আমি একজন অতি সাধারন মানুষ। সুন্দরের সন্ধানে ঘুরে বেড়াই জলে স্থলে অন্তরীক্ষে। এই ব্লগে প্রচারিত ধারাবাহিক উপন্যাস এবং কবিতা আমার নিজ ব্লগ নীল নক্ষত্রে প্রচার করছি।
তাহলে এ কথা আগে মনে করিসনি কেন, এখন দোকানি বলবে কি? আমি বলছি তুই এটা নিয়ে নে, পছন্দ না হলে দেশ থেকেই না হয় আর একটা কিনে দিবি আর এটা অন্য কাউকে দিবি। তাছাড়া বিদেশ থেকে মনে করে নিচ্ছিস এটা কি কম? আমার তো মনে হয় ভাবী এতো অবিবেচক না, উনি খুশিই হবেন।
নিয়ে নে, নাহয় আর একটা দেখ।
না চল অন্য দোকানে যাই।
মনির তো বলেই হাঁটা শুরু করে দিল। জাহিদ তা পারলো না। জাহিদ পরে গেল এক সম্স্যায়।
তার আত্মসম্মান বোধ একটু বেশি। এখন কি করে? তার শারি পরার মত এক মা ছাড়া আর কেউ নেই, মার জন্য এই শারি চলে না, বোন আছে এক জন কিন্তু, সে এখনো ফ্রক ছেড়ে শারি পরার মত হয়ে উঠেনি। এদিকে দোকান থেকে বেড় হয়েও আসতে পারছে না। দোকানে দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতে যার কথা মনে হোল তাকে কি এই শারি দেয়া যায়?কি ভাবে দিবে? কি বলে দিবে? যার সঙ্গে কোন দিন এমন কোন কথা হয়নি, এই তাকে কি করে এই শারি দিবে? দেখা হয়েছে অনেক কিন্তু, কথা হয়নি কখনো।
গ্রামে যখন যেত তখন ওদের বাড়িতে ছিল জাহিদের বেশি যাতায়াত।
ওর বড় চাচাত ভাই মালেক আর বোন যুঁই ছিল জাহিদের সহপাঠী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই সুবাদে না কি যেন কোন সুবাদে ওই বাড়িতেই দিনের বেশির ভাগ সময় কাটত। ও বাড়িতে গেলেই যুঁই বলতো দেখ কে এসেছে, তোর হবু বর এসেছে যা বরন কর গিয়ে। ছোট বোনের সাথে এভাবে কথা বলতে যুঁইর মুখে একটুও আটকাত না, যা মনে আসে তাই বলে ফেলে। জাহিদও তার প্রতিটি পা ফেলার শব্দ বুঝতে পারতো, আসে পাশেই আছে।
নিরবে নিভৃতেই তা অনুভব করতো কাউকে কখনো সে কথা বলতে পারেনি। ওর সাথে কথা যা হয়েছে তা শুধু চোখে চোখে। তবে চোখের ভাষা বোঝার মত জ্ঞানী এখনো জাহিদ হয়ে উঠে নি। ওই বাড়ি গিয়েই শব্দ করে বলতো যা গরম পরেছে মনে হচ্ছে গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। আর সাথে সাথেই শুনতে পেত কুয়ায় বালতি ফেলার শব্দ।
একটু পরেই পানির গ্লাস নিয়ে ভীত হরিণীর মত কম্পিত হাতে সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলতো নেন।
গ্লাসটা হাতে নিয়েই জাহিদ বলতো আহ তোকে আবার কে বললো পানি আনতে?
আপনি যে চাইলেন।
বরাবরই সে একটু উদাসীন, ভাবুক প্রকৃতির। এক দিন সকাল থেকে ফিজিক্সের কি একটা কঠিন চ্যাপ্টার নিয়ে ওরা তিন জন মাথা ঘামাচ্ছিল, এর মদ্ধ্যে দুপুরের খাবার সময় বয়ে যাচ্ছে তাই যুঁই বললো এখন আর বাড়ি যাবি কেন চল এখানে খেয়ে নে। জাহিদ রাজী হয়ে ওদের সাথেই খেতে বসে গেল।
আর যেন কি কি ছিল মনে নেই তবে বাতাসি মাছ আর বেগুনের চচ্চরি মুখে দিয়েই বললো বাঃ চমৎকার হয়েছে। আর যায় কোথায়?
