আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৃত্যুঞ্জয়ী

বিকট
দুঃসংবাদগুলো আচমকাই আসে। ভীষণ ত্রাসে অথবা অট্টহাস্যে। আমরা কুঁকড়ে মুকড়ে যাই। মাটির সাথে মিশে যেতে চাই। অথবা অস্তিত্বহীনতার আস্থায় সান্তনা খুঁজে ফিরি।

আজকের দুর্ঘটনাটার জন্যে আমি একদমই প্রস্তুত ছিলামনা। অফিস শেষে বাসে করে ফিরছিলাম। গরমে আর ঘামে ক্লিষ্ট, আর মানুষের ভীড়ে পিষ্ট হয়ে নিজের শরীরটাকে টাঙিয়ে রেখেছিলাম ধাতব হাতলের ওপর। সময় কাটানোর জন্যে সারাদিনের কর্মাবলীর হিসেব নিকেশ করছিলাম মনের ভেতর। কিন্তু হঠাৎ এক কবির সাথে আমার বচসা লেগে গেল।

কবিই বটে। তার গায়ে কোথাও লেখা নেই, কিন্তু আমি কেন যেন চিনতে পারলাম তাকে! গায়ে পড়েই ঝগড়া শুরু করল সে, "কিসের এত হিসেব নিকেশ করছেন?" রাগত কন্ঠ তার। কিন্তু আমি আমার মেজাজ ঠান্ডা রাখলাম। সহজ ভাবেই উত্তর দিলাম, "এই তো, আমাদের প্রাত্যহিক হিসেব নিকেশ, ইলিশ মাছের দাম কতটা বাড়লো বা এমডি স্যারকে সামনে কি পরিমাণ তেল দিলে আমার প্রমোশন হতে পারে এসব আর কি..." "ভালো, হিসেব নিকেশ করা ভালো। আর কিছুর হিসেব নিকেশ করেন না? ছন্দ-মাত্রা বা বর্ষাকালে পন্ডযাত্রা?" "কিসব যাতা বলছেন? আমাকে নির্বিঘ্নে হিসেব করতে দিন।

জায়গা ছাড়ুন" এবার কবি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলোনা। আমার ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো বাসের কেন্দ্রস্থল থেকে নির্গমনের পথের দিকে। কেউ কোনও বাধাও দিলোনা! তার শক্তি আমার চেয়ে অনেক বেশি, তার বিশাল দেহের সামনে আমার লেফাফাদুরস্থ অবয়বটা নতজানু হয়ে গেলো। সে আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চেয়েছিলো এই শহরের বাইরে। সে ক্রমশঃ শক্তিমান আর বৃহৎ হয়ে উঠছিলো।

একসময় সে ঈশ্বরের মত হিংস্র আর দয়ালূ হয়ে উঠলো। তার দয়াদ্র মুঠোয় আমাকে চেপে ধরে এই শহরের ধূলো-বালি, পয়ঃপ্রণালী থেকে উদ্ধার করে পৌঁছে দিতে চাইলো ডাহুক ডাকা বন আর নক্ষত্রপুঞ্জের আস্তানায়। কিন্তু অবাধ্য আমি তারস্বরে প্রতিবাদ জানালাম তার এই আচরণের। আমার শেয়ার বাজার, বাসা বাড়ির দলিল-দস্তাবেজ, আর কিস্তিতে কেনা গাড়ী, আমার বর্ণাঢ্য হতে থাকা ক্যারিয়ার! কে চায় হৃদয় খুঁড়ে....নাহ ভুল হচ্ছে, ওখানে অন্য শব্দ হবে। সে যাই হোক।

কবি বা কবিতার ঈশ্বরের হিংস্র রূপ দেখলাম আমি একটু পরে। সে আমাকে আগুনের ভয় দেখায়নি, জ্বলন্ত লৌহদন্ডে পশ্চাদ্দেশ এঁটে দেবার হুমকি দেয়নি, কিন্তু প্রচন্ড এক রোষে আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো নগরের বাসগাড়ী, বসৎবাড়ী, আলো ঝলমলে শপিং মল আর স্ফিতবক্ষা প্রদর্শনপ্রিয় নারীদের কাছ থেকে। আমি উড়তে উড়তে......আমি প্রচন্ড আতঙ্ক নিয়ে উড়তে উড়তে মৃত্যু আর নরকের ভয়াবহ দৃশপটের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকলাম। ভূপতিত হবার পর আমি আবিস্কার করলাম যে এই ঈশ্বরের ক্ষমতা সসীম! সে আমাকে তার উদ্দীষ্ট এলাকায় পৌঁছে দিতে পারেনি। আমি একটা হাইড্রেন্টের ভেতর সটান পড়ে রইলাম।

