বাংলা গানে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল প্রতিভা:
বাংলাদেশে স্বীকৃতির রাজনীতি।
বাংলা কিংবা ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র না হওয়ায় রোমান্টিসিজম, রিয়ালিজম বা সুররিয়ালিজমের মত জটিল প্রতিটি বিষয়ে গভীরভাবে জানার খুব বেশি সুযোগ হয়ে উঠেনি আমার। নিতান্ত ব্যক্তিগত আগ্রহে যতটুকু জেনেছি তা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের মত প্রতিভাকে বিচার করার দুঃসাহস হয়ত কোনকালেই আমার ছিলনা, আজও নেই। কেবলমাত্র একান্ত ব্যক্তিগত অনুধাবন থেকই এ লেখা।
আমার বাবার গায়কি কিংবা কন্ঠ কোনটিই শৈশব থেকে আমাকে তেমন আকৃষ্ট করেনি সত্যি কিন্তু সঙ্গীতের প্রতি তাঁর অদম্য আগ্রহ আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করেছে এবং আমি বিশ্বাস করি তিনি নিঃসন্দেহে একজন অসাধারন শ্্েরাতা ও গীতিকার।
আমার বাবার প্রশংসার নিমিত্তে নয় বরং একজন সঙ্গীতপ্রেমীর পরিবারে আমার বেড়ে উঠার কথাটি স্পষ্ট করার জন্যই এত কাহিনীর অবতারনা।
ভাদ্রমাসের রৌদ্রে আমরা ভাই-বোন তিনজন মিলে বাড়ির বারান্দায় গানের ক্যাসেডের স্ট্যনগুলো মেলে দিতাম। দীর্ঘদিন সংরণের জন্য এ ব্যবস্থা কতটুকু কার্যকরী ছিল জানি না তবে পাঁচশতাধিক ক্যাসেড আমারা কেবল রৌদ্রে শুকিয়ে কান্ত হয়নি বরং বারবার শুনতাম। রবীন্দ্র, নজরুল, লতা, হৈমন্তী, মানবেন্দ্র, শ্যমল মিত্র, সলির চৌধুরী, মান্না দে (সর্বাধিক প্রিয় ছিল), মো: রফি আরও অসংখ্য অসংখ্য ... .... ... ...
“নয়ন ভরা গো তোমার আচঁল ভরা ফুল” আর “ তুই ফেলে এেেসছিস কারে মন, মনরে আমার” - এ দুটি গান দিয়েই প্রথম রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে আবিস্কার করেছিলাম আমার শৈশবে (পিচ্চিকালে)। তারপর এদের গান শুনে শুনে কাটিয়ে দিলাম দীর্ঘদিন।
তারপরেও মনে হয়, এখনো কিছুই শুনা হল না।
গানের েেত্র রিয়ালিজমের সাথে যখন রোমান্টিসিজমের মিতালি ঘটে তখন মনে হয়; রোমান্টিক চেতনায় বাস্তবতা কেবল তথ্য নয়, সত্য। অন্যদিকে রোমান্টিসিজম কেবল স্বপ্ন নয় বরং আরো বেশি কিছু। গানের েেত্র একটা আরেকটার পরিপূরক হিসাবে কাজ করে।
রোমান্টিক চেতনার মূল কথা হচ্ছে সাধারনের মধ্যে অসাধারনের আবিষ্কার।
কিন্তুু সেই রোমান্টিক চেতনায় যখন রিয়ালিজম বা বাস্তবতা যোগ হয় তখন তা অসাধারনত্বকেও ছাড়িয়ে যায়। এটা একান্ত আমার ব্যক্তিগত মত, আপনাদের ভিন্নমতও থাকতে পারে।
রবীন্দ্রনাথ মূলত ভাববাদী কবি ছিলেন। গানের েেত্র ও এ বিষয়টি ল্য করা যায়। তিঁিন বিশাল ভাবের জগৎএ আতœমুক্তির পথ খুজেঁছেন।
কিন্তুু নজরুল, কেবলমাত্র ভাবের জগৎ এ তারঁ আত্মমুক্তি মিলেনি। তিঁিন প্রত অনুভূতি দিয়ে বাস্তবকে দেখেছেন, স্থান দিয়েছেন তাঁর গানে। এখানেই আমার কাছে নজরুলের গানের অসাধারনত্ব।
বাংলা গানের বিকশে ঠাকুর পরিবারের অবদান অনস্বীকার্য। সঙ্গীতপ্রেমী ও গায়ক দ্বারকানাথ ঠাকুরের ঘরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত প্রতিভা যতটা না প্রশিণের মাধ্যমে বিকশিত হয় তারচেয়েও বেশি বিকশিত হয় অনুকূল পরিবেশে তাঁর অবচেতন মনে।
এ সুযোগটা নিঃসন্দেহে নজরুলের ছিল না। রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলকে বিচার করার জন্য অবশ্য বিষটি খুব বেশি গুরত্বপূর্ণ মানদন্ডও নয়।
সঙ্গীতকে কেবলমাত্র শাস্ত্রীয় বা ধর্মীয় বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়ে একটি নিজস্ব ধারা তৈরি করতে পেরেছিলেন প্রথম রবীন্দ্রনাথই। অসাধারন প্রতিভা আর গায়কি আর দার্শনিক কথামালা দিয়ে তিঁিন নিজ যোগ্যতায় তাঁর স্থানটি যুগ যুগ ধরে ধরে রেখেছেন। কিন্তুু নজরুল, যার গানে সুর, তাল, কথার গভীরতা, কন্ঠের কাজ আর বৈচিত্রতায় অসাধারনত্বকেও ছাড়িয়ে যায়।
