আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেক্যুলারিজম (বাংলার ইতিহাসে সাম্প্রদায়িকতার অবস্থান - ৪)

h
ব্যক্তিগত ভাবে আমি তথাকথিত সেক্যুলারিজমে বিশ্বাসী নই। সেক্যুলারিজমের শাব্দিক অর্থ প্রদান করা হয়েছে ‘Exclusion of Religion from Public Affair’ এবং ‘Rejection of Religion’ (Microsoft Encarta Dictionary). কিন্তু আমরা প্রাচীন বাংলার ইতিহাস থেকে শুরু করে আধুনিক ইতিহাস যদি পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাব বাংলায় কখনোই কোন রাজ্যে ধর্মচ্যুতির ব্যাপার ঘটেনি এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ধর্ম ছিল একটি অপরিহার্য অঙ্গ। গুপ্ত সম্রাজ্যে শৈব ও বৈষ্ণব ধর্ম হিন্দু ধর্মের কাছাকাছি এসে পড়ে আর বৌদ্ধ ধর্ম তার আধ্মাতিক নাস্তিক্যবাদ পরিহার করে ভক্তি আন্দোলনের এতটা কাছে চলে আসে যে বুদ্ধদেব বিষ্ণুর একজন অবতার হিসেবে স্বীকৃতি পান। ক্লাসিক্যাল যুগের শেষ ধাপে খৃষ্টান ইউরোপের ভীতি ছিল এথিস্ট আতিলা-দ্যা-হানকে নিয়ে, মধ্যযুগে মুর ও অটোম্যানদের নিয়ে। কিন্তু বাংলায় রাজায় রাজায় যুদ্ধ হত, ধর্মের প্রভাব ছিল খুব সামান্যই।

পাশ্চাত্য পন্ডিতদের ‘ধর্মই সকল সংঘাতের মূলে’ ধারনাকে ভূল ও অসার প্রমানিত করে যে শক্তির মাধ্যমে বাংলার সকল ধর্মের অধিবাসী মিলে-মিশে থাকত তাই হল বাঙ্গালী জাতির ধর্মীয় সহনশীলতা বা রিলিজিয়াস টলারেন্স যা পূর্বতন ব্লগে আলোচিত হয়েছে। এই রিলিজিয়াস টলারেন্স বাঙ্গালী জাতির নিজস্ব ডগমা, এটা কোন পাশ্চাত্য অনুকরন নয়। বস্তুত কম্যুনিজম,ক্যাপিটালিজম,এথিজম, সেক্যুলারিজম এমনকি ফান্ডামেন্টালিজম ও রিলিজিয়াস এক্সট্রিমিজমের জন্মস্থান ঐ পাশ্চাত্যে যারা নিজেদের মধ্যেকার শত বছরের দাঙ্গা-হাঙ্গামা প্রশমিত করার উদ্দেশ্যে এসব মতবাদ রচিত করেছে। আজকালের বেশ কিছু বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবিরাও নিজেদের শক্তির উৎস ভূলে গিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজ স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতাকে ইগনোর করে পাশ্চাত্য সেক্যুলারিজম মতবাদ এই দেশে টেনে নিয়ে আসে। সেক্যুলারিজমের শাব্দিক অর্থ যাই হোক না কেন বাংলায় সেক্যুলারিস্ট ও এথিস্টদের নিয়ে একটা বিতর্ক আছে এবং বাংলাদেশে এই সেক্যুলারিস্ট ও এথিস্টদের পার্থক্য নিরুপন করাটা এতটা সহজ নয়।