এত দূরত্ব উড়ন্ত অবস্থায় পাড়ি দিয়ে পতনের পরেও কোন ব্যথা অনুভব করছিনা। নিজেকে সামলাতে এবং পরিচর্যা করতে, ড্রেইনের ময়লা থেকে নিজেকে পরিস্কার করতে সচেষ্ট হলাম আমি। এ করতে গিয়ে আবিস্কার করলাম যে, আমার বুকপকেটে একটা কলম....... ঈশ্বরের উপহার? আমি কি তবে ঐশীবাণী লিখে পরিত্রাণ পাবো শাস্তি থেকে? কিছুক্ষণ পরে দুজন এগিয়ে এলো আমার দিকে। দেখে আমার মতনই হিসেবরক্ষক মনে হল। অবশ্য আমার মত কেতাদুরস্ত নয়! এরাই কি সেই প্রশ্নকারীর দল? অবশ্য ধর্মগ্রন্থের বর্ণনানুযায়ী তাদের পোষাক থেকে জেল্লা বেরুচ্ছেনা মোটেও।

যেন অনিচ্ছায় কর্তব্য সম্পাদন করতে হচ্ছে এমন একটা ভাব নিয়ে আমার সামনে এল। একটা জীর্ণ হয়ে যাওয়া কাগজ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, "লেখ" আমি সোৎসাহে লেখা শুরু করে দিলাম। ১। পাশের ডেস্কের সহকর্মীর নামে বসের কাছে কুৎসা রটাতে হবে। ২।

নতুন একটা সার্কুলার দিয়েছে সরকার, ওটায় ঢুকতে পারলে হয়! ম্যালা টাকা! এ পর্যায়ে ওরা আমাকে থামিয়ে দিলো। হতাশ, কঠোর ওদের দৃষ্টি। এবার ওরা আমাকে শুধোলো, "বল?" পরীক্ষার মৌখিক পর্যায়। দ্বিতীয় এবং সম্ভবত আমার শেষ সুযোগ। এটা হাতছাড়া করা যায়না! "বল তোমার প্রভুর নাম কি?" অতি সহজ প্রশ্ন! "জনাব টাকহাঁস পায়াভারী, এম.ডি- এসইউসিকে এএসএস মাল্টিন্যাশন্যাল কোম্পানি" আমি গড়বড় করে বললাম।

"তোমার পথ প্রদর্শকের নাম কি?" "টাকা!" "দুটোই ভুল উত্তর দিয়েছে" তারা বিরসবদনে মাথা নাড়লো। এবার তারা আমাকে একটি পুরু এবং চওড়া কাগজের সেতূ অতিক্রম করার আহবান জানালো। ওখানে কিসব যেন লেখা। অতিক্রম করতে গিয়ে আমাকে পড়তেও হবে সেসব। বিরাট ঝঞ্জাট! আর একটু পা ফসকে গেলেই..... আমি নীচে তাকিয়ে দেখি।

নাহ! সেরকম ভয়াবহ কিছু না তো! অথচ ও দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কি না কি হবে! নীচে আমার কামুক শহর, আমার যৌনাবেদনময়ী কর্মস্থল, রতিকর্মে ব্যস্ত আমার শেয়ার বাজার, রাস্তায় বেরাস্তায় মানুষ হাজারে হাজার, সুপারশপ আর হৃৎপিন্ডের চপ! লোভনীয়! তারপরেও ওপারে আরো লোভনীয় কিছু থাকতে পারে এই প্রত্যাশায় আমি পুরু কাগজের সেতূ পাড়ি দেবার সিদ্ধান্ত নিলাম। ওখানে অনেক বড় করে কি সমস্ত লেখা, আর আঁকা.. ডালি! হঠাৎ এই নামটা কেন মনে আসল জানিনা। শব্দগুলো আমি একটু আকটু পড়ার চেষ্টা করলাম, "ভা লো বা সি" কষ্ট হচ্ছিলো পড়তে। কিন্তু নিমিষেই আমি পুরোটা পড়তে পারলাম। "ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল" অবশ্য এরকম অর্থহীন বাক্যের কোন মানেই খুঁজে পেলামনা আমি।

খামোখা নিবিষ্ট হয়ে পড়তে গিয়ে বিপত্তিটা ঘটল। আমার পা হড়কে গেল। আমি পতিত হচ্ছি.... বা পতিতা হচ্ছি.. এতে অবশ্য আমার কোন আক্ষেপ নেই! আশ্চর্য মেঘদলের সাংকেতিক পাঠোদ্ধারের চেয়ে সুপারশপে গিয়ে হৃৎপিন্ডের চপ খাওয়া ভালো। কিন্তু নচ্ছাড়রা আমাকে ছাড়লে তো! তারা আমাকে ঠিকই ধরে ফেললো। প্রশ্নকর্তা দুজন সূচারুরূপে কাজটি সম্পন্ন করে অন্য একজনের কাছে সমর্পিত করে দিলো আমাকে।

