মুক্তস্বর
সুতরাং খবরটা গরম। সরকার আইন করবে। সেই আইন মোতাবেক উকিল মোক্তার আইন-আদালতের কথা মাথায় রেখেই রাজনীতি করতে হবে। কাগজে এসেছে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে একাট্টা হচ্ছে দেশবাসী। বিপুল জনমত গড়ে উঠছে।
জোয়ারের মতো। এই জোয়ারের মধ্যে আছেন 'প্রগতিশীল রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি, আর আছেন কিছু উলেমাও'। আইনমন্ত্রী আগেই বলেছেন 'ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে। পবিত্র ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করা যাবে না। ' এটা খুবই খারাপ কাজ।
জঘন্য। এই জঘন্য কাজ থেকে জাতিকে মুক্ত করার মহান পরিকল্পনায় সরকার মাশাল্লা অনেক দূর এগিয়েছে। ইতোমধ্যে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে আদালত রায় দিয়েছেন। এবার একটা আইন করে নিলেই হলো। ইসলাম নয়, ধর্মনিরপেক্ষতাই রাষ্ট্রের মূলনীতি।
এতে বহির্বিশ্বে দেশের ইজ্জত বাড়বে। তবে 'ধর্মব্যবসায়ী মোল্লারা' এটা মানবে কিনা, কে জানে। না মানলেও ক্ষতি নেই। আইন আমান্য করে রাস্তায় নামলে শায়েস্তা করা হবে। সরকারের পুলিশবাহিনী গিয়ে ওদের কল্লা ফাটিয়ে আসবে।
ধরে জেলে নিয়ে যাবে। এতে সে মৌলভী পিচ্চি হোক কিংবা আশি বছরের বয়োয্যাষ্ঠ। ঠ্যাঙানো হবে তাকে। তবু ধর্মের পবিত্রতা ও দেশের ইজ্জত বিনষ্ট করা যাবেনা।
প্রশ্ন হচ্ছে আইন করে ধর্ম কিংবা ধর্মীয় রাজনীতি উচ্ছেদ করা যাবে কি? কাল মার্কস ধর্মকে আফিমের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
কমিউনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধর্মীয় কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। মসজিদ-মন্দির ও গির্জায় তালা লাগিয়ে দেয়া হয়েছিলো। কোনো লাভ হয়নি। কমিউনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার পতনের সঙ্গে সঙ্গে সাবেক কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোতে ধর্ম দ্বিগুণ শক্তিতে ফিরে এসেছে। এমনকি কিউবার মতো দেশ, যেখানে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা এখনও টিকে আছে, সে দেশে ক্রিসমাস পালন নিষিদ্ধ করার পর এখন রাষ্ট্রের নির্দেশেই পিপলস ক্রিসমাস নামে পঁচিশে ডিসেম্বরের দিবসটি পালিত হচ্ছে ।
তুরস্ক ও আলজেরিয়ার কথা ধরা যাক। তুরস্কে কামাল আতাতুর্ক আইন ও বন্দুকের সাহায্যে সেক্যুলার সমাজ গঠন করতে চেয়েছিলেন। সে দেশে তখন দাড়ি-টুপি নিষিদ্ধ হয়েছিলো। ধর্মীয় বিবাহ প্রথা বেআইনি করে সিভিল ম্যারেজ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিলো। আরবি ভাষায় কোরআন পাঠ, আজান দেয়া বন্ধ করে তুর্কি ভাষায় আজান দেয়া, কোরআন পাঠ এমনকি নামাজ পড়ারও বিধান করা হয়েছিলো।
এই বিধান অমান্য করা হলে ব্যবস্থা ছিলো কঠোর শাস্তির। কামাল আতাতুর্কের মৃত্যুর পরও এ আইন বলবৎ রয়েছে। কিন্তু ব্যবস্থাটি গোপনে বদলে গেছে। কামালপন্থী ইসমত ইনুনু যখন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট, তখনই তুরস্ক সম্পর্কে এমন খবর ফাঁস হতে শুরু করেছিলো যে, তুর্কি তরুণ-তরুণীরা কোর্টে গিয়ে সিভিল ম্যারেজ করলেও রাতে গোপনে বাড়িতে মোল্লা ডেকে এনে ধর্মীয় মতে আবার বিবাহ সম্পাদন করে। জনগণ প্রকাশ্যে বা মসজিদে গিয়ে তুর্কি ভাষায় কোরআন তেলাওয়াত করলেও বাড়িতে এসে আরবি ভাষায় কোরআন পাঠ করে এবং দোয়াদরুদ পড়ে।
