করেন ও ইলিয়াস শাহ যা এতদিন বঙ্গ, গৌড়, রাঢ়, পুন্ড্র, সমতট,হরিকেল নামে পরিচিত ছিল তা ইন্ট্রিগ্রেট করে একক রাজ্যে পরিগণিত করেন যার নাম দেয়া হয় সালতানাত-ই-বাঙ্গালাহ এবং শাসক শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান ও সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ উপাধি গ্রহণ করেন।
এদেশে ইসলামের অনুপ্রবেশ ঘটে স্থল-জল উভয় পথে, স্থল পথে তুর্কি আক্রমন ও জলপথে আরব বণিকদের মাধ্যমে। তাই ধারনা করা হয় তুর্কি শাসনের পূর্বেই এদেশে আরবীয় বণিকরা ইসলাম প্রচার করা শুরু করেন আর তুর্কি বিজয় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। ১৪১১-১৪ খৃঃ রাজা গণেশ ও শিহাবুদ্দিন, ইলিয়াস শাহ বংশের অবসান ঘটিয়ে বাংলার ক্ষমতা গ্রহণ করেন। কিছুদিনের মধ্যেই রাজা গণেশ শিহাবুদ্দিনকে নিহত করেন ও রাজা হয়েই মুসলমান প্রজাদের ওপর দমন নীতি চালান।
এমতাবস্থায় সুফি-সাধকগণ বাংলায় হস্তক্ষেপের জন্য জৈনপুরের সুলতানের নিকট আবেদন জানায়, এ প্রেক্ষিতে রাজা গণেশ ভীত হয়ে নিজ রাজত্ব রক্ষার জন্য পুত্র যদুকে সুফি নূর কুতুবে আলমের নিকট ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে জালালুদ্দিন মুহম্মদ শাহ নামে রাজ্য পরিচালনার ভার দেন। অচিরেই রাজা গণেশ জালালুদ্দিনকে আবার হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করান। কিন্তু জালালুদ্দিন তার পিতাকে পরাজিত করে পুনরায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন ও রাজা গণেশ দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদ মাদ্রাসা পুনঃনির্মান করেন। তিনি চায়না, হিরাত ও কায়রোর সুলতানদের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি বাংলায় ইসলাম প্রচারের জন্য বিশেষ ভুমিকা রাখেন।
বিশেষ করে মোঙ্গল কর্তৃক বাগদাদ ধ্বংসের পর উন্নত জীবিকার লক্ষ্যে প্রচুর পরিমানে সৈয়দ, ওলামা ও সুফি-সাধকের আগমন ঘটে বাংলায়। তারা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা লাভের কারনে তাদের আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য প্রচুর মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানা গড়ে তোলেন। অধিকন্তু তিনি ছিলেন হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি সহিষ্ণু ও সহানুভূতিশীল। তার সময় সেনাপতি ছিল হিন্দু। এছাড়াও তিনি পন্ডিত ও ব্রাক্ষ্মনদের প্রচুর পৃষ্ঠপোশকতা প্রদান করেন।
সে সময় হিন্দু রাজার মুসলমান সেনাপতি বা সুলতানদের হিন্দু মন্ত্রী, আমাত্য, রাজ কবি ছিল সাধারণ ঘটনা।
অনেকেরই ভূল ধারনা আছে বাংলায় ইসলাম দুরদেশ থেকে আসা এক ধর্ম যা বাঙ্গালী সংস্কৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। প্রকৃত পক্ষে বাংলায় ইসলাম প্রচার শুরু হয় এক প্রকৃত বাঙ্গালী শাসক দ্বারা, কোন তুর্কি বা আফগান দ্বারা নয়। আর তাই বাংলার মাটি-বাতাস সবকিছুকে আপন করে নিতে পেরেছিল এই ধর্ম যেমনটি করে নিয়েছিল হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম। বস্তুত একমাত্র অধুনালুপ্ত জৈন ধর্ম ব্যাতিত আর কোন ধর্মকেই এদেশীয় বলা যাবেনা।
হাজার বছর আগে পশ্চিম থেকে আসা আর্যদের সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ঘটে যাওয়া ঘটনা, যুদ্ধকে আশ্রয় করে তারা গড়ে তুললো বস্তুর অতীত অতিন্দ্রীয় স্রষ্টা দর্শন যা পরে পরিনত হয় ব্রক্ষ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের ধর্মে। পরবর্তিতে মুসলমান বিজেতারা সিন্ধু নদের ওপারের জনগোষ্ঠীর নাম দেন হিন্দু। সেই থেকেই ব্রক্ষ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের ধর্ম হিন্দু ধর্ম নামে সুপরিচিতি ঘটে। এদিকে নেপাল সীমান্তবর্তী কপিলাবস্তুর রাজা ভগবান বুদ্ধের মতাদর্শের যে অংশটি বাংলায় প্রবেশ করে তা ছিল তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম বা বৌদ্ধ ধর্মের এক অধঃপতিত রূপ। বিশুদ্ধ বৌদ্ধ ধর্ম থেকে এই তান্ত্রিকতায় রূপান্তরের কারনে বলা যায়, বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের এই রহস্যময় গুঢ় চর্চার ধারা একান্তই বাংলার।
