........
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলতে সরকারি ছত্রচ্ছায়ায় বিএনএফ (বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট) নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল দাঁড় করানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অখ্যাত এই সংগঠন রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেতে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে।
বিএনপির নেতাদের দাবি, বিএনপিকে ঝামেলায় ফেলতে এবং দলটিকে নির্বাচন বয়কটে ঠেলে দিতে সরকার বিএনএফকে ঘিরে বিভিন্ন ফন্দি আঁটছে। ধানের শীষের আদলে বিএনএফের ‘গমের শীষ’ প্রতীক চাওয়া নিয়ে সম্প্রতি যে ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে, তা ওই ফন্দিরই অংশ বলে বিরোধী দলের নেতারা মনে করছেন।
বিএনএফের প্রধান সমন্বয়ক এস এম আবুল কালাম আজাদ সরকারের কোনো গোপন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা প্রথম আলোর কাছে অস্বীকার করেন।
তবে তিনি দাবি করেন, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দেশে যাতে কোনো ধরনের সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি না হয়, সে জন্য বিএনএফ অবদান রাখার চেষ্টা করবে।
এদিকে নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনের শর্ত পূরণ করতে সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় বিএনএফের নামে কার্যালয় স্থাপন এবং কাগজপত্রে কমিটি গঠনের কাজ চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছে তথ্য আছে, সরকার গোয়েন্দা বাহিনীকে ব্যবহার করে বিএনএফকে নিবন্ধন দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে এবং নির্বাচন কমিশন আজ্ঞাবহ হয়ে কাজটি সমাধা করতে সহায়তা করছে। ’
বিএনপির এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ। তিনি বলেন, ‘আমরা কারও প্রতি পক্ষপাত বা কাউকে চুল পরিমাণ বিশেষ সুবিধা দেওয়ার পক্ষে নই।
’
বিএনএফকে নিবন্ধন না দিতে গত ১১ জুলাই বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ জানানো হয়। ওই দিন বিএনপির নেতারা অভিযোগ করেন, বিএনপিকে ভাঙার লক্ষ্যে সরকারের কিছু সংস্থার সহযোগিতায় বিএনএফ নামের একটি দলকে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে। মানুষকে বিভ্রান্ত করতে বিএনএফের পোস্টারে বিএনপির প্রতীক, জিয়াউর রহমানের ছবি ও তাঁর ১৯ দফা ব্যবহার করা হচ্ছে।
অবশ্য বিএনএফকে দাঁড় করানোর পেছনে সরকারের ছত্রচ্ছায়া রয়েছে বলে বিএনপি যে অভিযোগ তুলেছে, তা নাকচ করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দেয় নির্বাচন কমিশন।
আমরা যদি এতে প্রভাব বিস্তার করতাম, তাহলে রেজাল্ট অন্য রকম হতো। এসব নিয়ে সরকারের মাথা ঘামানোর সময়ও নেই, রুচিও নেই। ’
আগামী নির্বাচন নিয়ে নানা রকম আশঙ্কা, অনিশ্চয়তা এবং নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিপরীতমুখী অবস্থান সত্ত্বেও উভয় দলই ভেতরে ভেতরে নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রস্তুতি নিচ্ছে।
অন্যদিকে নিবন্ধন পাওয়ার আগেই এস এম আবুল কালাম আজাদ গত ১৯ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় ঘোষণা দেন, আগামী নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হলেও তাতে তাঁর দল অংশ নেবে। এ ঘোষণার কিছুদিন আগে বিএনএফ নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পেতে হলে ন্যূনতম ২১ জেলা ও ১০০ উপজেলায় দপ্তর ও কমিটি থাকা আবশ্যক। বিএনএফের আবেদনে দাবি করা হয়, ৩৬টি জেলা ও ১৩৪ উপজেলায় তাদের দলীয় কার্যালয় ও কমিটি আছে। কিন্তু কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএনএফের দেওয়া তালিকার মধ্যে মাত্র ১৫ জেলা ও ৩৭ উপজেলায় কার্যালয় পাওয়া গেছে। তালিকার বাকি কার্যালয়গুলোর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
