পাখি এক্সপ্রেস
আর আমারে মারিসনে মা…
বলি মা তোর চরণ ধরে, ননী চুরি আর করবো না
আর আমারে মারিসনে মা, ননীর জন্য আজ আমারে মারলি মা গো....
সামিউল মরে গেলো। আরো অনেক সামিউল, সামিউলের বাবা, মা মারা যাবে। এগুলো একেকটি ঘটনা। কিন্তু এসব ঘটনা যদি মহামারির ইংগিত দেয়, তবে তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ হয় বৈকি! সামিউল একজন পুরুষ। পুরুষ মানেই কেবল পুরুষ নয়।
পুরুষ মানে অনেক কিছু। বেশি কিছু; ধরুন, একটি মানুষের চেয়েও বেশি। সামিউলও পুরুষ এবং সামিউলের মৃত্যুতে পুরুষের ইন্ধন ছিলো আর নারীর ছিলো প্রয়োজন। আড়ালে আবডালে মানুষগুলো হা হায়ে তাকিয়ে আছে; তাকিয়ে থাকে। সামিউলের মৃত্যুর পর তার নানার শোক দেখার খুব ইচ্ছে হলো।
নাতির মৃত্যুতে বেশি শোকাহত নাকি একজন পুরুষের পতনে ব্যথিত, শংকিত? এমনও হতে পারে সবকিছুকে ছাড়িয়ে সামিউলের মায়ের জন্ম নিয়ে স্ত্রীর প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করছেন! এটা ঠিক যে, আদরের হুমায়রা এখন আর আপন মেয়ে নয়, বরং স্বাতন্ত্রিক এক নারী। যে কিনা জাহান্নামের আগুনের উদ্বোধনী মাধ্যম। অস্পৃশ্য, ঘৃণ্য এক অপয়া মাত্র।
সামিউল, প্রথম তোমার মা একজন নারী, তারপর সে একজন ধর্মীয় বিশ্বাসী। নারী মানে ‘মানুষ’ এর দ্বিতীয় সংখ্যা।
অপেক্ষাকৃত দুর্বল, কোমল। ধর্মীয় বিশ্বাসী মানে তোমার মা একটি জীবন বিধানে বিশ্বাস করে। যেখানে পাপ এবং পূণ্যের মারপ্যাঁচ আছে, অতপর বিচার পরবর্তী ফলাফলে শাস্তি এবং পুরস্কার আছে।
তোমার মা যখন তোমার বয়সে ছিলো, তারও আগে থেকেই অন্তত ন্যাংটা হয়ে বাবার সামনে আসতে পারতো না। কিন্তু তুমি আরো বড়ো হয়েও তোমার মায়ের সামনে আসতে পারবে।
তোমার মা তার বাবার সামনে আসলে কি উনি যৌনভাবে উত্তেজিত হয়ে যেতেন? মেয়ের কোমলতায় যৌনান্দ্রীয় জাগ্রত হলে পাপ হবে। এই পাপবোধ থেকে ন্যাংটা হয়ে সামনে আসতে মেয়ের বারণ ছিলো। এভাবে তোমার মা ঘরের ভেতর লুকিয়ে জামা পরতো, লুকিয়ে খেতো, লকিয়ে আয়না দেখতো, সাজগোজ করতো। কেন এই লুকিয়ে অথবা পালিয়ে অথবা নিজেকে বিধানমাত্রার ঢাকনায় রেখে চলতে হতো? চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত এতো লোভ, সুখ, লজ্জা কে ঢেলেছিলো? হুমায়রা এসব বার্তা কোথা থেকে পেয়েছে? তোমার মায়ের ঋতুস্রাব শুরুকে কেন্দ্র করে আয়োজন ছিলো। হয়তো তাকে হলুদ শাড়ি পড়িয়েছিলো, নয়তো লবনমুক্ত পায়েস খেতে দিয়েছিলো।
এসব বিষয়ের বিশেষনে কোন বিজ্ঞান ছিলো না, ছিলো না কোন শিল্প। এসবে কেবলই পুরুষের যৌনসুখ ছিলো। তুমি নিশ্চিত থাকো সামিউল, তোমার পুরুষ নানা আরেক পুরুষের ভোগের উপযোগী করেই তোমার মা’কে বড়ো করে তুলেছেন। যদি তোমার একজন কালো চামড়ার মামা থেকে থাকে, তবে তাকে শারিরীকভাবে শক্তিশালী এবং উপার্জনমুখী করার জন্য অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছে। আর যদি তোমার কালো চামড়া খালা থেকে থাকে, তবে তার চামড়া ফর্সা এবং কোমল করার জন্যই বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে।
