আমি তোমায় বুঝেছি সমগ্র বুঝহীনতার ভেতর দিয়ে।
এক.
ময়নাটার নাম খিজির। আমার মায়ের পোষা ময়না। মহাপুরুষ খোয়াইজ খিজিরের নামে নাম। যে কয়েকজন মানুষ কেয়ামত তক বেচে থাকবেন- হযরত খিজির [আঃ] তাদের একজন।
কেন পক্ষীটার এই নাম রাখা হয়েছিলো আমাদের পরিবারের কারো ইয়াদ নাই। এমনকি মা নিজেও জানতেন না। মৃত্যুতে মায়ের খুবই ডর ছিলো। মুত্যু ভয়ে কাতর আমার মায়ের প্রাণ ভোমরা ছিলো বয়সের গাছ-পাথরহীন ময়না খিজির। এই পীর আসল মালিক মা’র কোন এক পর দাদা।
মা তার বিয়ের সময় বাপের বাড়ি থেকে খিজিরকে নিয়ে এসেছিলেন। এইটার তার বিবাহের একমাত্র উপহার।
ময়নাটা ছিলো অন্ধ। গম্ভীর, ভাবুক কিসিমের। কোন ধরনের অসহায়ত্বের লেশ ছিলো না চলন-বলনে।
যার উদ্দেশ্য বিধেয়ের মারেফত জানার উপায় ছিলো না। সদা রহস্যময়। হঠাৎ হঠাৎ তাড়স্বরে ডেকে ঊঠত, “'খিডির”, “খিডির”'। এছাড়া তার কন্ঠ বেয়ে অন্য কোন স্বর নামত না। কে জানে কেন সে খিজিরকে বলত খিডির।
আমরা মাঝে মাঝে খাঁচার কাছে গিয়ে বলতাম, “'খিডির”', “'ও খিডি'র”। পক্ষীটা আরো গম্ভীর হয়ে যেতো। খিজির মা ছাড়া অন্য কাউকে সহ্য করতে পারত না। মা ছাড়া অন্য কেউ তার কাছাকাছি গেলে সে খুবই বিরক্ত হতো। আমরাও বিরক্ত করার সে সুযোগটা নিতাম।
একরক্তি ময়নার এতো দেমাগ কিসের। মা’র সাথে তার কি মায়ার বাধন, মা ছাড়া অন্য কারো হাতে খাবার সে খেতো না। মা’র গন্ধটা সে ঠিকই টের পেত। আশে পাশে মা আসলেই তার জাদুকরী ডানায় ঢেউ খেলে যেতো। জাদুকরী বলছি এই হালে, এই নিয়ে একটা রটনা ছিলো, সে ডানার ঝাপটায় হঠাৎ হঠাৎ বর্ণিল আলো খেলে উঠে।
সে নুরের তজ্জালী যে দেখে তার ভাগ্যের সুরতই নাকি বদলে যায়। লোকে এই ধারণা কই পেলো জানি না, কারণ আমরা কেউ কখনো সেই নুরের তজ্জলি দেখিনি। তয়, আমার মা’র পানভর্তি মুখ সারান আনন্দে ঝলমল করত। সেই নুরানী আভা আমাদের ঘরময় মেঘের মতো উড়ে বেড়াত। শুধুমাত্র যেদিন না মা মৃত্যুর ভয়ে কাতর হতেন।
হযরত খিজির [আঃ] দুনিয়ার বাদশা জুলকারনাইনের সাথে পৃথিবীর শেষতক অভিযানে গিয়েছিলেন। সেটা ছিলো সূয্যাস্তের প্রান্তরে। এখানে সূয্য একটা গর্তের মধ্যে ডুব দিলে, পৃথিবীতে রাত্রি নামে। সেখানকার কাক পীরা জানত অমরত্বের হদিস। খিজির অমরত্বের জল পান করে অদৃশ্য হয়ে গেলেন আবার জীবিত রয়ে গেলেন কেয়ামততক।
জলে তার বসত, জলে তার নানান কারিগরি। জলের মানুষেরা সেই কেরামতির খোজে ভক্তি নিয়ে তারে ডাকে। কেউ কখনো তার ডাকের সাড়া পেয়েছে কিনা জানি না- তবে লোকমুখে শুনেছি ভক্তি ভরে তার স্মরণ নিলে অনেক অসাধ্য সাধন হয়। এই বিশ্বাসের গৌরব আমার কাছে স্পষ্ট না। কিন্তু নানা বিপদ-আপদে কেন যেন খিজিরকে মনে পড়ত।
আমার বাবা আবার এমন ভক্তিতে বিরক্ত হন। আমার ছোট কাকু জাহাজের সারেং। তার কাছে অহরহ এমন কথা শুনতাম- মনে হতো খিজির [আঃ] ছাড়া তার দুনিয়া অচল। তাই তিনি খিজির নামটারে বিকট ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন। তারে বরাবরই ভীতু মনে হয়।
এতো ভীতু মানুষ সমুদ্দুরের মতো ভয়াবহ স্থানে দিশা পায় কেমনে, সেটাই তাজ্জব ব্যাপার। তার জাহাজ চলে খিজিরের ইশারায়, এটা তার বিশ্বাস।
বাবা ছোট কাকুকেকে বলতেন, “ 'ছোট, আওয়াল আখেরের চিন্তা কর- এই ধরাধরিতে কোন কাজ হবে না”'।