তুরস্কে সেক্যুলারিজম এখন সামরিক বাহিনীর পাহারায় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় আছে বটে, সামাজিক ব্যবস্থায় নেই। সমাজ ফিরে গেছে ধর্মীয় ব্যবস্থায়। এমনকি রাজনীতিতে তার প্রভাব বেড়েছে। প্রবল। ধর্মনিরপেক্ষ নয় এমন দলের পক্ষে তাই নির্বাচনে জেতাও সম্ভব হয়েছে।
আমেরিকার চাপে কামালের সেক্যুলার সংবিধান রক্ষার নামে সামরিক বাহিনী বারবার তুরস্কের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ না করলে এবং বন্দুকের জোরে সরকার পরিবর্তন না ঘটালে তুরস্কের অবস্থা আজ কী দাঁড়াত তা সহজেই অনুমেয়।
বর্তমান আলজেরিয়ার ব্যাপারেও একথা সত্য। আলজেরিয়ার একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে ইসলামি দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠনের দাবিদার হয়েছিলো। এখানেও আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থনে আলজেরিয়ান সামরিক বাহিনী নির্বাচনে জয়ী ইসলামী দলকে ক্ষমতা গ্রহণ করতে দেয়নি। রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের পর আলজেরিয়ায় সেনাবাহিনী সমর্থিত দল ক্ষমতায় থাকতে সক্ষম হয়েছে।
একথা আফগানিস্তান সম্পর্কেও সত্য। আমরা তালেবানদের যতই অপছন্দ করি, আজ যদি আফগানিস্তানে অবাধ নির্বাচন হয়, তাহলে মার্কিন তাঁবেদার কারজাই সরকার একদিনও ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। শুধু তাই নয়, মার্কিন সেনা পাহারা উঠে গেলেই প্রেসিডেন্ট কারজাইকে শুধু ক্ষমতা থেকে নয়, দেশ থেকেও পালাতে হবে। আমেরিকা এবং পশ্চিমা দেশগুলো সর্বশক্তি নিয়ে লড়াই করেও আফগান যুদ্ধে যে জয়ী হতে পারবে না, একথা জেনেই এখন তালেবানদের মধ্যে একটি ভালো অংশকে খোঁজা শুরু করেছে, যাদের সঙ্গে আপস করে তারা সম্মান নিয়ে দেশে ফিরতে পারে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি যেন আফগানিস্তানেও না ঘটে, এটাই এখন ওবামা প্রশাসনের স্ট্র্যাটেজি।
ইসলাম সমাজে দুই ভাবে থাকে।
সামাজিকভাবে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে। রাষ্ট্র থেকে ইসলামকে উচ্ছেদ করা যায়, যেমনটা আফগানিস্তানে করা গেছে। কিন্তু সমাজ থেকে উচ্ছদ করা যায়না। দমন-পীড়নের মাধ্যমে সাময়িক চেপে রাখা যায়, কিন্তু কিছুদিন পরেই সে দিগুণ শক্তিতে ফিরে আসে। উপরের উদাহরণগুলো তার প্রমাণ।
হাজার বছর আগে ইসলাম এদেশে এসেছে এবং এখানকার জনসমাজে বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছে। ইসলামকে কেন্দ্র করে বাঙালি মুসলমানদের একটি নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এই দীর্ঘ সময় ধরে ইসলাম বাঙালি মুসলিম সমাজের সংহতি ও আত্মপরিচয়ের ঐক্য-সূত্র হিসেবে কাজ করেছে। মুসলিম দুনিয়ার সঙ্গে এদেশের যোগাযোগ বহুদিনের। একটি আন্তর্জাতিক সমাজশক্তি হিসেবে ইসলামের পরিচয়ে বাঙালি মুসলমানের অংশগ্রহণ তাই ঐতিহাসিক বাস্তবতা।