মেয়ে, তোমার এখানে সুখ আছে, এখানে রস আছে, এখানে গভীরতা আছে, এখানের চাইতে এখানের শিহরণ বেশি, এখানের জামা টাইট হবে, ওখানের জামা ঢোলা হবে, এখানে এরং, সেখানে ওরং- এসব শিক্ষা তোমার মায়েদের জন্য খুব প্রয়োজনীয় ছিলো। তোমার মা এবং খালাদের মস্তিষ্কে কুন্ডলী পাকিয়ে দিয়েছিলো একটি গন্ডি। তোমার বাবা, মামাদের পুরুষত্ব জড়িত ছিলো যুদ্ধ, কর্ম এবং বিদ্যায়। তোমার মায়ের চোখের ব্যকরণ ছিলো এক মহাকাব্য, বুকের উষ্ণতা ছিলো এক পৃথিবী শীতে এক প্রশান্ত আগুনের তাপ। তোমার পূর্ব পুরুষদের খোলা বুকে ছিলো শক্ত পেশীর সুগঠন কাব্য, আর তোমার পূর্ব রমণীদের বুকে ছিলো পুরুষদের শিশ্নোত্তেজক মাশালা।
এভাবে তোমার ফর্সা মায়ের জন্য ডাক্তার, প্রকৌশলী পাত্রও হয়তো তোমার নানার বিবেচনা আচারের স্বীকার হয়েছিলো, আবার হয়তো তোমার কালো চামড়ার খালার জন্য মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী যুবকই যথেষ্ট ছিলো।
তোমার বাবার হাতে পায়ের কয়েকটা নখ না থাকলেও চলবে। রমনী সংশ্লিষ্টতায় শিশ্নের অস্তিত্ব এবং কার্যকারিতাই মূখ্য ছিলো। কিন্তু তোমার মায়ের ক্ষেত্রে চুল থেকে নখ পর্যন্ত সবকিছুর জন্য অপেক্ষা করে হাজার হাজার বিশেষন। কারণ পুরুষরা এ পৃথিবীর ইজারা নিয়েছে এবং এ কঠিন দ্বায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নারীকে নিয়েছে মোটের উপর শান্তি প্রদায়ক হিসেবে।
তুমি আরো অস্বীকার করেছিলে তোমার অস্তিত্বকে। ভুলে গেলে এ পৃথিবীতে তুমি ভীষণ একা। এভাবে সবাই। তুমি কেন ননী চুরি করতে গেলে! তোমার মা তার প্রয়োজনে স্বামীর সাথে চুক্তি ভঙ্গ করেছে, যেভাবে করেছে তোমার বাবা। তুমি তোমার প্রয়োজনে সব দেখেও না দেখার ভান করতে পারতে।
ভেতরে ভেতরে বুঝে নিতে বাবা কেবল বাবাই নয়, আলাদা একজন মানুষ। মাও কোন আশ্রয় নয়, আলাদা এক মানুষ। সামিউল আশেপাশে যতো মমতা দেখেছো, স্নেহ দেখেছো এসব মিথ্যা এবং মিথ্যা। ভুল করেছো বাপ আমার, কঠিন ভুল করেছো।
তোমার মায়ের আশেপাশে অনেক শকুণ ছিলো, যা তোমার মাকে বেড়ে উঠতে দেয়নি।
ছোটবেলায় মা হুমায়রা যখন সিনেমা দেখতো, প্রিয় নায়ক কোন দৃশ্যে নায়িকাকে বলছে - এ হাতে অস্ত্র মানায় না, চুড়ি মানায়। তারপরদিনই তোমার মা হয়তো চুড়ি কেনার বায়না ধরেছিলো। কলমের চাইতেও বড়ো অলংকার হয়েছিলো চুড়ি। সামিউল এসবকিছু পুরুষদের যৌন উত্তেজনাকে গাঢ় করার জন্য, সমৃদ্ধ করার জন্য।
লিখতে লিখতে এতোদূর আসার পর তুমি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছো- তোমার মা তার শরীরের বাইরে খুব কমই ভাবতে পারতো।
অল্প কিছু শব্দের মাঝে তার সাহিত্য, অল্প কিছু গল্পের মাঝে তার জীবন। জীবনের সব চাওয়া পাওয়া শরীরকে কেন্দ্র করে ছিলো। মান, অভিমান, হাসি, কান্না, উৎসব সবকিছুই শারিরীক ছিলো। চাওয়া পাওয়ার হিসেব কষতো শরীর দিয়ে। এটা তুমি এভাবে বুঝে নিবে, বাবার অবহেলার অন্য সব কিছুকে ছাপিয়ে তোমার মা শরীরে মর্দন নেয়ার জন্যই আরিফের কাছে গেলো।
বলো সামিউল, অন্য কিছুর অভাব ছিলো? তুমি ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা চালাতে বলে তোমাকে সরিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হলো। কিন্তু সামিউল, এমনও হতে পারতো যে, কেবল তোমার মুখের দিকে চেয়ে হুমায়রা শারিরীক স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে স্বামীর অবহেলা মেনে নিতো। কিন্তু তা সম্ভব হতো না। কারণ তোমার মায়ের টাকার অভাববোধ ছিলো না। টাকার অভাববোধ থাকলে অপেক্ষা করতো ছেলের বড়ো হওয়া পর্যন্ত।
