স্ট্যান্ডে বসে আছি সকাল থেকেই। আমরা হাতে গোনা দু’জন। ওরা সংখ্যায় অনেক। সবুজের প্রতি মানুষের ভালোবাসা দেখে আমার কান্না আসে। সুখের কান্নায় আমার বুক ভাসে না।
দুখের তিমিরে হাতড়াতে হাতড়াতে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই সবুজেরই পাশে। শরীরের অবস্থাও তেমন ভালো না। যাপিত দিনগুলোতে চলতে চলতে হঠাৎই থেমে যেতে হয়। যৌবনের উজ্জ্বল হলুদ বর্ণটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মধ্যবিত্তের স্বপ্নের পঙ্খীরাজ ছিলাম একসময়।
আমার বর্ণটা এখনও সবার জন্য উন্মুক্ত। হলুদতো এখন আর শুধু নিম্ন মধ্যবিত্তের রং নয়। অনেক উঁচুতে যে বৃত্ত তাদের কচি - কাঁচাদেরও প্রিয় রং এখন হলুদ। ০১৭১...... কল করলেই হলুদ এসে যায় দোরগোড়ায়। এ দেশে আমরা যখন প্রথম এসেছিলাম, আমাদের নিয়ে কী যে মাতামাতি হয়েছিল ! মফিজ সাহেব রীতিমত অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন।
যে করেই হোক আমাদের একজনকে তার চাই-ই-চাই। যেই ভাবা সেই কাজ। আমাদের একটা সুবিধা ছিল। সবাই দেখতে একরকম ছিলাম। পরবর্তীতে ঢাকাইয়ারা আমাদের চেহারা পাল্টিয়ে দিয়েছিল।
এদেশটাতে ঢাকাকে সব কিছু থেকে আলাদা করে রাখার যে প্রবণতা তার একটি নোংরা উদাহরণ আমরা। একবার মফিজ সাহেবের কী একটা কঠিন রোগ হয়েছিল। অনেক টাকা পয়সার দরকার। আত্নীয় - স্বজনদের পীড়াপীড়িতে চট্টগ্রামের জালাল সাহেবের কাছে আমাকে বিক্রী করে দিয়েছিলেন। তাছাড়া আমাদের জন্য নাকি পরিবেশ দূষণ মারাত্নক হয়ে পড়েছে - এই অযুহাতে আমাদের বিরুদ্ধে ‘ঢাকা ছাড়ো’ আন্দোলন জোরদার করা হয়েছিল বলে মফিজ সাহেব নিরূপায় ছিলেন।
প্রকৃতি আমাদের গায়ে, চরিত্রে, স্বভাবে স্ট্যাম্প মেরে দিয়েছে ‘পরিবেশের শত্র“’ বলে। আমাদের মত বেশীর ভাগেরই মালিক ছিলেন হয় মধ্যবিত্ত নয় নিম্ন-মধ্যবিত্ত। মানুষ যদি সত্যিকার অর্থে ভালোবাসে, আর সে ভালোবাসার পাত্রটি যদি একটি যন্ত্রও হয়, তবু সে ভালোবাসবে-কাঁদবে। আমি মফিজ সাহেবের চোখে সে ভালোবাসার জল দেখেছিলাম। রোগাক্রান্ত মফিজ সাহেব হাঁটতে পারছিলেন না।
তবুও অতি কষ্টে আমাকে হাত বুলিয়ে গোপনে চোখের জল মুছলেন।
সত্য প্রকাশের একদিন পর আমার বিক্রি হয়ে গেল। আমরা নাকি পরিবেশের শত্র“ - ভালো কথা। কিন্তু যারা ভটভটিওয়ালাকে নিজের দেশে ভটভটি বানানোর সুযোগ না দিয়ে অন্যের দেশ থেকে সবুজ-কালো-হলুদের বিপ্লব ঘটাচ্ছে তারা কি দেশের বন্ধু ? দুপুর চারটা নাগাদ এক আনসার এসে বসল। কিছু না বলে রাইফেলের প্রতিটি অংশকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।
আমার যে চালক তার অবস্থা তখন খুবই নাজুক। অনেক কষ্টে একটা কৃত্রিম হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করল - ‘ভাইজান, গরম কি খুব বেশী ?’ গানম্যান কোন উত্তর দিলনা - হাসলও না। গম্ভীর ভাবে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর চারজন তাগড়া যুবক এসে জানতে চাইল - ‘এয়ার পোর্ট যাবে কিনা ?’ ড্রাইভারের মনে খুশীর ঢেউ খেলে গেল। আশি টাকা বলতেই - যুবকরা মনে মনে একটু খুশী হলেও ধমকের সুরে বলল - ‘সত্তর ট্যঁআ (টাকা) যাইবা না ?’ অগত্যা ড্রাইভার রাজি হয়ে গেল।
যুবকদের একজন ভেতরে ঢুকতে গিয়েই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ‘ওমা এখানে তো পুলিশ’। আর একজন বলে ‘ভাই আমাদের গাড়িতে আপনার জায়গা হবেনা, কি করা যায় বলুনতো ?’ ড্রাইভার হাসে, পুলিশও হাসে, বাংলাদেশ হাসে।
