দীঘিনালা থেকে আমরা যাব সাজেক। সঙ্গে রয়েছেন আরো চারজন। তারা সবাই পাহাড়ি। রাঙামাটি জেলার সর্বউত্তর প্রান্তে সাজেক। বাঘাইছড়ি উপজেলার একটি ইউনিয়নের নাম সাজেক।
সাজেকের লাগোয়া পশ্চিম দিকে দীঘিনালা উত্তরপ্রাপ্ত। সাজেকের পূর্ব দিকে ভারতের মিজোরামের রাজধানী আইজল। পুরো সাজেকই দুর্গম পাহাড়ি এলাকা। উপত্যকায় বাস করে উপজাতী জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগই পাংখো সম্প্রদায়।
ঐ বাস করে উপত্যকায় বসবাস করেন আরও বেশ কয়েকটি সম্প্রদায়ের মানুষ। আমাদের পরিকল্পনা ছিল যতটা পারা যায় হেঁটে সাজেকের ভিতরে চলে যাব। স্থানীয় কারো বাড়িতে বা কোন বৌদ্ধ বিহারে রাত কাটিয়ে পরদিন ফিরতি পথ ধরব। শেষাবধি যদিও সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়নি। সকাল ৮টার দিকে দীঘিনালা থেকে আমরা রওনা দিলাম চান্দের গাড়িতে চড়ে।
গন্তব্য বাগাইহাট। চান্দের গাড়ি চড়ার মজাই আলাদা। পুরোনো জিপ বা উইলিম জাতীয় গাড়িগুলোর সার্থক দেশজ রূপান্তর হোল-চান্দের গাড়ি। পাহাড়ি পথে বিশ্বস্ত বাহন। দীঘিনালা বাগাইহাট পুরো রাস্তাই পাকা।
এক কথায় চমৎকার। পাহাড়ের পরে পাহাড়। তারপরও পাহাড়। বর্ষা ঋতুতে পাহাড়গুলো গাঢ় সবুজে ঢেকে গেছে। পথ কখনো উঠে গেছে আবার নেমে গেছে।
বাঁক এর সংখ্যা কম। সাড়ে ন’টার দিকে আমরা বাঘাইহাট পৌঁছলাম। চারদিকে পাহাড়। এরই মাঝের উপত্যকায় ছোট একটি বাজার। ১৫ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস।
জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতভাবে উত্তোলন করা হয়েছে- অনেক দোকানেই। দীঘিনালা-বাঘাইহাট গাড়িভাড়া জনপ্রতি ৪৫ টাকা। আবারো চান্দের গাড়িতে উঠলাম। এবার যাব মাচালাং। আগের মতই পাহাড়ি রাস্তা।
তবে এ রাস্তার অনেকাংশে ইটবিছানো। বেলা ১১টার দিকে মাচালাং বাজার পৌঁছলাম। বৃহস্পতি ও শুক্রবার মাচালং-এর হাটবার। সপ্তাহে এ দু’দিন শুধু মাচালাং-সাজেক পথে ২/৩টি চান্দের গাড়ি ক’টি ক্ষেপ দেয়। মাচালাং বাজারের নিকটেই আমরা একটি বৌদ্ধ বিহারে উঠলাম।
বিহারে তখন দুপুরের খাওয়ার আয়োজন চলছে। বিহারবাসী ভিক্ষু ও শ্রমণগণ দুপুর ১২টার পর থেকে পরদিন ভোর ৬টা পর্যন্ত আহার গ্রহণ করেন না। তাই তাঁদের দুপুরের খাওয়ার আয়োজনটি বেশ বড় হয়। মজার ব্যাপার হোল-বিহারে কোন রান্না হয় না। এলাকাবাসী পালা করে বিহারে প্রতিদিন খাবার দেন।
সেদিন বিহারে দেয়া হয়েছিল বাঁশ, বেতসহ আরো অনেক অচেনা শাকসবজিসহ সজারুর মাংসের তরকারি। মাচালাং বাজারের হোটেলে নাকি হরিণের মাংস রান্না হয় মাঝে মধ্যে। আমরাও দুপুরের আহার তাদের সাথেই সারলাম।
