গত এক সপ্তাহে রাজধানী ঢাকা ২টা বড় দূর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করল। একটা ভবন ধ্বস এ ২৫ জনের মৃত্যু, আরেকটা আগুনে পুড়ে শতাধিক লোকের মৃত্যু। আপাত দৃষ্টিতে আমরা যাকেই এই জন্য দায়ী করি না কেন, আসলে এসব হচ্ছে সময়ের দাবি। আমরা যেভাবে এই শহরের পরিবেশ নষ্ট করেছি বছরের পর বছর ধরে, এসব ঘটনা ঘটতে বাধ্য। মানুষ যখন প্রকৃতির উপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, প্রকৃতি তখন এভাবেই তার প্রতিশোধ নেয়।
আমি বলব এসব ঘটনা হচ্ছে আমাদের জন্য সতর্ক সংকেত। আমরা সাবধান না হলে আরও বড় প্রতিশোধ অপেক্ষা করছে।
বিয়ের পরে প্রথম নিজের সংসার শুরু করি এয়ারপোর্ট এর কাছে "কাওলা"তে একটা সদ্য নির্মিত দালানে। আমার ঘরের পিছনেই ছিল বিলের বিস্তৃত জলরাশি। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হত যখন প্রচন্ড গরমে বিলের ঠান্ডা বাতাস বয়ে যেত কিংবা বর্ষায় অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ত সারা বিল জুড়ে।
দুই বছরের মধ্যে সেই বিলের অধিকাংশ ভরাট হয়ে গেছে "আশিয়ান সিটি"'র বদৌলতে। এই বিলে মানুষ লিজ নিয়ে বর্ষায় মাছের চাষ করত, শীত কালে বিভিন্ন শাকসব্জি অথবা কিছু ধান। তার উপর এইসব বিল আবাসিক এলাকার পানি নিষ্কাশনের এর একটা সহজ উপায়। মোট কথা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাদেও এইসব জলাধার এই শহরের জন্য আবশ্যিক উপাদান। কিছু সম্পদ লোভী, কুরুচি সম্পন্ন মানুষ এর বদৌলতে এরকম করে ঢাকা শহরের অধিকাংশ জলাধার ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
কাওলা ছেড়েছি ৭ মাস আগেই। এবার এসে উঠেছি একেবারেই বিপরীত পরিবেশে। ট্যিপিকাল ঢাকা শহর এর জ্বলজ্বলে উদাহরন "উত্তর বাড্ডা"; কোটিপতি থেকে শুরু করে রাস্তার ভিখারি, সবাই থাকে এই এলাকায়। এই যেমন আমি যে বাসাটায় ভাড়া থাকি সেটা অতি আধুনিক সুবিধাসম্বলিত ৬ তলা এপার্টমেন্ট আর তার ৩ দিক দিয়ে গিজ গিজ করছে শত শত টিনের চালার বস্তি। জানালা খুললেই শোনা যায় টিউব ওয়েল এর ২৪ ঘন্টা অনবরত শব্দ ( কারন ৮/১০ টা পরিবারের জন্য পানির একমাত্র উৎস একটি টিউব ওয়েল ); যদিও ঢাকা শহরে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন নিষিদ্ধ, কিন্তু কে আছে দেখার? এই এলাকায় গা ঘেষা ঘেষি করে আছে বড় বড় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, আধুনিক এপার্টমেন্ট, ফার্নিচারের কারখানা, নানবিধ ছোটখাট কারখানা আর আছে এসব কারখানায় কর্মরত বিশাল জনগোষ্ঠির জন্য শত শত বস্তি।
এখন শুরু হয়েছে, রাস্তার দুই পাশে ভবন ব্যবসায়ীদের বিশাল বিশাল এপার্টমেন্ট তোলার প্রতিযোগিতা। যেই রাস্তার দুইপাশে এইসব ভবন তৈরী হচ্ছে, তার প্রস্থ হবে বড়জোর ১৫ ফিট। এই বিপুল জনগোষ্ঠির জন্য এই রাস্তা কি যথেষ্ঠ? কয়দিন পর পরই রাস্তার ম্যানহোল খুলে ময়লা পরিস্কার করা হয় (সেই ম্যানহোলের ঢাকনাও লাগানো হয় না) এবং ১ মাসের মাথায়ই সেগুলা সব ভরাট!! আর বৃষ্টি হলে রাস্তার কি অবস্থা হয় পাঠক মাত্রই বুঝতে পারেন। বৃষ্টির পানির সাথে উপড়ি পাওনা বিভিন্ন রঙের বাহারি মানব বর্জ্য। যদিও এসব বর্জ্য সরাসরি স্যুয়ারেজ লাইনে নিস্কাশিত হবার কথা না, তবুও অনেকেই এটা করছেন - বিশেষ করে বস্তি মালিকরা।
এখন ঢাকা শহরটাকে বাসযোগ্য করতে আমরা কি করতে পারি?
