সিলেটে সাংবাদিক ফতেহ ওসমানী হত্যাকান্ড ও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি
ফকির ইলিয়াস
=========================================
সিলেটে বিশিষ্ট সাংবাদিক ফতেহ ওসমানীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। নিজ মোটরসাইকেলে বাসায় ফেরার পথে দুর্বৃত্তরা তার ওপর আক্রমণ চালায়। ১০ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে গেল ২৮ এপ্রিল ২০১০ বুধবার রাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ফতেহ ওসমানী ছিলেন আমাদের দীর্ঘদিনের সুহৃদ। সিলেটের সাংবাদিকতা ও ছড়া-সাহিত্যের জগতে তার পদচারণা ছিল উজ্জ্বল।
দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন ঢাকার বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দেশের বহুল জনপ্রিয় 'সাপ্তাহিক ২০০০'-এর সিলেট ব্যুরো প্রধানের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
ফতেহ ওসমানী ছিলেন আমাদের সাংবাদিক বন্ধুদের মধ্যে অত্যন্ত সাহসী ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অগ্রণী সৈনিক। প্রাণবন্ত আড্ডাবাজ এই সাংবাদিক যে কোন দুঃখী মানুষের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াতেন অত্যন্ত প্রত্যয়ের সঙ্গে।
বৃহত্তর সিলেটের প্রতিটি প্রগতিবাদী আন্দোলনে তিনি ছিলেন পুরোধা স্বজন। আমার দেখা-জানা মতে তার কোন মোহ ছিল না। যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসত তার শাণিত হাত।
সেই ব্যক্তিটিকে নির্মমভাবে কুপিয়েছে ওঁৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা। সংবাদটি শোনার পরই বিচলিত হয়েছিলাম।
কেন তার ওপর আঘাত আসবে? যে মানুষটি বেশ ক'বছর বিলেতে থাকার পরও স্থায়ীভাবে থাকার চেষ্টা-তদবির করেননি। বরং স্বদেশ, স্বজাতির টানে ফিরে গিয়েছিলেন সিলেটে। তার ওপর এমন বর্বর আক্রমণ হবে কেন? এসব প্রশ্ন মনে যখন খুব বেদনার ঝড় তুলছিল, তখনই খবর পেলাম তিনি আর নেই।
যে মানুষটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন আজন্ম আপসহীন, শেষ পর্যন্ত তাকেই প্রাণ দিতে হলো ঘাতকদের হাতে! বিষয়টি কোন মতেই মেনে নেয়া যায় না। মেনে নেয়া উচিতও নয়।
এই সেই বাংলাদেশ, যেখানে নিজ অফিসে ঢুকে ঘাতকরা হত্যা করেছিল যশোরের বিশিষ্ট সাংবাদিক, দৈনিক জনকণ্ঠের সেই সময়ের বহুল নন্দিত প্রতিনিধি শামছুর রহমানকে। বোমা মেরে হত্যা করেছিল 'সংবাদ' এর খুলনা ব্যুরো প্রধান মানিক সাহাকে। আরও অনেক সাংবাদিককে এভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে ঘাতকদের হাতে। সেসব হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু বিচার বাংলার মাটিতে এখনও হয়নি। আর হয়নি বলেই ঘাতকচক্র একের পর এক প্রতিবাদী, সত্যান্বেষী সাংবাদিকদের ওপর হামলে পড়ার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে।
খুবই হতাশা এবং বেদনার কথা, এ জঘন্য ঘটনার প্রায় তিন সপ্তাহের কাছাকাছি সময় পেরিয়ে গেলেও সিলেটের পুলিশ, গোয়েন্দাসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভাগ হত্যাকান্ডের মোটিভ উদ্ধার করতে পারেনি। কোন গ্রেফতারও সম্ভব হয়নি। অথচ এ মর্মান্তিক ঘটনার পরপরই প্রশাসনের সাঁড়াশি অভিযান শুরু করার কথা এবং প্রত্যাশা ছিল।
সাহিত্যিক, সাংবাদিক ফতেহ ওসমানীকে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে চোখের জলে শেষ বিদায় জানিয়েছেন তার সতীর্থরা। এ বিদায় চিরদিনের জন্য।
সাংবাদিকরা শপথ নিয়ে বলেছেন, তারা এ নারকীয় ঘটনার সুবিচার প্রতিষ্ঠা করবেনই। এ আশাবাদ এবং প্রত্যয় দেশে-বিদেশের গোটা বাঙালি সমাজের। কারণ নরকের কীটের মতো সমাজে ঘাপটি মেরে থাকা সন্ত্রাসীরা এমন দুঃসাহস দেখাতেই থাকবে, তা কোন মতেই মেনে নেয়া যায় না। ফতেহ ওসমানীর নামাজে জানাজায় উপস্থিত ছিলেন সিলেটের মেয়র বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। তিনি ঘোষণা করেছেন, এ হত্যাকান্ডের সুবিচার করতে সরকার বদ্ধপরিকর।