সঙ্গে সঙ্গে যুঁই বলে উঠলো, হবে না, রেঁধেছে কে জানিস? তোর বৌ রেঁধেছে। নে খা, খেয়ে অভ্যাস কর বলেই আর এক চামচ উঠিয়ে জাহিদের পাতে দিয়ে দিল।
লজ্জায় জাহিদের নাক কান যেন গরম হয়ে উঠলো, কেন বোকার মত এ কথা বলতে গেল ভেবে নিজেকে মনে মনে বকল। সেদিন আর কোন কথা না বলে চুপ চাপ খেয়ে বাড়ি চলে এলো।
কয়েকদিন পরেই জাহিদ তাদের বাড়ির পাশেই পথের পাড়ে বিরাট এক লেবু গাছের নিচে বসে সহপাঠী এক চাচার সাথে গল্প করছিলো এমন সময় ওরা কয়েক জন এক সাথে ওই পথেই স্কুলে যাচ্ছিল। হঠাত্ চোখে চোখ পরে গেল। কি কথা হোল কি না হোল কে জানে। ওর পথ চলা থেমে গেল। ইতিমধ্যে সাথের সঙ্গীরা সবাই কিছুটা এগিয়ে গেছে, চট করে প্রায় দৌড়ের মতই এগিয়ে গিয়ে তাদের সাথে মিশে গেল।
এই এর জন্যই তাহলে নিয়ে নিই, নাকি? গায়ের রঙ ফর্সা, গোল ধরনের চেহারা, গালের তিল আর থুতনির নিচের আচিল টা চোখে পরার মত, দীর্ঘ এক হারা গড়ন, সুন্দরী বলা চলে না তবে চোখে পরার মত। নীল জমিনে লাল পাড় শাড়ি মানাবে ভালো, কিন্তু! না, কোন কিন্তু নয়, যে করেই হোক এ শাড়ি ওকে দিতেই হবে। যে যা বলে বলুক।
শেষ পর্যন্ত জাহিদই কিনে নিয়ে দোকান থেকে বেড় হয়ে দেখে মনির তখন বাইরে দাঁড়ানো।
কিরে, তোর হাতে এটা কি, কি কিনলি?
না, কিছু না।
চল, ওই দোকানে দেখি।
না রে মনির, আমার ভালো লাগছে না, আমি জাহাজে চলে যাব, তুই যা।
বলেই বাস স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা শুরু করলো। পিছন থেকে মনির ডাকল কিন্তু সে ডাক জাহিদকে ফেরাতে পারলো না। কিছু দূর গিয়ে বুঝতে পারলো ভীষন তেষ্টা পেয়েছে।
পাশের দোকান থেকে এক ক্যান ঠান্ডা আপেল জুস নিয়ে বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালো। কি হোল আজ? জাহিদের কিছুই ভালো লাগছে না। এই জাহিদ পাচ ফুট এগারো ইঞ্চি লম্বা, গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা, মাথায় কোঁকড়ানো চুল, ছিপছিপে গড়নের কঠিন ব্যক্তিত্বের মানুষ, সেই জাহিদের কী হোল আজ? সারাদিন বাইরে ঘুরবে, বাইরে খাবে এই মনে করেই তো বেড় হয়েছিলো। এখন তার সব কিছু কেমন যেন ওলট পালট হয়ে গেছে কিছুই মনে করতে পারছে না।
এক হাতে শাড়ির প্যাকেট আর এক হাতে জুসের ক্যান, আর মন চলে গেছে সেই বাংলাদেশের কোন এক গায়ে যেখানে আছে সেই মেয়েটি।
ও কি এখন বই খাতা হাতে ক্লান্ত দেহে স্কুল থেকে পায়ে হেটে বাড়ি ফিরছে, না কি আজ স্কুল বন্ধ বলে বাড়ির শশা বা পুঁই শাকের মাচা বেধে ঠিক ঠাক করছে?কি রঙের কামিজ পরেছে আজ, দেখতে কেমন লাগছে? এই শাড়িতে কি ওকে মানাবে? শাড়িটা দেবার সময় কি বলবে ওকে? এই সব ভাবনায় যখন সে হারিয়ে গেছে তখন একটা বাস এসে দাঁড়ালো। কোথাকার বাস কোথায় যাবে তা কিছু না দেখেই পকেট থেকে বাস ভাড়া ২৫ ফিলস ভাংতি বের করে ড্রাইভারের হাতে দিয়ে টিকেট নিয়ে পিছনের একটা সিটে বসে পরলো। বাস এসে দাঁড়ালো মোহাররেকে। নেমে কিছুটা পথ পায়ে হেটে খেজুর বাগানের মধ্যে গিয়ে ছায়ায় বসে পরলো।
বেশ গরম আজ, এপ্রিল মাস এখনই এমন গরম জুন জুলাই মাসে কি হয় কে জানে।
