আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিশ্বকাপে বাঙালি

কবিতা লিখি, প্রবন্ধ লিখি, গল্প লিখি, রম্যরচনা লিখি, মানে লেখার চেষ্টা করি আর কী!

সম্ভবত দুই বঙ্গেই ব্রাজিলের সমর্থকই সবচেয়ে বেশী। মারাদোনার জন্যে আর্জেন্তিনা আর জিদানের জন্যে ফ্রান্স বেশ কিছুটা ভাগ বসিয়েছে, এ ছাড়াও জার্মানীর ভক্ত কলকাতা শহরে (সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে) বহুদিন ধরেই ছিল ও আছে। বলা হয়, বাঙালির সৌন্দর্যপ্রীতির কথা, বলা হয়, বাঙালি “ট্রাডিশনালি শৈল্পিক মনোভাবাপন্ন” - কথা হচ্ছে বাঙালিরা এই ব্রাজিলের এই সুন্দর ফুটবলের কথা জানলো কী করে? ব্রাজিল যখন দাপিয়ে বেড়িয়েছে, ফুটবল পায়ে ঘাসে ফুল ফুটিয়েছে (মূলতঃ ১৯৫৮ থেকে ১৯৭০) তখন তো টিভি ছিল না। তার মানে খবরের কাগজের রিপোর্ট পড়ে ওই শিল্পের খবর পেয়েছে আর কী। ঘরে ঘরে টিভি আসার পরে ব্রাজিল কাপ পেয়েছে দু-বার, ১৯৯৪ আর ২০০২ এবং সে সময়ের ব্রাজিল শিল্প থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে, সৌজন্য ১৯৮২ তে ইতালির পাওলো রোসির হ্যাট্রিক, ব্রাজিলের বিরুদ্ধে (এই ১৯৮২ তেই মারাদোনা ব্রাজিলের বিরুদ্ধে খেলায় লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন।

এই খেলাটা আমি যতদূর মনে পড়ছে বাংলাদেশ টিভি তে দেখেছি)। কোনও সন্দেহ নেই, রোমারিও, বেবেতো, রিভাল্ডো, রোনাল্ডো ব্যক্তিগত নৈপূন্যে (১৯৯৪ ও ২০০২) খেলাটাকে একটা অন্য স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু এ সময়ের ব্রাজিল আসলে, আগে ঘর সামলাও, পরে শিল্পে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছে। এমন কী ১৯৯৮ এ ফাইনালে “রোনাল্ডোর অজানা জ্বর”, জিদানের অনবদ্য দু-টো গোল, এর আগেও সেই ব্রাজিলকে দেখা যায়নি, যেমনটা শোনা যেত/যায় তাঁদের সম্বন্ধে। মাঝের সময়টুকু, ১৯৭৪ এ নেদারল্যান্ডের টোটাল ফুটবল, জোয়ান ক্রুয়েফ, জার্মানীর বেকেনবাউয়ার (আক্রমনভাগের খেলোয়াড় না হয়েও সেরার শিরোপা), ১৯৭৮, আর্জেন্তিনার উত্থান, টিভিতে বাঙালির বিশ্বকাপ দর্শন, ১৯৮২, ইতালির চ্যাম্পিয়ন হওয়া, পাওলো রোসির শেষ তিন ম্যাচে ৬ গোল, ১৯৮৬, আর্জেন্তিনা এবং আর্জেন্তিনা, আরও পরিষ্কার করে বললে মারাদোনা এবং মারাদোনা, ১৯৯০, জার্মানীর বিশ্বকাপ, মারাদোনার অভিমানী মুখ। ১৯৯৮, ফ্রান্স, মোর স্পেসিফিকালি জিদান, এবং পরে ২০০৬, ইতালির জয়, জিদানের দুর্দান্ত ফুটবল এবং দুঃখজনক পরিসমাপ্তি।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, যত সময় এগিয়েছে, ব্রাজিল তার শিল্পময় ফুটবল থেকে সরে গিয়ে, আগে জয়, পরে শিল্প এই ভাবনাকে আঁকড়ে ধরেছে আরও বেশী করে। বাঙালি শিল্প ভালোবাসে তার প্রমান পাই, মারাদোনাকে নিয়ে এত উদ্দাম হতে দেখে। আবার কিছুটা একচোখামী মনে হয়, যখন জিদানকে সে পর্যায়ের স্বীকৃতি দেয়া হয় না, যদিও বিশ্বকাপে জিদানের অবদান মারাদোনার থেকে কোনও অংশে কম নয় বলেই মনে করি। আমার কখনও কখনও মনে হয়, বাঙালির ব্রাজিল প্রীতির পিছনে দু-টো বড় কারন আছে। ১) ওঁদের গায়ের রঙ (বেশীর ভাগ খেলোয়াড়ই কালো)।