আমরা এ ঘোষণার দ্রুত বাস্তবায়ন দেখতে চাই। হত্যাকারীচক্র যতই ক্ষমতাবানই হোক না কেন তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি সুনিশ্চিত করতে হবে। গোটা বাংলাদেশের সহযোদ্ধা সাংবাদিক বন্ধুদের সবিনয়ে বলি, কলমসৈনিকরা কোন দানব শক্তির কাছে পরাজিত হতে পারে না। কোন সমাজ, সভ্যতা বাঁচিয়ে রাখতে চাইলে কোন অপশক্তির সহযোগী হয় না। তাই এ ঘাতক শক্তির বিষদাঁত ভেঙে দিতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
এ হত্যাকান্ডের সুবিচার না হওয়া পর্যন্ত সব প্রকার কর্মসূচি চালিয়ে যেতে হবে। না হলে ফতেহ ওসমানীর আত্মার কাছে আমরা দায়বদ্ধ থেকে যাব।
দুই
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে, তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। স্বরাষ্ট্রবিষয়ক দুই মন্ত্রী নানা 'মধুর বাণী' জনগণকে শোনালেও জনগণ তাতে মোটেই আশ্বস্ত হতে পারছেন না। টিভিতে দেখলাম, দেশে র্যাবের পরিচয় দিয়ে কিছু ভুয়া ব্যক্তি নানা স্থানে অপহরণ, গুম, হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক স্বয়ং নিজে তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এসব 'ভুয়া র্যাব'কে গ্রেফতারের জন্য পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলেও তিনি মিডিয়াতে বলেছেন। বিষয়টি একটি রাষ্ট্রের জনগণের জন্য মারাত্মক দুঃসংবাদ। কারণ কোন রাষ্ট্রে একটি সংঘবদ্ধচক্র যখন একটি শৃঙ্খলিত বাহিনীর ইমেজ ছিনতাই করে অপকর্মে নামে, তখন গোটা রাষ্ট্রের ভীতই নড়বড়ে হয়ে ওঠে। একটি সরকারি বাহিনীকে যারা চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়, তাদের তো 'কম শক্তিশালী' বলার কোন অবকাশ নেই।
তারা এত শক্তি পেল কোত্থেকে?
বিভিন্ন স্থানে র্যাবের নাম করে ধরে নিয়ে গেছে, এমন অভিযোগ দিনে দিনে বাড়ছে। যা একটি সরকার ব্যবস্থার জন্য অশনি সঙ্কেত বহন করছে। এরপরও কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদ্বয় নড়েচড়ে বসবেন না?
বিভিন্ন শহরে ব্যবসায়ী, ছাত্র, রাজনীতিক, সাধারণ মানুষ খুন হওয়ার ঘটনা প্রতিদিন সংবাদ মাধ্যমে আসছে। এরপরও সরকারি শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা যে খুব বিচলিত তা অনুধাবিত হচ্ছে না। এর কারণ কী? কেন সরকার এত কিছু দেখেও না দেখার ভান করছে?
দেশের বিভিন্ন স্থানে বখাটেদের উৎপাত মারাত্মকভাবে বেড়েছে।
ইভটিজিংয়ের মতো আদিম, বন্য মানসিকতা কাজটির বিরুদ্ধে বাংলাদেশে শক্ত কোন আইন প্রণীত হয়নি। বরং দেখা যাচ্ছে, যারা ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করছে, তারা আক্রান্ত হচ্ছে। এমন কি প্রতিবাদ করায় খুনের ঘটনাও ঘটেছে। মামুন হাওলাদার নামে একজন তরুণ নিহত হয়েছেন। এ ঘটনা রাষ্ট্রকে জানান দিয়ে গেছে একটি পাশব শক্তি আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখনও সক্রিয়।
একটি পরিশুদ্ধ সমাজ বিনির্মাণের পূর্ব শর্ত হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন। মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা না পেলে শুদ্ধ চেতনা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে না। মননশীল কর্মের প্রেরণা পায় না উত্তর প্রজন্ম।
বাংলাদেশে নানা ভাবে চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। তার ওপর সরকার যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়, তাহলে গোটা প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে।
এই সেই বাংলাদেশ যে বাংলাদেশে আমরা দেখি মন্ত্রী, সংসদ সদস্যরা তাদের প্রয়োজনে পেটোয়া বাহিনী পোষেন। বিশ্বের কোন সভ্য-গণতান্ত্রিক দেশেই কোন ক্ষমতাবান রাজনীতিকের নিজস্ব পেশিশক্তি নেই। আমরা শুদ্ধ সমাজ গঠনের কথা মুখে বলব আর নেপথ্যে পেটোয়া বাহিনী লালন করব, তা তো হতে পারে না।
দ্রব্যমূল্য, গ্যাস ও পানি সঙ্কটের চেয়েও ভয়াবহ সমস্যা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে সরকার ব্যর্থ হলে জনরোষ সরকারের বিপক্ষে যেতে পারে।
এ বিষয়টি রাষ্ট্রশাসকদের ভুলে গেলে চলবে না, অঙ্গীকার করেও তারা ব্যর্থ হলে জনগণ তাদের ক্ষমা করবে না।
নিউইয়র্ক , ৫ মে ২০১০
=========================================
দৈনিক সংবাদ। ঢাকা। ৭ মে ২০১০ শুক্রবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।