অবশ্য সর্বশেষ গত মঙ্গলবারও এস এম আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের পরবর্তী বৈঠকে তাঁদের নিবন্ধনের ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হবে বলে তিনি আশাবাদী।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তর আছে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, কার্যালয়, কমিটি ইত্যাদি যাচাই করার পর চূড়ান্ত নিবন্ধন দেওয়ার আগে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। কারও আপত্তি থাকলে তখন গ্রহণ করা হবে।
‘ধানের শীষ’ও চাইবে বিএনএফ
বিএনএফের নিবন্ধন পাওয়া না-পাওয়ার বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। কিন্তু তার আগেই দলটির সম্ভাব্য প্রতীক নিয়ে ভাবনা শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন।
গত ১৭ জুলাই প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রতীকের তালিকায় গমের শীষ নেই। আমরা বিএনএফের আবেদনের ভিত্তিতে গমের শীষ যোগ করার কথা ভাবছি। ’
এরপর এ নিয়ে বিএনপিতে উদ্বেগ দেখা দেয় এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক ওঠে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ৭ আগস্ট বিএনএফের প্রধান সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ এ প্রতিবেদককে বলেন, তাঁদের পছন্দের তিনটি প্রতীকের মধ্যে এখন আর ‘গমের শীষ’ নেই।
সংগঠনটির দায়িত্বশীল অপর একটি সূত্র জানায়, গমের শীষ নিয়ে বিতর্ক ওঠায় আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে সম্ভাব্য প্রতীক হিসেবে এখন ‘ধানের শীষ’, ‘ধানগাছ’ অথবা ‘রজনীগন্ধা’ প্রতীককে পছন্দের তালিকায় রেখেছে বিএনএফ।
এর মধ্যে ‘ধানের শীষ’ তাদের ১ নম্বর পছন্দ। এটি পাওয়া না গেলে পর্যায়ক্রমে অপর দুটি প্রতীকের জন্য কমিশনে আবেদন করা হবে। যদিও ‘ধানের শীষ’ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নির্বাচনী প্রতীক।
একসময় ধানের শীষ প্রতীক ছিল ভাসানী-ন্যাপের। পরে ১৯৭৮ সালে জাগো দল, ভাসানী-ন্যাপ, মুসলিম লীগ, ইউনাইটেড পিপলস পার্টিসহ কয়েকটি দল মিলে বিএনএফ নামে নির্বাচনী জোট গঠন করে।
ওই জোটের প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। পরে ওই জোট বিলুপ্ত ঘোষণা করে বিএনপি গঠন করা হয়। এই পটভূমি তুলে ধরে এখন নবগঠিত বিএনএফ যুক্তি দেখাতে চাচ্ছে, যেহেতু ১৯৭৮ সালে বিএনএফের নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ ছিল, তাই তারা সেই প্রতীকের ন্যায্য দাবিদার।
বিএনএফের গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্রের প্রচ্ছদেও ধানের শীষ প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছে। দেখতে তা বিএনপির প্রতীকের প্রায় অবিকল।
শুধু ধানের শীষের নিচে বাড়তি দুটি পাতা যুক্ত করেছে বিএনএফ।
বিএনএফ বলছে, নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে ধানের শীষ না পেলে তারা ধানগাছ চাইবে। আর ‘ধানগাছ’ বরাদ্দ না পেলে তৃতীয় পছন্দ হিসেবে ‘রজনীগন্ধা ফুলের ডাঁটা’ (স্টিক) চাওয়া হবে। অবশ্য ছাপার কাগজে ‘রজনীগন্ধা’ প্রতীকের সঙ্গেও ধানের শীষের একধরনের সাদৃশ্য থাকবে বলে জানিয়েছেন বিএনএফের প্রধান সমন্বয়ক।
এসব প্রতীক চাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে আবুল কালাম আজাদ মুচকি হাসি দেন।
এরপর বলেন, বিএনপি যদি প্রতীক রক্ষার জন্যও নির্বাচনে অংশ নেয়, সেটাও হবে বিএনএফের বিজয়।
বিএনপিকে ঘিরে পরিকল্পনা