১) সবচেয়ে প্রথমেই যে কাজ টা করতে হবে, "ঢাকামুখিতা" বন্ধ করা। এই শহরে আর কোন শিল্প কারখানা তৈরী শক্ত হাতে বন্ধ করতে হবে। ফলে গ্রাম থেকে স্রোতের মত মানুষ আসার হার কমে যাবে।
২) দেশের বিভিন্ন জেলায় ই,পি,জেড এর আদলে শিল্প এলাকা তৈরী।
৩) আবাসিক এলাকার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি গুলোকে ক্রমান্বয়ে অন্যান্য জেলায় স্থানান্তর।
এর জন্য প্রয়োজনে সরকার অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করতে পারে।
৪) ঢাকা শহরের জলাধার ভরাট করে আর কোন প্রকল্পের অনুমতি না দেয়া।
৫) আবাসিক ভবন নির্মানের মত অনুৎপাদনশীল খাতে ঋন প্রদানে অনুৎসাহিত করা। (কোন বুদ্ধিতে যমুনা ফিউচার পার্কের মত একটা বিলাশী প্রযেক্ট-এ সরকার অনুমতি দিয়েছিল সেটা এখনও আমার বোধগম্য নয়)
৬) ঢাকা শহরে একের অধিক বাড়ির মালিকানা'র ব্যাপারে কঠিন শর্ত আরোপ করা। অবৈধ টাকা বৈধ করার আজকাল এইটা একটা ভাল উপায় হয়ে দাড়িয়েছে।
মূলতঃ এদের বেহিসাবি টাকার কারনেই ঢাকা শহরের জমি, এপার্টম্যান্ট এর চাহিদা এবং দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে।
৭) একইভাবে একের অধিক গাড়ির বেলায়ও অনুরূপ ব্যবস্থা নিতে হবে। সি,এন,জি'র বদৌলতে নব্য পাতি বড়লোকের ২/৩ গাড়ির বিলাশিতা এখনি বন্ধ করতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, অনেক হয়েছে, এইবার আমাদের থামতে হবে। শহরটাকে আর নষ্ট করতে দেয়া যায় না।
এটা আমাদের স্বপ্নের তিলোত্তমা রাজধানী, ঢাকা।
অফটপিকঃ সেদিন গিয়ে দেখি এখন আশিয়ান সিটির অফিস পাহারা দেয় আনসার। ওখানে রীতিমত বালির বস্তা দিয়ে বাঙ্কার বানিয়ে যুদ্ধাবস্থায় আনসার জোয়ানরা পাহারা দিচ্ছে। চোর প্রোটেকশন দিতে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবহারের এমন নির্লজ্জ উদাহরন পৃথিবীর আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। আর সবচাইতে আহ্লাদের বিষয় হচ্ছে, কাওলা আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী'র এলাকা, যাকে রাখা হয়েছে চোর ধরার জন্য।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।