সন্ত্রাস আর সন্ত্রাসে গোটা দেশের মানুষ ছিল তটস্থ। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায়। সন্ত্রাস দমনে শুরু হলো ক্লিনহার্ট অপারেশন। তথাকথিত হার্টএ্যাটাকের নামে হত্যা করা হলো ৫৮ জন মানুষকে। এদের কেউ কেউ দাগি সন্ত্রাসী।
আবার অনেকে ছিল একেবারেই ইনোছেন্ট।
সন্ত্রাস দমন হলো না।
সরকার এরপরে একটি রাষ্ট্রীয় বর্বর বাহিনী নামানোর আগে রিহার্সেল দিলো। চিতা-কোবরা ইত্যাদির মাধ্যমে। তাতেও কাজের কাজ কিছুই হলো না।
এরপরের ইপিসোড সবার জানা। একেবারেই কালো কাপড়ে ঢাকা। দেখতেও যেমন সত্যিকারের একদল সন্ত্রাসী। আবার কর্মেও তার ডবল। শুরু হলো তথাকথিত ক্রসফায়ার নাটক।
প্রতিদিন নিহত হতে থাকলো একের পর এক মানব।
সন্ত্রাসী মারা যাচ্ছে। তাই সাধারণ মানুষ খুশি হতে থাকলো। কারণ দেশের মানুষের কোন আস্থা নেই বিচার ব্যবস্থার প্রতি। আইনের নানা ফাঁকফোকর গলিয়ে দাগী ক্রিমিনাল, সন্ত্রাসী, খুনি আইনের হাত থেকে বেরিয়ে আসতো।
এরপর আবার অপকর্ম। ফলে সন্ত্রাসী-অপরাধী নিহত হচ্ছে তাতেও মানুষের মনকে এতটুকু ছুয়ে যেতো না। যারা মারা যাচ্ছে বা যাচ্ছিল তাদের সবাই যে অপরাধী তাও কিন্তু নয়। হত্যা করা হয় জনপ্রিয় রাজনীতিক আহসানউল্যাহ মাস্টার হত্যা মামলার সাক্ষী সুমনকেও। এমন অনেক উদাহরণ দেয়া যায়।
এলিটফোর্স নামধারী এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী বাহিনী হত্যা-নির্যাতনের পাশাপাশি জড়িয়ে পড়লো নানান দুর্নীতিতে। সন্ত্রাসী বা চাঁদাবাজ নয় এমন ব্যক্তিদেরকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতে থাকলো। এমন অভিযোগের বহু খবর সংবাদপত্রের পাতায় প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।
বাংলাদেশের পুরনো বাংলা পত্রিকা দৈনিক সংবাদ। এই পত্রিকার ৩০ এপ্রিল, ২০১০ সংখ্যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট ছাপা হয়েছে।
রিপোর্টের শিরোনাম হলো, 'নির্যাতন চালিয়ে দু'জনের কাছ থেকে মিথ্যা স্বীকারোক্তি নিয়েছে আরএবি (RAB)। এইতো মাত্র ক'দিন আগে খোদ রাজধানী ঢাকায় নিহত হন এসআই গৌতম। গত ১৯ এপ্রিল তিনি খুন হন সন্ত্রাসীদের হাতে।
চাঞ্চল্যকর এই গৌতম হত্যা মামলার সন্দেহভাজন আসামি হায়দার আলী ও জাকিরকে গ্রেফতার করে আরএবি। এরপর তাদেরকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখানো হয়।
আর তাদের স্পর্শকাতর স্থানে বৈদ্যুতিক শক দেয় আরএবি। এভাবেই জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করা হয় তাদের কাছ থেকে। এসআই গৌতম হত্যাকান্ড পরবর্তী তদন্ত ও আসামি গ্রেফতার নিয়ে রীতিমত ড্রামা শুরু হয়েছে। এই নাটকের অভিনেতা পুলিশ, আরএবি ও ডিবি পুলিশ।
সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে অপারেশন ক্লিনহার্ট থেকে শুরু হয় অক্টোবর ২০০২ সালে।
এই অপারেশন পরবর্তীকালে ২০০৪ সালে গঠিত হয় এলিটফোর্স নামধারী দেশের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী বাহিনী আরএবি। অপারেশন ক্লিনহার্ট চলাকালে আর্মির হাতে ধরা পড়া মানেই তিনি হার্ট এ্যটাকে মরবেন। এতে কোন সন্দেহ নেই। তারপরে আরএবির কর্মকান্ড শুরু হয় ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে। এরপর বদলে গেলো হার্টএ্যাটাকে মৃত্যুর কাহিনী।
শুরু হলো ক্রসফায়ার নাটক।
ক্রসফায়ার মানে দুপক্ষের 'ব্যাপক গোলাগুলি'। এরপরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর হেফাজতে থাকা অভিযুক্ত'র নিশ্চিত নিহত হওয়া। তবে বন্দুকযুদ্ধের সময় গোগুলিতে ব্যস্ত অন্য কোন সন্ত্রাসী মারা যায়নি কখনও। কেবলমাত্র যিনি গ্রেফতার বা আটক হয়েছিল সেই ব্যক্তিই নিহত হয়।