ভি আই পিদের হাত ভূতের হাতের মত লম্বা হয়। না হলে জাতীয় পতাকাওয়ালা গাড়িটা অন্তত একমাইল দুরে থাকা সত্ত্বেও আগ্রাবাদ এলাকায় এক মাইক্রো শুধুই হর্ণ দেয় কেন ? যেন কোন রাজা যাচ্ছে।
সাইড করে না চললে লাথি দিয়ে ফেলে দেবে বড় নালাগুলোতে। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় ঘৃণাভরে দেখছিল। আমি যেন কোন আজগুবি প্রাণী রাস্তা ভুলে জনপদে চলে এসেছি। দুঃখ লাগেনা। অনেক আগে থেকেই এসমস্ত ব্যাপার গা-সওয়া হয়ে গেছে।
ওদের হর্ণ না শুনলেও অন্যদের চলে, আমি গরীবের যন্ত্র, আমার চলেনা। অনেকের চাকা ঘুরে, আমার চাকা যেন ঘুরেও ঘুরেনা। যাত্রীদের মধ্যে বেশ গরম ভাব দেখা যাচ্ছে। এখন বোধ হয় পৃথিবীতে খুব গরম পড়ছে। সবগুলো মানুষ কেমন যেন ক্লান্ত।
যাত্রীদের একজনের মুখ থেকে শোনা গেল দেশের কোথায় যেন এক জনপ্রিয় মাস্টার সংসদ সদস্যকে সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্য জনসমাবেশে গুলি করে হত্যা করেছে। করবেনা ! এটা সেই দেশ যেখানে আমাদের মত প্রত্যেককেই প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করা হয়। প্রত্যেকের মুখ বিষন্ন দেখা গেল। কিছুক্ষণের জন্য চারিদিকে যেন নিরবতা নেমে এলো।
বারিক বিল্ডিং মোড়ে এক রাজাকার আমাকে প্রায়ই চাপা দিচ্ছিল।
ও রাজাকার ! সমগ্র বাংলাদেশকে মাত্র পাঁচ টনের আওতায় এনে যারা গিলে খায় তারাই তো আমাদের সমাজের রাজাকার। যন্ত্র সমাজে ওদের তেমন সম্মান না থাকলেও দাপট ওদেরই বেশী। সোনার বাংলা’র সোনার ছেলেরাই আদর করে ওদের নাম দিয়েছে ‘বাংলা ভাই’। যোগ্য লোকের যোগ্য নাম। আমরা শুধুই খাদ্য।
ছোট ছোট প্রাণী। বড়দের খাবার। রাজাকারদের মালিকগুলোও রাঘববোয়াল। একেকটা রাঘববোয়ালের অধীনে একের অধিক রাজাকার থাকে। সরকারী রাস্তাগুলো মূলত ওদের জন্যই তৈরী।
এদেশের জনগণগুলোকে দেখলে আমার গা গুলিয়ে বমি আসে। শালারা খালি সহ্য করে। এরা কী মহান সহ্যশীল। পৃথিবীর আর কোথাও এত সহ্যশীল ও অকৃতজ্ঞ জাতি আছে কি-না আমার সন্দেহ হয়। এরা যার খায় তারে ভুলে যায়।
আমার কথাই ধরা যাক। আমাদেরকে কত ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আনা হল। আবার আরেকদলকে আমাদেরই জন্মভূমি থেকে আমদানি করে আনার জন্য সেই আমাদেরকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে ‘ঢাকা ছাড়ো’ আন্দোলন করল। আরে, রাস্তায় কত রাজাকার, আলবদর, স্বৈরাচার পুরো দেশটাকেই ধ্বংস করে দিচ্ছে। দেশকে ‘অকার্যকর’, ‘দূর্নীতিগ্রস্থ’ , ‘তালেবান’ ইত্যাদি অপমানে জর্জরিত করছে সে খবর এদেশের মানুষ জেনেও জানেনা, দেখেও দেখেনা।
আমরা শুধু যন্ত্র বলেই মন্ত্রী মহাশয় সুর তুললেন। সহ্যশীলরা(!) একজোট হল, আমাদের অবাঞ্চিত করা হল। এটাতো সে দেশ যেখানে প্রায় প্রতিটি মানুষ স্বার্থ ছাড়া এক কদমও চলে না। এখানে নিজের স্বার্থে আঘাত লাগার ভয়ে মানুষ চমৎকার এক নিরবতা পালন করতে পারে। যার ভেতর দিয়ে সশব্দে বাসা বাঁধে বিশ্ব ব্যাংক।
এখানে ক্ষমতার বাইরে থাকলে ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, ক্ষমতায় গেলে ব্যক্তিটাই আসল। আর দেশ। ওটাতো একখন্ড মাটি। কোপাইলে যা, বাইজ্জালেও তা। ‘বাংলা ভাই’ এর জন্ম ও তার মদদদাতাদের কারণে এরশাদ শিকদারের মৃত্যুও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়।
