h
হাজার বছর ধরে চলে আসা বাঙ্গালী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্বভাবতই বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। কখন-ও বা কিছুটা ধর্মীয় উত্তেজনা লক্ষ্য করা গেলেও সেটা ছিল অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। ব্রাক্ষ্মাণ্য ধর্মের অনুসারী গুপ্ত রাজ্যে নব বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার, বৌদ্ধ পাল রাজ্যে বিপুল পরিমান ব্রাক্ষ্মণ মন্ত্রী, বেশিরভাগ সেন রাজাগণ-ও একই পথ অনুসরণ করেন। সুদীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন রাজার শাসনামলে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু প্রাকৃত, ব্রাক্ষ্মাণ্য, বৌদ্ধ, জৈন, ইসলাম একই সংস্কৃতির মিথস্কৃয়ায় এক মহান অন্তঃশক্তি এনে দিয়েছিল যার কারনে বাঙ্গালী তাদের জাতিগত বন্ধন সুদৃঢ় রাখে আর তা ছিল ধর্মীয় সহনশীলতা বা টলারেন্স। মূলত বাঙ্গালী জাতির মূলে রয়েছে রিলিজিয়াস টলারেন্স বিষয়টি।
এজন্য দেখা যায়, ইউরোপ যখন অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল (মধ্যযুগীয় স্পেন ব্যতিত), তখন বাংলা ছিল বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী রাজ্য। একারনেই প্রাচীন যুগে মহামতি আলেকজান্ডার থেকে শুরু করে মধ্যযুগে তিব্বতী, আফগান, তুর্কিদের ও প্রাক রেঁনেসার যুগে ইউরোপিয়দের নজর ছিল এইদিকে। মধ্যযুগে যখন মৌলবাদী ধর্মান্ধ সম্প্রদায় ক্রুসেড নামক রক্তের হোলিখেলায় মেতে উঠেছিল তখন বাংলায় তুর্কি-আফগানদের প্রবেশ ধর্মযোদ্ধা হিসেবে নয় বরঞ্চ তারা শাসক হিসেবে দেশ জয় করতে এসেছিল। পূর্বতন রাজাদের মতন মুসলমান শাসকরাও যথেষ্ট উদার ছিল, তা আগের ব্লগেই বিস্তারিত উল্লেখ আছে।
উপমহাদেশে খৃষ্ট ধর্মের প্রবক্তা ব্রিটিশ, এ ধরনের ভূল ধারনা আমাদের অনেকেরই আছে।
প্রকৃতপক্ষে সম্রাট আকবর কর্তৃক হুগলীতে পার্তুগিজদের বসতি স্থাপনের অনুমতি পেলে রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায় জেসুইটস ও অগাস্টিনিয়ানদের দ্বারা এদেশে খৃষ্ট ধর্ম প্রচার কার্য শুরু হয়। পার্তুগিজ ছাড়াও এদেশে ওলন্দাজ,দিনেমার,ব্রিটিশ,ফরাসী,আর্মেনীয় এমনকি আমেরিকানরা পর্যন্ত বানিজ্য ও ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্য এদেশে আসত। পরবর্তিতে হামার্দ জলদস্যুগণ চট্রগ্রামে আস্তানা গাড়ে আর দস্যুতাকালে অপহৃতদের খৃষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করা হয়। কিন্তু তাই বলে এদেশর খৃষ্ট ধর্মের বিকাশ দস্যুদলের মাধ্যমে এসেছে এটা মনে করার কোন কারন নেই। যশোরের রাজপুত্র নিজেই খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করে এন্টনিও-ডি-রোজারিও নাম ধারন করেন ও বাংলায় খৃষ্ট ধর্ম বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
তাই এটা বলা যায় বাকি সব ধর্মের মত খৃষ্ট ধর্মও এদেশীয় পরিমন্ডলে উদ্ভাসিত।
কিন্তু এই ধর্মীয় সম্প্রীতির ওপর সর্বপ্রথম বড় আঘাত আসে ব্রিটিশ শাসনামলে। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মুসলমানেরা বাংলার মাটি ও মানুষের সাথে মিশে গিয়েছিল, কিন্তু ইউরোপিয়দের ধ্যান-ধারনা ছিল শাসন ও শোষণ। এজন্য তারা এক ঘৃণ্য পথ বেছে নেয়, আর তা হল ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি। ব্রিটিশরা নিজেদের নব্য আর্য হিসেবে বিবেচনা করত, আর তাদের সাম্প্রদয়িক ঔদ্ধত্য এতখানি বৃদ্ধি পায় যে তারা ভাবতে শুরু করে ভারতীয়দের সভ্য করা তাদের এক মহান গুরু দয়িত্ব।
কিন্তু ভারতবাসী বিদ্রোহ ঘোষনা করলে তারা তাদের ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি বাস্তবায়নের জন্য এদেশীয় কিছু দালাল তৈরি করে যাদের প্ররচোনায় এদেশে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এরফলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা হিন্দু-মুসলমানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের এক তিক্ত ও হৃদয়বিদারক অবসান ঘটে এবং হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে গড়ে ওঠে পারস্পরিক অবিশ্বাস যা আজও বিরাজমান।
এতদিন সাম্প্রদায়িকতা ছিল ধর্মের ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু পাকিস্থান সৃষ্টির পর বাঙ্গালী ও অবাঙ্গালীদের মধ্যে শুরু হয় তিক্ততা। মূলত এসময় বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে।
আবার হিন্দু-মুসলমান সবাই মিলে ইসলামের কপট ধ্বজ্জ্বাধারী পাকিস্তানীদের বিতারিত করে স্বাধীন হল বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলার সংবিধানে সকল জাতি-ধর্মগোষ্ঠীর লোকজনকে বাঙ্গালী বলে পরিচয় দেয়াকে পার্বত্য চট্রগ্রামের উপজাতীরা চ্যালেঞ্জ করে এবং তারা নিজেদের বাংলাদেশী, কিন্তু জাতিগত সংখ্যালঘু হিসেবে পরিচয়ের দাবী জানায়। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই সাম্প্রদায়িক বিবাদে উভয় পক্ষের বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়। বর্তমানে তাদের দাবী মেনে নিয়ে এক শান্তিচুক্তি এই বিবাদ মিমাংসা করতে সাহায্য করে। (চলবে...)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।