নজরুল মূলত যেসব ধরায় গান রচনা : রাগপ্রধান, বৈচিত্রময় গজল, কাব্যগীতি, শ্যমাসঙ্গীত, ইসলামী গান, জাগরনী বা উদ্দীপনামূলক দেশাত্ববোধক গান।
এখানে একটি বিষয় অত্যন্ত ল্যনীয় যে, রবীন্দ্র সঙ্গীতে সুরের বৈচিত্র নিঃসন্দেহে নজরুল সঙ্গীতের চেয়ে কম। এর পেছনে অবশ্য একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হল নজরুলই প্রথম তাঁর গানে অন্যকে সুরারোপ করার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। কিন্তুু তারপরেও তাঁর সৃষ্ট প্রতিটি ধারাই যেন বিস্ময়ের চেয়ে বড় বিস্ময়।
“প্রিয়, এমন রাত যেন যায়না বৃথায়”, মোর ঘুমঘোরে এল মনোহর... (“শিয়রে বসি চুপি চুপি চুমিলে নয়ন”- সৃষ্টির প্রথম থেকে আজ অবধি কতজন প্রেমিক তার প্রিয়তমার চোখে চুমু দিয়ে ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ করার কথা চিন্তা করেছেন ? এর চেয়ে রোমান্টিক আর কি হতে পারে?)
সদ্য প্রেমেপড়া কোন প্রেমিকের কাছে “ মোর প্রিয়া হবে এসো রানী দেব খোপায় তারার ফুল... রংধনু হতে লাল রং ছানি আলতা পরাব পায়...”এর চেয়ে প্রিয় গান কি হতে পারে ?
নজরুলের বাংলা ও উর্দু এবং বাংলা-উর্দু গজল, যে একবার স্বাদ নিতে পেরেছে, সে যে যেমন তেমন গানে আর মজা পাবেনা একথা আশা করি কেউ দ্বিমত করবেন না।
“আলগা কর গো খোপার বাধন, দিল ওহি মেরা ফছগেয়া...” গানটি শুনার অনুরোধ রইল তবে নকল হতে সাবধান! ইভা রহমান আর তিশমারা যেমন রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়তে শুরু করেছে তেমনি এ গানটির বিকৃত রিমিক্সও বের হয়েছে। ওটি কিনে দয়াকরে ঠকবেন না, মোহাম্মদ রফিরটা শুনলেই বুঝবেন।
“খেলিছ, হে বিশ্বলয়ে... বিরাট শিশুর আনমনে...( ভাঙ্গিছ গড়িছ নীতি ণে ণে..নিরজনে প্রভু নিরজনে)” আস্তিকদের জন্য এর চেয়ে বড় দার্শনিক সত্যি আর কি হতে পারে আমার জানা নেই।
কারার ঐ লৌহকপাট... গানটির চেয়ে সামাজ্যবাদ বিরোধী, দেশপ্রেমমূলক অন্য একটি গানের কথাকি বলবেন প্লিজ? শ্যমাসঙ্গীত আর ইসলামী গানের উপমা বাদই দিলাম (কখন সাম্প্রদায়িকতার দায়ে অভিযোক্ত করেন সেই প্রসঙ্গ না হয় না পরে একসময় লেখা যাবে)
যে কথাটি দুঃখজন্নক হলেও সত্যি তা হল, এত প্রতিভাবান ব্যক্তিটিকে স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশী একশ্রেণী বুদ্ধিজীবীমহলের অত্যন্ত কষ্ঠ হয়। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মেতে থাকতেই তাঁরা স্বাছন্দবোধ করেন (রবীন্দ্রনাথকে যর্থাথ সম্মান রেখে বলছি)।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক ও বামপন্থি বুদ্ধিজীবী মহলে এ প্রবণতা অধিক লণীয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বছর ভর্তি হলাম সেবারই ল্য করলাম, রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকীতে ঢাকসু চ্ত্বরে বেশ ঘনঘটা আয়োজনে তাঁেক স্মরণ করা হল। এতে আমার বিন্দুমাত্র দুঃখ কোনকালে ছিলনা, আজও নেই। কিন্তুু দুঃখের বিষয় নজরুলকে স্মরণ করা হলনা।
সবশেষে একটা কথাই বলব, বাংলাদেশ প্রতিবছর ২-৪ টা নজরুলের জন্ম হয় (হয়ত), কিন্তু ঠাকুর পরিবারে জন্ম না নেয়ার অপরাধে অকালেই তাদের মৃত্য ঘটে।
তারপরেও শতবাধা পেরিয়ে যে নজরুলরা বড় হয় তারা চিরকাল দুখুমিয়াই থেকে যায়।
- নূর-ই-মকবুল ফরচুন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।