তাই বলা যেতে পারে বাংলার সংস্কৃতির দ্বারা ধর্ম প্রভাবিত হয়েছে বেশী যতটা না ধর্ম দ্বারা সংস্কৃত প্রভাবিত হয়েছে।
তাই মুসলিম শাসনামলে দেখা যায় তারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশেষ মর্যাদার আসনে বসান। তারাই প্রথম বাংলা সাহিত্যে নর-নারীর প্রেমের রোমান্টিক ভাবধারা নিয়ে আসে, শাহ মোঃ সগিরের ইউসুফ-জুলেখা তার একটি উদাহরন। সেই সময় গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ কৃত্তিবাসকে বাংলায় রামায়ন লেখার নির্দেশ দেন। এছাড়াও বৃহস্পতি মিশ্র বা রায়মুকুট ,শ্রী কৃষ্ণবিজয় লেখক মালাধার বসু, পুরাণসর্বস্বের লেখক গোবর্ধন ব্রাক্ষ্মন সহ প্রচুর কবি সাহিত্যিকের স্বর্ণযূগ ছিল সেটি যা বলে আর শেষ করা যাবেনা।
ক্যালিগ্রাফি ও মসজিদ বা মন্দিরের গায়ের প্রস্তর ও পোড়ামাটির শীলালিপিও চরম উৎকর্ষতা লাভ করে সে সময়। এসময়ই বাংলার একত্রীকরণের ফলে বাংলা ভাষা-ভাষী লোক একই রাজ্যের ছায়ায় আশ্রয়গ্রহণ করে ও এর অধিবাসীরা বাঙ্গালী নামে পরিচিতি লাভ করে। স্থাপত্যরীতির উৎকর্ষতাও ছিল শিখরে, সুলতানরা বাগদাদ ও কর্ডোভার আদলে স্থাপত্যশৈলী গড়ে তোলেন। কিন্তু এদেশে পাথরের স্বল্পতার কারনে দূর্গ ও রাজমহল সমূহ পোড়ামাটি তথা ইট দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল যা কালের পরিক্রমায় মাটির স্তুপে পরিনত হয়েছে।
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথা বলার আর অপেক্ষা রাখেনা।
সে সময় বাংলার সবচেয়ে বড় উৎকর্ষতা হল পর ধর্মের প্রতি সহনশীলতা বজায় রাখা। সুলতানরা ইসলামী ব্যবস্থা কায়েম করলেও তারা নিজেদের হিন্দু প্রজা ও প্রতিষ্ঠান সমুহের পৃষ্ঠপোশক হিসেবে বিবেচনা করতেন। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় ছিল এবং কোরান-হাদিস ও পুরানের বিধান সমুহ পাশাপাশি সুসামাঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে কার্যকর ছিল। ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে সুফিরা বাংলার সংস্কৃতির সাথে মিল রেখে ইসলামের সঙ্গে স্থানীয় পুরাকথা ও আচার-আনুষ্ঠানের সংমিশ্রন ঘটান। পীর প্রথা বা মাজার প্রথা এরই একটি উদাহরন।
এমনকি এখনো পীর ও মাজার হিন্দু-মুসলমান সকলের কাছে সমান ভাবে পবিত্র। তাই অনেক অমুসলিমদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হবার ব্যাপারটি অপরাপর স্বধর্মীর নিকট বিশেষ কোন ক্ষোভের সঞ্চার করত না। প্রশাসনিক ও সামাজিক সকল ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই অভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হত। তাই সে সময়ের বাংলার ত্রাস বর্গী নামক মারাঠা দস্যু দলেও পেশোয়া রঘুজি ভোঁসলের সাথে মীর হাবিব ও সৈয়দ নুরের তস্কর বর্গীদল দেশে ধ্বংশলীলা চালায়। অপরদিকে বেনারসের শোভা সিং ও রহিম খান সুবাহদার শায়েস্তা খানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করে এবং লুটতরাজ চালায়।
এমনকি পলাশির যুদ্ধ সহ সকল প্রকার প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহনকারী প্রত্যেকে তাদের ব্যাক্তি স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশদের সাথে হাত মিলিয়েছিল, কোন ধর্মবিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে নয়। (চলবে...)
(তথ্যসূত্রঃ বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।