আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গাহি সাম্যের গান

www.choturmatrik.com/blogs/আকাশ-অম্বর
গাহি সাম্যের গান- মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান্‌ । নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি, সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি। - ‘পূজারী দুয়ার খোলো, ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হ’ল!’ স্বপন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়, দেবতার বরে আজ রাজা-টাজা হ’য়ে যাবে নিশ্চয়! জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুধায় কন্ঠ ক্ষীণ ডাকিল পান’, ‘দ্বার খোল বাবা, খাইনি ক’ সাত দিন!’ সহসা বন্ধ হ’ল মন্দির, ভুখারী ফিরিয়া চলে, তিমির রাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুধার মানিক জ্বলে! ভুখারী ফুকারি’ কয়, ‘ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়!’ মসজিদে কাল শির্‌নী আছিল,-অঢেল গোস–র”টি বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটি কুটি, এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে আজারির চিন্‌ বলে, ‘ বাবা, আমি ভূখা-ফাকা আমি আজ নিয়ে সাত দিন!’ তেরিয়া হইয়া হাঁকিল মোল্লা-‘ভ্যালা হ’ল দেখি লেঠা, ভূখা আছ মর গো-ভাগাড়ে গিয়ে! নামাজ পড়িস বেটা?’ ভূখারী কহিল, ‘না বাবা!’ মোল্লা হাঁকিল-‘তা হলে শালা সোজা পথ দেখ!’ গোস–র”টি নিয়া মসজিদে দিল তালা! ভুখারী ফিরিয়া চলে, চলিতে চলিতে বলে- ‘আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু, আমার ক্ষুধার অন্ন তা ব’লে বন্ধ করনি প্রভু। তব মস্‌জিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী। মোল্লা-পুর”ত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!’ কোথা চেঙ্গিস্‌, গজনী-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়? ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া-দ্বার! খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা? সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা! হায় রে ভজনালয়, তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয়! মানুষেরে ঘৃণা করি’ ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি’ ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন’ নাও জোর ক’রে কেড়ে, যাহারা আনিল গ্রন’-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে, পূজিছে গ্রন’ ভন্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো, মানুষ এনেছে গ্রন’;-গ্রন’ আনেনি মানুষ কোনো।

আদম দাউদ ঈসা মুসা ইব্রাহিম মোহাম্মাদ কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর,-বিশ্বের সম্পদ, আমাদেরি এঁরা পিতা-পিতামহ, এই আমাদের মাঝে তাঁদেরি রক্ত কম-বেশী ক’রে প্রতি ধমনীতে রাজে! আমরা তাঁদেরি সন্তান, জ্ঞাতি, তাঁদেরি মতন দেহ, কে জানে কখন মোরাও অমনি হয়ে যেতে পারি কেহ। হেসো না বন্ধু! আমার আমি সে কত অতল অসীম, আমিই কি জানি-কে জানে কে আছে আমাতে মহামহিম। হয়ত আমাতে আসিছে কল্কি, তোমাতে মেহেদী ঈসা, কে জানে কাহার অন- ও আদি, কে পায় কাহার দিশা? কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই, কাহারে মারিছ লাথি? হয়ত উহারই বুকে ভগবান্‌ জাগিছেন দিবা-রাতি! অথবা হয়ত কিছুই নহে সে, মহান্‌ উ”চ নহে, আছে ক্লেদাক্ত ক্ষত-বিক্ষত পড়িয়া দুঃখ-দহে, তবু জগতের যত পবিত্র গ্রন’ ভজনালয় ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয়! হয়ত ইহারি ঔরসে ভাই ইহারই কুটীর-বাসে জন্মিছে কেহ- জোড়া নাই যার জগতের ইতিহাসে! যে বাণী আজিও শোনেনি জগৎ, যে মহাশক্তিধরে আজিও বিশ্ব দেখনি,-হয়ত আসিছে সে এরই ঘরে! ও কে? চন্ডাল? চম্‌কাও কেন? নহে ও ঘৃণ্য জীব! ওই হ’তে পারে হরিশচন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব। আজ চন্ডাল, কাল হ’তে পারে মহাযোগী-সম্রাট, তুমি কাল তারে অর্ঘ্য দানিবে, করিবে নান্দী-পাঠ। রাখাল বলিয়া কারে করো হেলা, ও-হেলা কাহারে বাজে! হয়ত গোপনে ব্রজের গোপাল এসেছে রাখাল সাজে! চাষা ব’লে কর ঘৃণা! দে’খো চাষা-রূপে লুকায়ে জনক বলরাম এলো কি না! যত নবী ছিল মেষের রাখাল, তারাও ধরিল হাল, তারাই আনিল অমর বাণী-যা আছে র’বে চিরকাল।

দ্বারে গালি খেয়ে ফিরে যায় নিতি ভিখারী ও ভিখারিনী, তারি মাঝে কবে এলো ভোলা-নাথ গিরিজায়া, তা কি চিনি! তোমার ভোগের হ্রাস হয় পাছে ভিক্ষা-মুষ্টি দিলে, দ্বারী দিয়ে তাই মার দিয়ে তুমি দেবতারে খেদাইলে। সে মার রহিল জমা- কে জানে তোমায় লাঞ্ছিতা দেবী করিয়াছে কিনা ক্ষমা! বন্ধু, তোমার বুক-ভরা লোভ, দু’চোখে স্বার্থ-ঠুলি, নতুবা দেখিতে, তোমারে সেবিতে দেবতা হ’য়েছে কুলি। মানুষের বুকে যেটুকু দেবতা, বেদনা-মথিত সুধা, তাই লুটে তুমি খাবে পশু? তুমি তা দিয়ে মিটাবে ক্ষুধা? তোমার ক্ষুধার আহার তোমার মন্দোদরীই জানে তোমার মৃত্যু-বাণ আছে তব প্রাসাদের কোন্‌খানে! তোমারি কামনা-রাণী যুগে যুগে পশু, ফেলেছে তোমায় মৃত্যু-বিবরে টানি’। গাহি সাম্যের গান- যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্‌লিম-ক্রীশ্চান। গাহি সাম্যের গান! কে তুমি?- পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো? কন্‌ফুসিয়াস্‌? চার্বআখ চেলা? ব’লে যাও, বলো আরো! বন্ধু, যা-খুশি হও, পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও, কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক- জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও, য্ত সখ- কিন্তু, কেন এ পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল? দোকানে কেন এ দর কষাকষি? -পথে ফুটে তাজা ফুল! তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান, সকল শাস্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ! তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার, তোমার হৃষয় বিশ্ব-দেউল সকল দেবতার।

কেন খুঁজে ফের’ দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি -কঙ্কালে? হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে! বন্ধু, বলিনি ঝুট, এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট। এই হৃদ্য়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন, বুদ্ধ-গয়া এ, জেরুজালেম্‌ এ, মদিনা, কাবা-ভবন, মস্‌জিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়, এইখানে ব’সে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়। এই রণ-ভূমে বাঁশীর কিশোর গাহিলেন মহা-গীতা, এই মাঠে হ’ল মেষের রাখাল নবীরা খোদার মিতা। এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা-মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি’। এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহবান, এইখানে বসি’ গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান! মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।

২৫শে মে, ২০১০ - নজরুল ১১১তম জন্মবার্ষিকী
 


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।