বাংলাদেশে আজ ধর্মনিরপেক্ষতার যে গুণগান চলছে, তার মূল সূত্র ইসলামবিরোধিতা। এবং তার পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কালো ছায়া। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সন্ত্রাসবিরোধিতার আড়ালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ইসলামবিরোধী লড়াই চালাচ্ছে তারই অংশ ও কৌশল হিসেবে বাংলাদেশে চলছে ইসলামবিরোধী প্রোপাগাণ্ডা। ইসলামকে মার্কিন নীতিবিশারদরা প্রমাণ করতে চায় একটা গোঁড়া, গণতন্ত্রবিরোধী জঙ্গি ধর্ম হিসেবে। আজকের বিশ্ব রাজনীতিতে খ্রিস্টান ইহুদি-ব্রাহ্মণ্যবাদী স্বার্থ একাকার হয়ে গেছে এবং এ তিন শক্তি যৌথভাবে মুসলিম দুনিয়ার ওপর খবরদারি প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
এ কারণে বাংলাদেশের ভারতপ্রেমী অংশ ইসলামবিরোধী প্রচারণায় নেমে পড়েছে। এদের লক্ষ্য বাংলাদেশকে ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য বলয়ের নিচে নিয়ে আসা। কিন্তু এ কাজে প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে এদেশের বৃহত্তর জনসমাজের ধর্ম চেতনা ও মূল্যবোধ থেকে উদ্ভূত আবেগ। ইসলামবিরোধী প্রচারণা দিয়ে এদেশের মানুষের সেই আবেগকে দুর্বল করে দেয়ার চেষ্টা চলছে। যাতে বাংলাদেশ তার আত্মপরিচয় নিয়ে দাঁড়াতে না পারে।
বাংলাদেশে ইসলামবিরোধিতার এই হচ্ছে আসল কারণ।
বাংলাদেশ একটি মুসলিম দেশ রূপে পরিচিত হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে এখানে যে চেতনা বা মতবাদটি বিজয়ী সেটি ইসলাম নয়। আইনরূপে যে বিধিমালা আদালতে প্রতিষ্ঠিত সেটিও আল্লাহর আইন নয়। এখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিজয়ী জীবনদর্শনটি হলো সেকুলারিজম। সেকুলারিজমকে যেভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা বুঝাতে ব্যবহার করা হয়, এটি শব্দটির প্রকৃত অর্থ নয়।
সেকুলারিজমের এটি এক ভুল, বিভ্রান্তিকর এবং সেই সাথে প্রতারণামূলক ব্যাখা। আজকাল সেকুলারিজম শব্দটার বাংলায় তর্জমা করা হয় ইহজাগতিকতা বা পার্থিববাদ হিসেবে। ধর্মনিরপেক্ষতার চেয়ে 'ইহজাগতিকতা' সেকুলারিজমের প্রকৃত অর্থের অনেক কাছাকাছি ও মূলানুগ বলে পণ্ডিতরা মনে করেন। আসলে ধর্ম নিয়ে সেকুলারিজম যেমন নিরব নয়, তেমনি নিরপেক্ষও নয়। এটি হলো এমন এক বিশ্বাস বা চেতনা যা শিক্ষা, সাহিত্য, সংগঠন ও রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্মের কোনো ভূমিকা ও প্রভাবকে স্বীকার করে না।
জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এ ক্ষেত্রগুলোকে সে ধর্মশূণ্য দেখতে চায়, তাই রাজি নয় ধর্মের প্রবেশাধিকার দিতে। ব্যক্তি ও সমষ্ঠির জীবনে ধর্মের প্রভাবকে বলে সাম্প্রদায়িকতা। এ ক্ষেত্রে সেকুলারিষ্টগণ শুধু আপোষহীনই নয়, যুদ্ধাংদেহীও। বাংলাদেশে এ মতবাদটির অনুসারিরা কাজ করছে ইসলামী চেতনার নির্মূলে। নির্মূল করতে চায় ইসলামের প্রতিষ্ঠায় যারাই সচেষ্ট তাদেরকেও।
ইসলামের প্রতিষ্ঠাকামী চেতনাকে তারা বলে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ চেতনা, বলে রাজাকারের চেতনা। কথা হলো, ধর্মের বিরুদ্ধে–বিশেষ করে ইসলামের বিরুদ্ধে এমন একটি সুস্পষ্ট এজেন্ডা থাকার পরও কি সেকুলারিজমকে ধর্ম নিরেপক্ষ বলা যায়? বাংলাদেশের রাজনীতি, সাহিত্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে সেকুলারিজমের নামে এটি হলো সবচেয়ে বড় ভন্ডামী বা প্রতারণা।