এটা সে রকমই একটা দেশ। আরে আমরা তো মানুষের সেবা করতে গিয়ে পরিবেশের ক্ষতি করি। কিন্তু ওরা, মানে ওই খানকির পুতগুলা যারা যন্ত্র সমাজের আট-দশটি রাজাকারের মালিক তারা কার উপকার করতে গিয়ে সোনার বাংলার ক্ষতি করে ? এ প্রশ্নের উত্তর পাবার আগেই হয়তো কোন এক রাজাকার আমাকে চাপা দেবে।
এ কিসের আলামত ! সবগুলো যন্ত্র এভাবে একে অন্যের পেছন পেছন ছুটছে কেন ? একে অন্যকে ওভারটেক করছে
কেন ? মনুষ্য সমাজে এক কবি লিখেছিলেন ‘চিরজীবন মানুষ শুধু মানুষের দিকে ছুটছে ’। কিন্তু গাড়ি সমাজের এ কোন নিয়ম।
সবাই কেন এভাবে ছুটবে ? একটা অবান্তর প্রশ্নের মানে খুঁজতে গিয়ে অন্য প্রশ্নগুলোর উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে, হয়তো পাওয়া যাবে না। যাত্রীদের একজন আরেকজনকে বলছে - ‘এখন এদেশে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের গায়েও গ্রেনেড মারা হচ্ছে’। এমন সময় একটা সবুজ আমাকে ওভারটেক করল। সবুজের ড্রাইভার চিৎকার করে বলল - ‘তোর চাক্কার পাম্প নাই’। ঘেন্নায় আমার বুক ফেটে যায়।
শালা হিংসুক। খেল দেখায় আমাকে। দুবেলা ভাড়া না পেলেও যে কষ্ট হয়না, অপমানের বোঝা তার চেয়ে বেশী মনে হয়। আচমকা আমার ড্রাইভারের মুখ ফসকে বেরিয়ে যায় - ‘তোর মার নেক অক্কলের ও ফাম গেয়েগোই’।
পথে কিছু স্বজাতিকে তীর্থের কাকের মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।
কেউ কেউ পাশ কাটিয়ে চলে গেল। কারো কারো শরীরের অবস্থা খুব খারাপ। প্রকৃতির অকৃপণ হাতে সাজিয়ে দেওয়া সবুজের মাঝে একটু একটু করে হলুদ এগুতে থাকে। যে যন্ত্রগুলো পানিতে ভাসে। এক বন্দর থেকে অন্য বন্দরে নোঙ্গর ফেলে।
যাদের জীবনটা-ই পানি। তাদের অনেককেই অলস ভাসতে দেখা যায়। এখানে, এ বন্দরগুলোতে যে যন্ত্রগুলো ভাসে তাদের না-কি এক মন্ত্রী আছে। মনুষ্য সমাজের প্রচলিত বাক্য - ‘গরু মেরে জুতো দান’ টাইপের এক নতুন বাক্য ‘পানিতে ডুবিয়ে ছাগল দান’ ঐ মন্ত্রী মহোদয়ের কল্যাণে নাকি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যাত্রীরা বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে থাকে।
হাবিয়া দোজখ থেকে কতগুলো সদ্যমুক্তি প্রাপ্ত মানুষ লোনা বাতাসে তাদের ভাল লাগাকে মেলে ধরছে।
অনেক সময় পার হওয়ার পর যাত্রীদের অপেক্ষা শেষ হয়। যে যন্ত্রগুলো আকাশে উড়ে তাদের একজন উড়ে গেল পশ্চিমের দিকে। সাগরের নোনা এবং হিমেল হাওয়ায় গা ছাড়া ভাব নিয়ে যাত্রীরা নেমে গেল। আশি টাকার চুক্তি পূর্ণতা পেল।
সবুজে সবুজে সয়লাব চারিদিকে। এক সাগর দুঃখ পেরিয়ে আর এক দুখের নদীতে পা রাখলাম। গরীবের যন্ত্র বলে এখন আর আমাদের কেউ ভাড়ায় নিতে চায় না। কিন্তু গরীবিয়ানা তো একটা অবস্থার ভেদ মাত্র। নিত্য পরিবর্তনশীল সমাজে ধনী ও দরিদ্র কি কারো স্থায়ী পরিচয় ? আমি জানি আমার এ প্রশ্নের অনেক উত্তর আছে।
আমি জানি আমার দ্বারা এ পরিবেশের অনেক তি হয়। আমি জানি আমার উঠোনে তিনজনের বেশী লোককে আরাম করে বসতে দিতে পারিনা। আমি আমার জন্য দুঃখ পাই না। আমাদের নিয়ে যাদের স্বপ্ন ছিল। তাদের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা-ই আমাকে ভাবিত করে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।