ওর পরনে লেভীস এর নীল জিনস, গায়ে হালকা আকাশ নীল টি শার্ট আর পায়ে ইতালির আরাম দায়ক জুতা তবুও ঘেমে ভিজে গেছে। বাগানের ছায়ায় কিছুক্ষণ বসে থেকে জুড়িয়ে নিল। হাতের জুস তখন শেষ হয় নি। ঘাম শুকানোর পরে উঠে একটু হেটে সাগর পাড়ে একটা বড় পাথর পেয়ে তাতে বসে সাগরের দুর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে রইলো। হাতের কাছে পাওয়া দুই একটা ঝিনুক কুড়িয়ে সাগরের পানিতে ছুড়ে দিল, আর একটা ঝিনুক নিয়ে উঠে গিয়ে বসল সাগরের ঢেউ যেখানে আসছে যাচ্ছে সেখানে।
বসে বসে ঝিনুক দিয়ে বালুকা বেলায় সেই মেয়েটির নাম লিখল, একটু পরেই ঢেউ এসে সে নাম মুছে দিল। আবার লিখল আবার মুছে দিল। এই এক খেলা পেয়ে বসল জাহিদকে। নাম লিখছে আর ঢেউ এসে তা মুছে দিচ্ছে। মনে মনে হেমন্ত কুমারের গাওয়া সেই গান গুন গুন করছে “এই বালুকা বেলায় ……………” কত দিন থেকে ভাবছে এই নাম? না, মনে পরছে না।
হয়ত সেই ছোট বেলায় যখন গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যেত আর ওকে দেখত চঞ্চলা হরিণীর মত দৌড়ে বেড়াতে, জাম গাছে উঠে জাম পেড়ে সবাইকে বিলাত জাহিদকেও দিতো। ওদের বাড়ির দক্ষিন পাশে কুয়ার পাড়ে একটা জাম গাছ ছিল, এখন নেই। পুকুর পাড়ের গাব গাছে উঠে পাকা টস টসে হলুদ গাব পেড়ে এনে জাহিদকে দিতো, আহা সেই গাবের সে কি ঘ্রাণ এখনো মনে আছে। বাড়ির পুর্ব পাশে ছিল ঈদগাহ, ওদেরই পুর্ব পুরুষদের ওয়াকফ করা, ঈদগাহের উত্তর পাশেই একটা বকুল গাছ ফুলে ফুলে একাকার হয়ে যেত আর তার গন্ধে পুরো এলাকাটাই বদলে যেত।
শহরে থাকা জাহিদ বকুলের গন্ধ নেয়ার জন্য গাছের কাছে দাঁড়াত আর বাতাস তার কানে কানে বলত, শুধুই কি বকুলের গন্ধ নেবার জন্য এখানে এসেছ? একটু এগিয়ে দেখ আরো কিছু পাবে।
জাহিদ অনভ্যস্ত বন পথে পায়ে পায়ে ঝোপ ঝাড় ডিঙ্গিয়ে দেখতে পেল সেই মেয়েটি আপন মনে কুড়ানো বকুল ফুলের মালা গাঁথছে। কি করবে এই মালা দিয়ে? ভোর বেলা অনেকক্ষণ ধরে বালিকার মালা গাথা দেখলো, সেই তখন থেকেই কি? না, কোন ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকার পাতায় সে দিন তারিখের কথা লেখা নেই। ওই তারিখ জাহিদের বুকের ভিতর কোন এক গোপন ভল্টে লিখা হয়ে গিয়েছিল জাহিদের অজান্তে যা সে জানতেও পারেনি। এই নামটা যে কে লিখে রেখেছে তা কেউ জানে না। জাহিদ নিজেও না।
তখন মালেক বা যুঁই কারো সাথে তেমন একটা ভাব জমে উঠেনি।
এই গোপন ভল্টের চাবি জাহিদ ছাড়া কারো কাছেই নেই। যখন মনে হয় গোপন ভল্টের গোপন চাবি দিয়ে সে নিজেই শুধু খুলে দেখে সে সব স্মৃতি গুলি, বার বার, এ ভাবে ও ভাবে উলটে পালটে। আচ্ছা ও কি জানে এই গোপন ভল্টের কথা?কেন জানে না?কেন?কখন যেন আবার ওই পাথরের উপর গিয়ে বসেছে। বসে বসে সুর্য ডোবা দেখলো, উঠতে মন চাইছে না।
সাগরের নোনা জলের কণায় আকাশ লাল হয়ে গেছে, দিনের আলো নিভে গেছে, দূর দিয়ে চলে যাওয়া জাহাজের নেভিগেশন বাতি দেখা যাচ্ছে, পিছনে ঘুরে দেখে শহরের আলোর ঝলকানি জ্বলে উঠেছে। এতক্ষণে মনে হোল ক্ষুধা লেগেছে। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালো। হেটে বাসস্ট্যান্ডে এসে বাসে করে জাহাজে চলে এলো। (চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।