তাকে আমি দেখতে পাচ্ছিনা, কিন্তু তার কথা শুনতে পারছি। "আমি মৃত্যুদূত" বেদনার্ত কন্ঠ তার "আমার ওপর দায়িত্ব বর্তেছে তোমার প্রাণ কেড়ে নেবার। " বিষণ্ণ কন্ঠে বলল সে। এরকম অদ্ভুত মৃত্যুদূতের কথা আগে কোথাও শুনিনি! কোথায় সে ভীমরূপ আর শীতল কন্ঠ! বরং তাকে বেশ সহানুভূতিশীল মনে হচ্ছে। কন্ঠস্বর আদ্র এবং মোলায়েম।

"শেষমুহূর্তে তোমার কোন চাওয়া আছে কি? শুনতে চাও কোন কবিতা? ফিরে পেতে চাও তোমার হারিয়ে ফেলা কবিতার ডায়েরী?" আমার দুর্বোধ্য লাগে তার কথা। অস্পষ্ট লাগে, সব শব্দ বুঝিওনা। আমার কানে বাক্যটি আসে এরকমভাবে, "শেষমুহূর্তে তোমার কোন চাওয়া আছে কি? শুনতে কি চাও কোন (অস্পষ্ট)? ফিরে পেতে চাও তোমার হারিয়ে ফেলা (অস্পষ্ট)?" সে মনে হয় বুঝতে পারে আমাকে। সে বুঝতে পারে আমার অজ্ঞানতা বা অক্ষমতা বা অস্বস্তি। সে প্রস্তুতি নেয় আমাকে মেরে ফেলার।

তবে এদের ব্যাপার স্যাপার একটু অন্যরকম। মৃত্যুপ্রক্রিয়াটা সেরকম ভয়াবহ কিছু নয়। একটি কলম দিয়ে তারা আমার বুক চিড়ে লিখতে থাকে, "তোমার স্মৃতি আমাকে ঘিরে রাত্রি থেকে আবির্ভূত নদী সমুদ্রের সঙ্গে তার দুরন্ত বিলাপ নিয়ে মেশে খুব সকালে পরিত্যক্ত জেটির মতো এখনই বিদায়ের মুহুর্ত, আহা বিদায়ী একজন!" "আহা বিদায়ী একজন!" তারা সবাই সমস্বঃরে বিলাপ করতে থাকে। আমার রক্তক্ষরণ হয়, আমি মারা যাই। পরদিন সকালে তদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান শেষ হয়।

তারা আমাকে সমাধিস্থ করে আমার কর্মস্থলের ডেস্কে। কবরে যেমন পোকামাকড় খুবলে খায় মৃত মানুষদের, আমাকেও তেমনি ডেস্কের ফাইলপত্র, নতুন বানিয়ে রাখা জীবন এবং কর্ম বৃত্তান্ত আর লুকিয়ে রাখা পর্ন সিডিগুলো খুবলে খায়, ছোবল দিতে থাকে। আমি মৃত্যু পরবর্তী জীবনের যন্ত্রণা ভোগ করতে থাকি। হঠাৎ করে যেন কার কন্ঠ কানে বাজে! আমি সচকিত হয়ে উঠি। আমার বসের কন্ঠ! আমার প্রভুর কন্ঠ! বহুজাতিক কোম্পানির এম.ডি জনাব টাকহাস পায়াভারী।

তিনি উচ্চকন্ঠে রাগ প্রকাশ করছেন " কি ব্যাপার, তৈলবাজ পোন্দকার এখনও এসে পৌছোয়নি! এভাবে কি অফিস চলে!" আমি তৎক্ষণাৎ ডেস্কের সমাধি থেকে লাফ দিয়ে উঠি। আমার মৃত্যু প্রহসন শেষ হয়। আমি তৈলবাজ পোন্দকার, মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেট কোম্পানির বিশিষ্ট কর্মচারী। আমার ব্যক্তিগত জীবনে আরো একটা সাফল্যের পালক যুক্ত হল। আমাকে মেরে ফেলার পরেও আমি সদর্পে ফিরে এসেছি।

আমি মৃত্যুঞ্জয়ী! ##এই গল্পে ব্যবহৃত কবিতা বা কবিতাংশগুলো ব্যোদলেয়ার এবং নেরুদা'র।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.