দুপুর ১২টার দিকে আমরা চান্দের গাড়িতে উঠে বসলাম। এবার সাজেক যাব।
মোট পথ ১৮ কি.মি.। ইট বিছানো হলেও তা বেশ খারাপ। ভাড়া নেয়া হয় ৬০ টাকা। রাস্তার ধারে মাঝেমধ্যে পাহাড়িদের বাড়ি পড়ছে। মাটি থেকে বেশ কিছুটা উপরে বাঁশের মাচা এবং তার উপরে টিন বা খড়ের ছাউনির বড় ঘর।
ভিতরে বেড়া দিয়ে ২/৩টি আলাদা কক্ষ বানানো হয়েছে। এদের পোশাক-পাতিতে রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, যা দেখে অনভ্যস্ত চোখে একটুখানি অস্বস্তি লাগা অসম্ভব নয়। দুপুর দু’টোর দিকে সাজেক বি,ডি,আর ক্যাম্প ও হেলিপ্যাডের মাঝখানে আমাদের নামিয়ে দেয়া হলো। সেখান থেকে হেঁটে গেলাম কমলাক পাড়া। প্রায় ২২/২৩ শত ফুট উঁচু কমলাক পাহাড়ের উপরে কমলাক পাড়া।
৭০/৮০ ডিগ্রি কৌনিক উচ্চতার পথ ধরে কমলাক পাহাড়ে উঠতে হলো। ভিড়মি খেলাম এ পথে সাদা গেঞ্জি-জিন্স-কেড়্স পরিহিত সুশ্রী এক তরুণীকে শুকনো কাঠ বয়ে নিয়ে যেতে দেখে। ওদের গৃহে গিয়ে আরো অবাক হলাম, ঘরে রঙিন টিভি, ডিভিডি প্লেয়ার, মিউজিক সিস্টেম, পানি পরিশোধন যন্ত্র এবং গিটার দেখে। তাদের ডিশ এন্টেনাও রয়েছে। এগুলো চালানো হয় সৌর বিদ্যুতে।
ডিস্কগুলো ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার। পরিবারটি পাংখো। এরা পাহাড়ের উপর দিকে থাকতে পছন্দ করে।
এরা এখন খৃষ্টধর্মগ্রহণ করছে। এ পাহাড় থেকে ভারতীয় অংশের রাস্তা দেখা যায়।
কাপ্তাই হ্রদের কিছু অংশও দেখা যায়। কমলাক পাহাড়ে বিদায় নিয়ে বিকেল চারটার দিকে বিডিআর ক্যাম্পের সামনে এসে জানলাম শেষ গাড়িটি অনেক আগেই মাচালাং চলে গেছে। এ পথে আবার চান্দের গাড়ি চলবে পরের বৃহস্পতি-শুক্রবার। আমাদের ৪ জন বন্ধুই পাহাড়ি, যাদের একজন আবার মাচালাং বাসী। তার নেতৃত্বে বিডিআর ক্যাম্পের পাশ দিয়ে পাহাড়ি পথ ধরলাম।
পাহাড়ের গা ঘেঁষে চড়াই উৎড়াই, পাকদন্ডীর পথ, কোথাও সরু কোথাও বা পিচ্ছিল, কোথাও ঘনজঙ্গলে অন্ধকার, ঝিরি, নালা পেরিয়ে ২ ঘন্টায় প্রায় অর্ধেক পথ অতিক্রম করে মূল রাস্তায় উঠলাম। পরে আরো ২ ঘন্টা হেঁটে মাচালাং ফিরে এলাম। আমাদের দু’জনের শরীর তখন অসার। প্রতিটি পেশি, প্রতিটি জোড়ায় দারুন ব্যাথা। সে রাত মাচালাং এ থেকে পরদিন আমরা ঢাকার পথ ধরলাম।
বাঘাইহাট থেকে সাজেক পর্যন্ত ৩৫ কি.মি. পথের নির্মাণ কাজ বেশ দ্রুত গতিতে চলছে। হয়ত ২/৩ বছরের মধ্যেই এই চমৎকার রাস্তাটি তৈরী হয়ে যাবে। সাজেকে বিদেশী পর্যটকদের সহজেই আকর্ষণ করা সম্ভব। কেননা সাজেকে মিজোরাম-ত্রিপুরার মিশ্র আমেজ পাওয়া যায়। সাজেক বেড়াতে গেলে পাহাড় প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবেন যে কেউ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।