এই পথ দিয়েই ক্রিকেটে সে সময়কার ওয়েষ্ট ইন্ডিজ বাঙালিদের সবচেয়ে প্রিয় ছিল। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, আরে গায়ের রঙ কালো এমন খেলোয়াড় তো আরও অনেক দেশে আছে, তবে তারা কেন এই “প্রিয়” তালিকায় নেই। ঠিক এইখানেই আমার দ্বিতীয় সম্ভাবনাটা উঁকি দিয়ে যায়। বিজয়ী দল। বাঙালি যাঁরা জেতেন, তাঁদের (গায়ের রঙ সাদা হলে অতটা নয়) ভালোবাসেন, পছন্দ করেন, তাঁদের হয়ে গলা ফাটান।

আজ আমরা যারা খেলা দেখি, তারা সবাই, কেউ প্রত্যক্ষে, কেউ পরোক্ষে বিশ্বকাপটা শুরু করি ওই ১৯৫৮ থেকে এবং যখন দেখি ৫৮ থেকে ৭০ এর মধ্যে একটা দল তিনবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, (সে সময়েই পেলে নামক মিথের উত্থান, যেটা বাড়তি তাগিদ তৈরি করে) তাঁদের এমনিতেই “প্রিয়” বানিয়ে ফেলি। ক্রিকেটেও ওয়েষ্ট ইন্ডিজ বাঙালির প্রিয় ছিল ওই জয়ের কারনে এবং সঙ্গে কানের কাছে এটাও গুনগুন করে বাজত, আহা, দেখ, একদা অত্যাচারিত এই “কালো গুলো” এখন “সাদা-দের” কেমন মুখের উপর জবাব দিচ্ছে। আজ ওয়েষ্ট ইন্ডিজ হেরো দল, ফলে বাঙালি আর তাঁদের নিয়ে ভাবে না। এমন কী বিশ্ব রাজনীতির দিকে তাকালে দেখতে পাবো, কালো মানুষের প্রতিনিধি নেলসন ম্যান্ডেলা বাঙালির কাছে যে আদর, যে সন্মান পান, তা বোধহয় তিনি পৃথিবীর আর কোনও দেশ থেকে পান না। নেলসন ম্যান্ডেলাও, মনে রাখবেন, বিজয়ী।

তাই এত উল্লাস, তাই এত ভালোবাসা। এবার প্রশ্ন উঠতেই পারে, বাঙালির কলকাতা শহরে তবে কেন এত জার্মান প্রীতি (একসময় এই বাংলায় ব্রাজিলের পরেই জার্মানীর সবচেয়ে বেশী সমর্থক ছিল), তাঁরা তো সাদা। এখানেও বাঙালির বিশেষ করে ও পার বাংলার মানুষের চরিত্রের আরেকটা দিক লুকিয়ে আছে। লড়াই, বাঙালি (বিশেষ করে ও-পার বাংলার লোকজন, পশ্চিমবঙ্গে যাঁদের “বাঙাল” বলা হয়। আমিও সেই দলেই পড়ি আর কী।

) লড়াই ভালোবাসে, যেটা সে খুঁজে পায় জার্মানীর মধ্যে। এই হার না মানা মনোভাবটা কলকাতার ক্লাব ফুটবলে ইষ্টবেঙ্গল ক্লাবে ছিল বলে, ইষ্টবেঙ্গল সাপোর্টারদের আজও “জার্মান” বলে হয়। বিশ্বকাপের আঙিনায় জার্মানীর থেকে বেশীবার বোধহয় কেউ সেমি-ফাইনাল পর্যায়ে যেতে পারেনি। বিশ্বকাপ ফুটবলে জার্মানী - ১৯৩৪ - তৃতীয় ১৯৩৮ এর পরে আবার বিশ্বকাপ শুরু হয় ১৯৫০-এ ১৯৫৪ - চ্যাম্পিয়ন ১৯৫৮ - চতুর্থ ১৯৬৬ - রানার্স ১৯৭০ - তৃতীয় ১৯৭৪ - চ্যাম্পিয়ন ১৯৮২ - রানার্স ১৯৮৬ - রানার্স ১৯৯০ - চ্যাম্পিয়ন ২০০২ - রানার্স ২০০৬ - তৃতীয় উপরের তথ্যটাই যথেষ্ট জার্মানীর ফুটবল দলের পারফরমেন্স বলে দেবার জন্যে। কিছুদিন আগেও সাধারণ জন আমরা, ব্রাজিল, আর্জেন্তিনা, জার্মানী, ফ্রান্স এই দলগুলোকে যে ভাবনা থেকে সমর্থন করতাম, এখন তারও পরিবর্তন হয়েছে অনেকটা।

এর জন্যে দায়ী টিভিতে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড, চেলসি, বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ খেলা দেখা। এখন ঘরে ঘরে এই সব দলগুলোর সাপোর্টার তৈরি হয়ে গেছে এবং এই সব দলের বিখ্যাত খেলোয়াড়রা যে দেশের হয়ে খেলেন, সে দেশও বহুক্ষেত্রে এই সাপোর্টারদের সমর্থন পান। মানে ব্যাপার জটিল। মানে, এই সমর্থনের পিছনে নির্দিষ্ট করে একটা-দুটো কারন যথেষ্ট নয় বলেই মনে করি। আপনারা কী বলেন?



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।