মা হ ফু জ উ ল্লা হ
সদ্যসমাপ্ত ভোলা উপনির্বাচন দেশ-বাসীকে অনেক কিছু উপহার দিয়েছে। একটি উপনির্বাচনের ফলাফল কী করে নিজেদের পক্ষে নিয়ে যেতে হয় সেটা যেমন দেশবাসী দেখেছে, তেমনি কথার ফুলঝুরিতে তারা বিস্মিত হয়েছেন। কথার ফুলঝুরি ছড়ানোর ব্যাপারে কেউই পিছিয়ে ছিলেন না। এই তালিকায় নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল ও দুই প্রার্থী জড়িত। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের বক্তব্যকে রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে বিবেচনা করলেও নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে বিজয়ী প্রার্থীর মন্তব্যকে উপেক্ষা করা যায় না।
উপনির্বাচনে জয়ী প্রার্থী আওয়ামী লীগের নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন ২৯ এপ্রিল সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণের পর সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, ভোলার লালমোহনে বিএনপি নেত্রীকে ধর্ষণ করা হয়নি, তার শ্লীলতাহানি করা হয়েছে। সংসদ সদস্য শব্দের ধূম্রজাল দিয়ে পরিস্থিতিকে আড়াল করার সযত্ন প্রয়াস করেছেন। তার কথায় মনে হচ্ছে, কোনো নারীর শ্লীলতাহানি বড় একটা অপরাধ নয়। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত অভিধানে ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির যে অর্থ দেয়া আছে তাতে একটিকে আরেকটি থেকে আলাদা করা কষ্টকর। এই অভিধানে ধর্ষণ বলতে বলা হয়েছে বলাত্কার, শ্লীলতাহানি বলতে বোঝানো হয়েছে নারীর সম্ভ্রমহানি এবং সম্ভ্রম বলতে বোঝানো হয়েছে মান, মর্যাদা ও সম্মান।
সংসদ সদস্য শাওন কি মনে করেছেন ধর্ষণ হলে নারীর সম্ভ্রমহানি হয় না? শ্লীলতাহানি শব্দটি প্রয়োগ করে একজন নির্বাচিত সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন তা স্পষ্ট নয়। এদেশের আইনে অবশ্য দুটি শব্দের মধ্যে কিছুটা ফাঁক আছে। কিন্তু সমাজ সে ফাঁকটিকে গ্রহণ করেনি। একজন নারী ধর্ষিতা হলে রেখেঢেকে বলার চেষ্টা করা হয় শ্লীলতাহানি। কিন্তু এই রাখঢাকের প্রয়াস ক্ষতিগ্রস্ত নারীর জীবনে যে সঙ্কট তৈরি করে তা ভাষার বেড়াজাল দিয়ে উপেক্ষা করা যায় না।
এই সমাজে অনেকে লোকলজ্জার ভয়ে ধর্ষণের মতো শব্দটি ব্যবহার করতে চান না। তবে এখানে যেটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তা হচ্ছে, ধর্ষণের ফলে নারীর সম্ভ্রম বা মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকে কি-না ? এ প্রশ্নের সোজা জবাব—না। এ সমাজে যারা বিভিন্নভাবে ক্ষমতাধর, তাদের কোনো আপনজন যদি এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হতেন তাহলে বোঝা যেত, শব্দের পার্থক্যটা কোন জায়গায়? তখন কি কথার এই ফুলঝুরি ফুটত?