বিএনএফের দায়িত্বশীল আরেক নেতা জানান, আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়া, না-নেওয়া—দুই রকম সম্ভাবনা ধরেই বিএনএফ কাজ করছে। তাঁদের লক্ষ্য, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপিকে আনতে চাপ তৈরি করা। প্রতীক নিয়ে বাগড়া বাধানো ওই কৌশলের অংশ। আর এ কৌশলের মুখে বিএনপি যদি শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়, তখন দলটির মনোনয়নবঞ্চিত ব্যক্তিদের বিএনএফে ভিড়িয়ে প্রার্থী করার পরিকল্পনা রয়েছে।
তাতেও সফল না হলে বিএনপিকে ভাঙার প্রক্রিয়া জোরদার করা হতে পারে। সে লক্ষ্যে বিএনপিতে সংস্কারপন্থী, সাংগঠনিক দ্বন্দ্বে কোণঠাসা বা অন্য কোনো কারণে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন—মাঠ পর্যায়ের এমন নেতাদের তালিকা করে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে বলেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নেতা জানান।
নাজমুল হুদার যোগদান ও প্রস্থান
এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গত বছরের ১০ আগস্ট বিএনপি থেকে বেরিয়ে সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদা বিএনএফের সঙ্গে যুক্ত হন। তাঁকে সংগঠনের আহ্বায়ক করা হয়। এ নিয়ে গত মার্চে নাজমুল হুদার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়।
তখন তিনি দাবি করেন, সরকারের একটি বিশেষ সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আগ্রহে তিনি বিএনএফের সঙ্গে যুক্ত হন।
গত ১৬ আগস্ট নাজমুল হুদার সঙ্গে আবার কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমি যখন বুঝতে পারলাম, দলটির কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা নেই এবং তারা বিএনপিকে ভাঙার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে; তখন আমি নিজেই দূরত্ব তৈরি করি এবং একপর্যায়ে সরে আসি। ’
কিন্তু বিএনএফের বর্তমান কমিটি বলছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে নাজমুল হুদা আবার বিএনপিতে ফেরার ঘোষণা দেন। এ কারণে তাঁকে গত ১১ মার্চ বিএনএফ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
বিএনএফের জন্ম ও নেতৃত্ব
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ১৯ দফায় বিশ্বাসী—এ দাবি করে ২০১১ সালের নভেম্বরে জন্ম নেয় বিএনএফ। এর প্রধান সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ, কো-চেয়ারম্যান জাহানারা বেগম ও মহাসচিব আরিফ মঈনুদ্দীন।
তাঁদের মধ্যে আবুল কালাম আজাদ এর আগে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মহাসচিব ছিলেন। তারও আগে ভাসানী-ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি দাবি করেন, তিনি বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য এবং জিয়াউর রহমানের বিশেষ সহকারী ছিলেন।
জাহানারা বেগম বিগত জোট সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। পরে বিএনপি থেকে বেরিয়ে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব হন। পরে তাঁকে এলডিপি থেকে বহিষ্কার করা হয়। আর আরিফ মঈনুদ্দীন এর আগে জিয়াউর রহমান সরকারের উপমন্ত্রী ছিলেন।
আবুল কালাম আজাদ দাবি করেন, তিনিই বিএনএফের উদ্যোক্তা।
তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১১ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লব দিবস উপলক্ষে জিয়াউর রহমানের ছয় রকমের ছবি দিয়ে রাজধানীতে বিএনএফের নামে অনেক পোস্টার লাগাই। দেখলাম, তার ব্যাপারে মানুষের বেশ আগ্রহ আছে। এরপর নানা লোকজন ও সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ’ View this link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।