আপাতত ঘুরপাক খাচ্ছি!
১
ঝকঝকে তকতকে সুন্দর একটি রেলষ্টেশন। চারিদিকে বেশ ছিমছাম গোছালো ভাব। এত সুন্দর রেলষ্টেশন এর আগে কখনও চোখে পড়েনি। অনেকে প্রিয়জনকে বিদায় দেয়ার অপেক্ষায় আছে। তাদের চোখেমুখে উৎকন্ঠার ভাব।
আবার কবে দেখা হবে-হয়ত হবেনা। অনেকে অপেক্ষায় আছে প্রিয়জনের আগমন হেতু। তাদের অবয়বে প্রতীক্ষার রেশ। কখন আসবে ট্রেন। দেখা হবে প্রিয়জনের সাথে।
কাছে আসা হবে, কুশল বিনিময় হবে। প্রতীক্ষার রেশ থাকলেও আনন্দরেখা চিকচিক করছে তাদের নেত্রপটে। আমি ঠিক কার জন্য অপেক্ষা করছি? মনে পড়ছে না। উপরন্তু শীতের সকালে মৃদুমন্দ বাতাসটা ভাবনাটাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। হ্যা----হ্যা-----মনে পড়েছে।
আমিও একজনের অপেক্ষায় আছি।
২
ষ্টেশনের শেষ প্রান্তে গিয়ে বসলাম। যে পথে ট্রেনটি আসবে। ট্রেন লাইন বরাবর তাকিয়ে আছি। মনে পড়ে গেল সেই হারানো স্মৃতি।
রাজধানীমুখী গ্রামের এই ছেলেটি। হাতে সমরেশ মজুমদারের উত্তরাধিকার বইটি। বইয়ের পাতা থেকে ডুয়ার্স আর দার্জিলিংয়ের চা বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আর মাঝে মাঝে ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে উকিঁ মারছি। এখন হেমন্ত কাল।
বাংলার সবুজ শ্যামল প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর সাথে বইয়ের বর্ণনা মিলিয়ে মন বেশ চঞ্চল।
অতঃপর ফেরীঘাট-এক কেবিনে দুটো হরিণী নেত্র। ঠিক যেন এই নেত্র দুটিকেই খুঁজছি কোন এক অজানা শাল মহুয়ার বনে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কেবিন ছেড়ে ছাদে চলে এসেছে সে। ডাকসাইটে গোয়েন্দাদের মত তার পিছু অনুসরণ করলাম।
নদীবক্ষের সমস্ত হাওয়া যেন তার এলো চুলে হামলে পড়েছে। তার চুলে বিলি কাটতে কাটতে কোথায় জানি হারিয়ে গেলাম। তারপর চোখ মেলে দেখি সে নেই। নিচে তাকিয়ে দেখি তার মাতৃদেবীর সনে ঘুরাফেরা করছে। আমিও অবাক বিস্ময়ে তার পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করছি।
মাতৃদেবী আমার এহেন অপকর্ম টের পেলেন। সন্তানের অদূর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কেবিনে চলে গেলেন।
আমি ছাদে কতক্ষণ বসে ছিলাম মনে নেই। চোখ খুলে দেখি পরবর্তী ট্রেন ধরার জন্য ফেরীর অনেকেই নেমে গেছে, বাকীরাও যাচ্ছে। একটা লম্বা দৌঁড় দিলাম, হাঁসফাঁস করতে করতে ট্রেনে উঠে পড়লাম।
ট্রেনে উঠার পর মন বেশ আনচান। এত লম্বা ট্রেনে কোথায় তারে খুঁজে পাই। বইয়ের মধ্যে মনোনিবেশ করতেও পারছিনা। জানালার বাইরে কাঁধ বাড়িয়ে সামনে পিছনে তাকাচ্ছি। অবশেষে পিছনের কয়েক বগী দূরে এক জানালায় হরিণীকে দেখা গেল।
হাত ইশারা করলাম। প্রতি ইশারাও পাওয়া গেল তাৎক্ষণিক। তার গন্তব্য কোথায় জানিনা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। শঙ্কাও বাড়ছে সমান তালে।
বুকে অনেক সাহস সঞ্চয় করে মাতৃদেবীর চক্ষু ফাঁকি দিয়ে আস্ত বইটাই দিয়ে আসলাম তাকে। আমার গন্তব্যের অনেক আগেই সে নেমে পড়ল। বইটাই রইলো যোগাযোগের শেষ উপায়। অতঃপর একদিন ফোন- যোগাযোগ-কত স্মৃতি।
৩
অপেক্ষারত মানুষের ভীড়ে রেলষ্টেশনের গৌরীমার নিচে একটি শিশুর দিকে নজর পড়লো।
তাকে বেশ বেমানান দেখাচ্ছে এখানে। বয়স আর কত হবে। বড় জোড় দশ বছর। হাতে একটি চকোলেটের ঠোঙ্গা। ইশারায় কাছে ডাকলাম।
হাসিমুখে সন্নিকটে আসলো।
নাম কি তোমার?