অভাববোধ কেবলই যৌনতায় ছিলো। ভাবতে থাকো মায়ের ধর্ম নিয়ে এবং পাপবোধ নিয়ে। মনে করো আমাকে কেউ বললো তোমাকে খুন করতে। অসম্ভব পাপবোধ আছে বলে জবাব দিলাম, “না আমি সামিউলকে খুন করবো না”। প্রশ্ন আসলো কেন? “আমার পাপ হবে”।
হ্যাঁ পাপ হলে আমি নরকে যাবো, নরকে গেলে শাস্তি পাবো এবং অন্যদিকে স্বর্গ হাতছাড়া হবে। কিন্তু তোমার মায়ের প্রয়োজন যে তার পাপবোধকেও ছাড়িয়ে গেলো! তাতেইতো তোমার মৃত্যু ঘটলো।
তোমার মৃত্যুর পর অনেকে হুমায়রার পরকীয়া জনিত অপরাধ এবং তোমাকে মেরে ফেলার অপরাধকে আলাদা করার চেষ্টা করেছে। বিষয়টা এমন যে, পরকীয় সে করতেই পারে, কিন্তু “নিজ” সন্তানকে মেরে ফেলার মতো পাপ সে কিভাবে করলো! সামিউল, সমাজে কিছু পুরুষ আছে, যারা নারী, পরকীয়া, কাজের মেয়ে, নায়িকা এসব শব্দ শুনে যৌন উত্তেজনা পায়। কিছু পুরুষ আছে, যারা রাস্তার যে পাশে সুন্দরী মেয়ে হাটে, অনেক দূরত্বে থেকে তার পিছু হাটতেও আরাম পায়।
গরম, নরম, কোমল, উঁচু এসব শব্দে তাদের খিঁচুনি আসে। কয়েক হালি আধুনিক মানুষ, যারা চুক্তিভিত্তিক বিয়ে করে না। স্বাধীন যৌনাচারে অভ্যস্ত। কিন্তু যৌনাচারের সংগী হিসেবে স্বাধীন যৌনাচারীকে কামনা করে না। আরেকজনের চুক্তিবদ্ধ যৌনসাথীকে হাতিয়ে নিতে ব্যস্ত থাকে।
মূলত তারাই সামাজিক চুক্তিভিত্তিক দাম্পত্যজীবনের এই দেশে পরকীয়াকে হালকা অপরাধ বলে মেনে নেন। এসব পুরুষালী আচার। তোমার বুঝে উঠার বয়স আসার আগেই চলে গেলে।
চুক্তি সম্পর্কে তুমি হয়তো কিছুই জানতে না। তোমার বাবার সাথে তোমার মায়ের খুব মোটাসোটা এক চুক্তি ছিলো।
এ চুক্তিনামায় বড়ো অংকের টাকার বিষয় ছিলো। যা তোমার বাবা তোমার মাকে দিবে। কেন দেবে? দিবে এজন্যই যে, তোমার মা সারা জীবন তোমার বাবার সংসারে কাজ করবে, তোমার বাবার শয্যাসংগী হবে এবং তোমাকে জন্ম দিবে। আর তোমার মায়ের পক্ষের শর্তগুলো ছিলো, তোমার মায়ের ভরনপোষণের ভার নিতে হবে, তোমার মা যেন অন্য পুরুষের দ্বারস্থ হতে না হয়, সে হক আদায় করতে হবে। ছোট্ট একটি কথা বলে রাখি।
তোমার বাবাকে কিন্তু চুক্তির বড়ো অংকের টাকাগুলো দিতে হয়নি। কারণ পুরুষরা একটি ধারা প্রবর্তন করেছে, যে ধারায় কোন নারী যদি তার স্বামী থেকে পাওনা দেনমোহর মাপ করে দেয়, তবে সে উৎকৃষ্ট রমনী বলে গণ্য হবে। সে যাই হোক, তোমার বাবা তার স্ত্রীর সাথে চুক্তি লংঘন করেছে। তাই তোমার মাও চুক্তি লংঘন করেছে। এতোক্ষণে নিশ্চয় পুরুষদের কর্তৃত্বপরায়নতার নিকৃষ্ট সব উদাহরণ দেখতে পেলে।
এবং তোমার মা কেবলই সুখ, কোমল, নরম, উষ্ণতা। তোমার মা কেবলই গভীরতা, জড়তা, লজ্জা।
তোমার মা’কে অভিশাপ দাও, কেন তিনি রেফ্রিজারেটর থেকে তোমাকে বের করে নিলেন। ওখানেই অনেক শান্তি ছিলো, না! জমে থাকার মতো শান্তি।
সামিউল, সন্তান আমার; তোর মৃত্যুতে পুরো শরীরমন জুড়ে তীব্র অশান্তিতে আছিরে।
সামিউল, এসব পড়ার পর যদি তোমার পৌরষে আঘাত লাগে, তবে আমি দু:খিত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।