এটাই নাটকের মূল উপজীব্য।
কালক্রমে ক্রসফায়ার এনকাউন্টার ও বন্দুকযুদ্ধ নাম ধারণ করে। ক্রসফায়ার ও ক্লিনহার্ট এ্যাটাকসহ বিনা বিচারে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের ঘটনা চলছেই। এভাবে এখন পর্যন্ত নিহত'র সংখ্যা ১,৭০০ এর অধিক। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের অধীনেই বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হলো ১৮০ জন।
সর্বশেষ ৩০ এপ্রিল, ২০১০ ঝিনাইদহে নিহত হয় গিয়াসউদ্দিন নামে একজন (সূত্র-ডেইলি স্টার, ১ মে, ২০১০)।
দেশে সরকার, আইন, বিচারালয় আছে। কেউ কোন অপরাধ করলে তার শাস্তি হবে এটাই স্বভাবিক। কিন্তু অপরাধীর অপরাধ প্রমাণের আগেই তাকে হত্যা করা। এটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় কী? গণতান্ত্রিক ও সভ্য কোন সমাজে রাষ্ট্র কখনও কোন হত্যা-নির্যাতন বা অপরাধ সংঘটন করতে পারে কী?
বিনা বিচারে মানুষ হত্যা নিয়ে আমাদের দেশে রাজনীতিও কম হচ্ছে না।
আজ যারা ক্ষমতায় তারা বিরোধী দলে থাকতে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের বিপক্ষে সোচ্চার ছিল। অথচ ক্ষমতায় বসে ঠিক তার উল্টোটি। আর বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকাকালে এই রাষ্ট্রীয় খুনি বাহিনী সৃষ্টি করেছিল। এখন তাদের অবস্থান ভিন্ন পথে। এইতো আমাদের রাজনীতি!
মহাজোট সরকারের অন্যতম শরিক দল ওয়ার্কাস পার্টি।
এই দলের সভাপতি রাশেদ খান মেনন বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধের দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কোন ফল হয়নি। এ বিষয়ে মহাজোট সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উল্টাপাল্টা বক্তব্য দিতে শোনা গেছে।
নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান বলেন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড অপরাধ দমনের একটি বিকল্প পন্থা (সূ্ত্র: যায়যায়দিন, ৪ অক্টোবর, ২০০৯)। তিনি আরও বলেন, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ক্রসফায়ারে ক্রিমিনাল হত্যাকান্ডে মানবাধিকার লংঘন হয় না।
বাহ, কি চমতকার মানবাধিকার জ্ঞান! আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সাহারা খাতুন ও প্রতিমস্ত্রী শামসুল হক টুকুর অভিমত হলো, আত্মরক্ষারক্ষার্থে ক্রসফায়ার বৈধ।
অবশ্য এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন যে, মহাজোট সরকার বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের পক্ষে নয়। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেন, সরকার বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের বিষয়ে জিরো টলারেন্স এর মধ্যে আছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে বলেন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে (সূত্র-নিউ এজ, ১২.২.২০০৯)।
উপরল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। কিন্তু তাদের বক্তব্যই প্রমাণ করে সরকারের কথা ও কাজের মধ্যে মিল নেই। অন্ত:ত বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের ক্ষেত্রে আমরা এটা বলতে পারি নিদ্বির্ধায়।
http://youtube.com/user/jaakashbd
http://jaakash.wordpress.com/
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।