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কথার ফুলঝুরি ছিটিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ তার সঙ্গী অন্য দুজন নির্বাচন কমিশনার। নির্বাচনের আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিবিসি’র সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, স্বয়ং আল্লাহ নেমে এলেও ভোলার নির্বাচনকে কিছু করতে পারবে না। তাহলে কি তিনি ধরে নিয়েছিলেন ভোলার নির্বাচনী ফলাফল নির্ধারিত হয়ে আছে? এ জন্য তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
চলছে মামলার প্রস্তুতি। নির্বাচন কমিশন এবারের নির্বাচনকে নিয়ে অনেক আজগুবি নিয়ম-কানুনও চালু করেছে। এর একটি হচ্ছে তথাগত বহিরাগত প্রসঙ্গ। এই বহিরাগত ব্যবস্থা প্রয়োগ করে তারা কী বোঝাতে চেয়েছেন? অনেক ক্ষেত্রে প্রার্থী নিজেই তো বহিরাগত হয়ে থাকেন। বাংলাদেশের সংবিধানের কোথাও এক জেলার লোককে অন্য জেলায় বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি।
এই বহিরাগত ও অবহিরাগত তর্ক দেশের ক্ষতি করেছে অনেক। প্রসঙ্গত, এক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। একটি এলাকায় প্রার্থী ভোটার না হওয়ার কারণে সে এলাকার নির্বাচনে বহিরাগত বলে বিবেচিত হবেন না অথচ তার সমর্থকরা বহিরাগত বলে বিবেচিত হবেন—এটা কোন ধরনের আবদার! নির্বাচন কমিশন বলছে, তারা এ বিষয়ে পূর্বাহ্নে একটি আপসরফা করেছিলেন। আপসরফা দিয়ে কি সাংবিধানিক অধিকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করা যায়? আপসরফা কি অন্যায়ের সমর্থন করে?
নির্বাচন সম্পর্কে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সর্বশেষ বক্তব্য ছাপা হয়েছে ৩০ এপ্রিল। রাজনীতিবিদদের মতো তিনিও বেশ উচ্চকণ্ঠে বলেছেন, ভোলার নির্বাচন নিয়ে কথা বলে বাতাস গরম করতে চান না।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, কী সেই বাতাস গরম করা কথা? সত্ সাহস যদি থাকে এবং মেরুদণ্ড যদি শক্ত হয় তাহলে বাতাস গরম করা কথা বলতে আপত্তি কোথায়? না নতজানু হয়ে তারা এসব বলার সাহস পাচ্ছেন না অথবা নির্বাচনের দিন তারা যে চাপের সম্মুখীন হয়েছিলেন তা বলতে চান না? একই সময়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাংবাদিকদেরও একহাত নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ঢাকায় বসে সাংবাদিকরা ভোলা-৩ আসনের উপনির্বাচনের খবর রেখেছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হয়তো জানেন, ছাপা হওয়ার আগে খবর ঢাকায় বসে লিখতে হয়। তিনি এ ব্যাপারে অজ্ঞ এমনটা বলার মতো দুঃসাহস নেই। এখানে ব্যাখ্যা একটাই, আর তা হচ্ছে নির্বাচনের আগে-পরে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কর্মকাণ্ড বোধ হয় তার পছন্দ হয়নি।
একটি ডার্টি ইলেকশনের আয়োজন করার পরিণতিতে নির্বাচন কমিশন বক্তৃতা-বিবৃতিতে নিজেও ডার্টি হয়ে গেছে।
নির্বাচন কমিশনে ৩০ এপ্রিল আয়োজিত মূল্যায়ন সভা শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার আরেকটি গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন এমন সব ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দিয়েছিল যারা নাকি ভোট গ্রহণে বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে সামারি ট্রায়াল বা তাত্ক্ষণিক বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দেয়ার বিধানের কথা জানতেন না। নির্বাচন কমিশন কি বিষয়টি জানত না, না অজ্ঞ লোকদের নিয়োগ দিয়ে তাদের ওপর দায় চাপাতে চেয়েছে? এই ম্যাজিস্ট্রেটরাই আরও বলেছেন, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গেলে পরাজিত প্রার্থীর লোকজনকেও জেলে পাঠাতে বা জরিমানা করতে হবে। তাতে একটি পক্ষ নির্বাচন বর্জনের অজুহাত পেয়ে যেত।
এ কারণে হার্ডলাইনে যাননি তারা। হার্ডলাইনে যাওয়ার আর কী বাকি আছে? তারা তো বলেই দিলেন, পরাজিত প্রার্থী সব কর্মকাণ্ডের হোতা। বিজয়ী প্রার্থীর সমর্থকরা কিছুই করেনি ! অবশ্য এ ধরনের প্রত্যয়নপত্র না দিলে কথার ফুলঝুরি ছোটাতে পারবে না নির্বাচন কমিশন। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সেটিই সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। এ দায় নির্বাচন কমিশনকে নিতে হবে।
ভবিষ্যতে অন্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন যে পরিস্থিতিকে আরও তিক্ত করবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দল, সাংবাদিকদের হেদায়েত করতে কম যায় না। কিন্তু তাদের হেদায়েত করবে কে? Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।