-রাজা
বাহ! অনেক সুন্দর নামতো।
আমার কথা শুনে সে প্রীত হলো। দুটি চকোলেট এগিয়ে দিল আমার দিকে। পকেট হাতড়ে দশ টাকা পেলাম।
সে শুধু দু'টাকা চাচ্ছে আমার কাছ থেকে। তার না সত্ত্বেও পুরোটাই তার টোঙ্গার মধ্যে চালান করে দিলাম। যদিবা তার পরিবার এবং সে উদ্ধার পায়। ভবিষ্যতে এই রেল ষ্টেশনে কন্ট্রোলারের চাকুরীটা পেলে আরও অনেক চকোলেট ক্রয় করবো বলে তাকে আশ্বস্ত করলাম আর তৃপ্তির ঢেকুর তুললাম। মনে মনে ভাগ্যদেবীকে আর একবার প্রণাম করলাম "উদ্ধার করো"।
উদ্ধার করো তুমি এ যাত্রায়। হয়ত চাকুরীটা পেলে সম্মান পাশ এই ছেলেটার সম্মান রক্ষা হবে। বাড়িতে আছেন বিধবা এক নিরীহ মাতা। যিনি দুঃখকে সাদা কাপড়ে সঙ্গী করে নিয়েছেন। তার চুলোয় কোনদিন হাড়ি উঠে।
আবার হয়ত উঠেনা। অবিবাহিত ছোট বোনটার বয়স স্বার্থপরের মত বেড়ে যাচ্ছে। পিচ্চি ভাইটার সামনে এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ। ধূর ভাল্লাগেনা।
রাজা পাশে বসো।
-জ্বি স্যার
আসো একটা গান ধরি--------
বসে আছি ইষ্টিশানেতে
লেবু লজেন্সের শিশিটা হাতে
বোকা কোকিলটার গলা শুকিয়ে কাঠ
গাড়ী আজ লেটে দৌঁড়ুচ্ছে
----------------------
----------------------
আরে ঐতো ট্রেনটা এসে গেছে। ঐ ট্রেনটার জন্যই তো অপেক্ষা করছি। যারা নেমে যাওয়ার তারা নেমে গেল। আর যারা উঠার উঠে পড়লো। কিন্তু আমি যার অপেক্ষায় আছি সে কেন নামলো না।
কেন নামছে না----কেনো নামছে না। ট্রেনতো ছেড়ে যাওয়ার সময় হয়েছে। আরে ট্রেনতো ছেড়ে দিলো। হ্যা পেয়ে গেছি তার দেখা। সামনের ঐ জানালায় সেই পরিচিত মুখটি দেখা যায়।
অঞ্জলি -------অঞ্জলি--------সে শুনছে না কেন? সে কি আমাকে চিনতে পারছে না? তার পাশে একজন অপরিচিত লোক দেখা যায়। তার সঙ্গে বেশ উচ্ছ্বল ভঙ্গিতে কথা বলছে অঞ্জলি। ট্রেনের গতি একটু একটু করে বাড়ছে। সঙ্গে আমার গতিও বাড়ছে। অঞ্জলি-- অঞ্জলি-- অঞ্জলি তুমি শুনতে পাচ্ছো না।
দেখো আমি হাঁফিয়ে গেছি অঞ্জলি। আর দৌঁড়ুতে পারছি না। নামার দরকার নেই। শুধু একবার ফিরে চাও। শুধু একটি বারের জন্য ফিরে চাও অঞ্জলি।
৪
-হি হি হি তুমি এত পাঁজি হয়েছো কেন বলোতো?
বাহ রে আমি আবার পাঁজি হলাম কেনো?
-শুধু শুধু ট্রেনের পিছনে দৌঁড়ুচ্ছো।
দৌঁড়ুবোনা। তুমি তো নামতেই চাচ্ছিলা ট্রেন থেকে।
-নামার সময় হয়নি তাই নামিনি।
কিন্তু ট্রেনতো ছেড়ে দিয়েছিল।
-আরে বাহ। তোমার সাথে একটু মজা করেছিলাম। পরের ষ্টেশনে নেমে ঠিকই তোমার কাছে চলে আসতাম।
হুমম। এরকম মজা আর কখ্খনও করবা না।
-ওরে আমার রাগী লোকটারে। অভিমানে গুটুগুটু।
মুখমন্ডলে পানির ঝাপটায় সম্বিত ফিরে পেলাম। পাশে দাঁড়িয়ে রাজা। বেশ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে তাকে।
হয়ত ভাবী চকোলেট ক্রেতার দুর্দশা দেখে বেশ মুষড়ে পড়েছে। তাকে বেশ কয়েকবার বলার পর চকোলেট বিক্রি করতে লেগে গেল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।