চাচা বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসতেন। মনে হতো তিনি বাবার নিবুদ্ধিতায় মজা পাচ্ছেন।
আর গলায় ঝুলানো তাবিজে হাত বুলাতেন। আমরা এইসব না বুঝে বেশ মজা পেতাম। কখনো কখনো দুই খিজিরের তুলনা করতাম। হযরত খিজির [আঃ] দুনিয়ায় অদেখা আর দুনিয়া খিডির থেকে অদেখা। মিল-অমিলের যে দুনিয়া, সেখানে কে পী আর কে মানুষ তার ভেদ চিহৃ কই? এই ভেদ আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে ধরে না।
এমনকি আমার মা’'রও। তিনি যখন খিজিরের সাথে মিষ্টি করে কথা বলতেন, এই ভেদ উবে যেতো।
মা খাচার কাছে গিয়ে বলতেন, ”'খিজির ও খিজির'। ”
খিডির, শিস দেয়ার মতো একটা শব্দ করত। অতি আনন্দে নিশ্বাস ভারী হয়ে আসলে আমরা যেমন করি আর কি।
ইস্, কথা বলা ছাড়াও পীর বুঝি মানুষের মতো নানা গুণাগুণ আছে।
মা আবার বলেন,“ 'খিজির, আমার সোনার ময়না পক্ষী'। ”
পাখিটা খুশিতে ডানায় শব্দের ঝড় তুলত।
এই খাই খাতির দেখে মাকে বলতাম, “ 'মা, খিজির তো তোমারে ছেড়ে যাবে না। তারে খাঁচার ভেতর বন্দী করে রাখার দরকার কি'?”
মা বলতেন, “ 'পোষ মানা কিছুরে খাঁচার বাইরে রাখতে নাই।
তুই আমি কেউই খাঁচার বাইরে না। খাঁচা না থাকলে প্রেম-পিরীতি, মায়া-মহব্বত কিছুই থাকে না। খাঁচা না থাকলে কেমন উদাস উদাস লাগে। শুধু উড়াল দিতে ইচ্ছে করে। তাই সবাইরে খাঁচার ভেতর থাকতে হয়'।
”
আজব সে কথা শুনে বলি, “ 'খাঁচা মানে কিসের খাঁচা? আমি তো কোন খাঁচার ভেতর নাই'। ”
মা বলেন, “ 'এই হলো মায়ার খাঁচা। এই খাঁচা চোখে দেখা যায় না। আর খিজিরের খাঁচা তো ওপরের জিনিস। এই খাঁচা চাইলে সে ভাঙ্গতে পারে।
কিন্তু মায়া তারে ভাঙ্গতে দেয় না'। ”
আমি সেই মায়ার খাঁচার হিসেব নিকেশ করতাম। কিন্তু সেই অদেখা খাঁচা অধরা রয়ে গেলো।
বাবা বলতেন, “ 'এই হলো তার ভাবের কথা। ভাবের কথা সবসময় মনে রাখতে নাই।
সময়ে সে আপনা আপনাই ধরা দে'য়। ”
ভাব বড়োই মুশকিলের আনজাম করে। তাই কোনটারে ঠিক আর কোনটারে বেঠিক বলব, তার উপযুক্ত মওকা সবসময় মিলে কিনা, সেইটা আমার বুঝের মধ্যে আসে না।
বাবা ভাব বিষয়ে এই বলেই নিরত্তর। আর কিছুই বলেন না।
বোধহয়, এই মতামতে তার নিজের কোন আস্থা ছিলো না। উল্টো তার কারণ অকারণ সবকিছুরেই ভাব থেকে আলাদা করা যেতো না। অন্ধ পক্ষীটারে তিনি আলগা দরদ দেখাতেন। সম্ভবত তিনিই ছিলেন পাখিটার সব’চে অপ্রিয় পাত্র। কেন, কে জানে?
তিনি যে ব্যাপারটা বুঝেন না, এমন নয়।
বাবা বলেন, “ 'এক জনরে একেক কিসিমে দুনিয়াতে পরিচিত হতে হয়। এখানে কে পাখি আর কে মানুষ তার হিসেব রাখা দায়। বাহির দেখে সবসময় ভেতর বুঝা যায় না, এই যেমন কোন কোন মানুষের মনে এক কথা আর ভেতরে আরেক'। ”
তিনি এই পাখিটার এই আচরণ অদ্ভুতভাবে মেনে নিতেন। কেন নিতেন? এটা কি কোন ধরনের ধৈর্যের পরীক্ষা?
তিনি বলেন, “'এই দুনিয়ায় কামিয়াব হতে এন্তেজারের কোন বিকল্প নাই।
ছোট-বড় যায় কিছু হোক ভালোটারে পেতে চাইলে বহুত ধৈর্য ধরতে হয়। নাইলে কোন কিছু হাসিল হয় না। সব’চে বেশী ধৈর্যের ব্যাপার হলো কারো মন পাওয়া। এই যেমন- আশেক হইলেই কামিয়াব হওয়া যায় না। মাশেকের মন পাইতে হয়।
ভাব-ভালোবাসা একের বিষয় নয়। এটা দুইয়েই হয়'। ”
.... চলবে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।