প্রাচীন বাংলায়-ও হয়ত সবাই ধার্মিক ছিলনা, কিন্তু তারা ঈশ্বরে অবিশ্বাস অথবা সমাজ ও দৈনন্দিন জীবন থেকে ধর্মের প্রভাব কখনোই করেননি বা করতে চাননি। হাজার বছরের সে ধারা আজো অবধি অব্যাহত আছে। আর একারনেই কিছু বাংলায় নব্য এথিস্টের মৃত্যুর পরেও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালিত হয়, আর এটা ছিল জীবিত বা মৃত অবস্থায় তাদের পাশ্চাত্য মেকি বিশ্বাসের ওপর প্রচণ্ড আঘাত। যারা সেক্যুলারিজমে বিশ্বাস করে তারা প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলার মতন ধর্মীয় সহিষ্ণু রাষ্ট্র চায় নাকি ধর্মহীন রাষ্ট্র চায় এ নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যেই দন্দ রয়েছে। থাকবেইতো, কাকের কর্কশ ধ্বনি কি আর কোকিলের কণ্ঠে শোভা পায়? আমাদের নিজেদের মূলেই যখন টলারেন্স নামের এত বড় একটি উপাদান রয়েছে, তখন কি দরকার এই বিদেশী ইজমকে টেনে আনার? আরেক ধরনের নিকৃষ্ট প্রজাতির গোষ্ঠি ধর্মীয় উগ্রতা বা এক্সট্রিমিজমে বিশ্বাসী।

এসব অন্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠি পাশ্চাত্য মদদে ও সাহায্যে পুষ্ট হয়ে বাঙ্গালী জাতির শেকড়ে গিয়ে আঘাত করে। এদের লক্ষ্য হল বর্তমানের মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্যযুগীয় ইউরোপের মতন এক ধর্মান্ধ ও অসহিষ্ণু রাষ্ট্র কায়েম করা। এরা ওহাবি আরবে সফলকাম হলেও বাংলায় নয়, কারন বাঙ্গালী অন্য ধাতুতে গড়া। বাঙ্গালী জাতি তাদের নিজ নিজ ধর্মকে সম্পুর্ণ নিজেদের মত করে সাজিয়ে ফেলেছিল। আর এর ফলে ধর্মীয় সম্প্রীতির শান্তিপূর্ণ মিলন ঘটা সম্ভব হয়েছিল।

যেমন, বাংলায় মুসলমানদের কাছে যিনি সত্যপীর বলে পরিচিত তিনিই হিন্দুদের কাছে সত্যনারায়ন এবং মুসলমানদের বদরপীরের ভক্তিবাদ হিন্দুদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। পারস্পরিক সহাবস্থান এতটা কাছাকাছি চলে এসেছিল যে হিন্দু ধর্মের সাধু ও মুসলমান ধর্মের দরবেশদের একই মানুষের ভিন্ন ভিন্ন রূপ বলে বিবেচিত হত। এসকল বিশ্বাস এখন বেশ স্থিমিত হয়ে আসলেও যখন পাকিস্তানিরা তাদের মডিফায়েড ধর্ম আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল তখনি গর্জে উঠেছিল বাঙ্গালী, হাজার বছর আগে বাঙ্গালীর যে রূপ দেখেছিল আর্যরা, দেখেছিল সম্রাট আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনী, দেখেছিল ব্রিটিশরা সিপাহী বিপ্লবের সময়, এবার দেখল পাকিস্তানিরা ১৯৭১-এ। হাজার বছরের ইতিহাসে বাংলায় যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রয়েছে তা এতটা ঠুনকো নয় যে কোন এক অবাঙ্গালীর ‘দ্বি জাতী তত্ত্বের’ ভিত্তিতে ভেঙ্গে যাবে। শাসন ক্ষমতার জন্য বা শাসক গোষ্ঠীর চক্রান্তে অনেক সময়ই বাংলাকে একাধিক ভাগ করা হয়েছে, কিন্তু তা কখনোই স্থায়ী হয় নাই।

বাংলা এখনো তিন খন্ডে বিভক্ত, এটা আমাদেরই দায়িত্ব এক ইউনিফায়েড বাংলা সৃষ্টি করা, যা হবে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জাতিগোষ্ঠীর বৃহৎ এক শক্তি। -------------------------
 

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.