প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো ধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তি কি ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে? বর্তমান বিশ্বে যারাই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাসী তারাই কোনো না কোনো ধর্মের অনুসারী। তাই মুসলমানরা তো দূরের কথা, অন্য কোনো ধর্মের অনুসারীও ধর্মনিপেক্ষ হতে পারবে না। নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করার অর্থ নিজের সাথেই নিজে প্রতারণা করার শামিল।
এ দাবির পক্ষে বাস্তব কয়েকটি উদাহরণ লক্ষ করা যাক :
একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী যখন পরনে ধুতী, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, গায়ে নামাবলী ও পৈতা জড়িয়ে, মাথায় টিকি, সিঁথিতে সিঁদুর ও হাতে শাঁখা পরেন, বারো মাসে তেরো পূজা এবং তেত্রিশ কোটি দেবতায় বিশ্বাস করে প্রত্যহ মন্দিরে গিয়ে দেবতার পদপ্রান্তে অর্ঘ-নৈবেদ্য নিবেদন করেন, তখন কি তার পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষ থাকা সম্ভব? তিনি তো ধর্মের পক্ষেই চলে গেলেন। একজন মুসলিম পুরুষ যখন মাথায় টুপি, মুখে দাড়ি এবং লম্বা জামা পরেন, নামায-রোযা, হজ্জ ও উমরাহ পালন করেন, মুসলিম নারী যখন শালীন পোশাক তথা হিজাব পরেন, আল্লাহ-রাসূল, কুরআন-হাদীস, পরকাল, জান্নাত-জাহান্নামে বিশ্বাস করেন, তিনিও তো ধর্মের পক্ষেই অবস্থান নিলেন।
একজন শিখ যখন গুরু নানকের অনুসারী হয়ে দাড়ি না কেটে মাথায় পাগড়ী পরেন এবং হাতে বালা ও কৃপাণ ধারণ করেন, গুরুদুয়ারায় গিয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেন তখন তো তিনি ধর্মের পক্ষেই থাকলেন।
একজন বৌদ্ধ যখন গৌতম বুদ্ধের ‘অহিংসা পরমধর্ম’ ও ‘জীব হত্যা মহাপাপ’ নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে গেরুয়া বসন পরিধান করে আত্মার মহানির্বাণ লাভের জন্যে কৃচ্ছ্র-সাধন করেন, বোধিবৃক্ষকে পবিত্র জ্ঞান করে প্যাগোডায় যান তিনিও তো ধর্মের পক্ষই অবলম্বন করলেন।
একজন খৃস্টান যখন যিশুখৃস্টকে তাদের ত্রাণকর্তা প্রভু বলে বিশ্বাস করেন, গলায় ক্রুশ ঝুলান, ত্রিত্ববাদ ও বাইবেলে বিশ্বাস করেন, মুখে যিশুর নাম উচ্চারণ করে প্রতি রোববার গির্জায় প্রার্থনা করেন, আমেরিকার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট যখন বাইবেল স্পর্শ করে প্রেসিডেন্টের শপথ নেন এবং তাদের প্রতিটি ডলারে যখন ছাপার অক্ষরে লেখা থাকে 'IN GOD WE TRUST' তখন তারাও তো আর ধর্মনিরপেক্ষ থাকলেন না, ধর্মের পক্ষেই এলেন।
এটাই যখন প্রকৃত বাস্তবতা, তখন কতিপয় নাস্তিক ছাড়া আর ধর্মনিরপেক্ষ রইলো কারা? প্রকৃত বিষয় হচ্ছে ধর্মে বিশ্বাসী কোনো মানুষই ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না। ( আবদুল হক : ধর্মনিরপেক্ষতা মানেই ধর্মহীনতা )
যে ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষতার মডেল হিসেবে ধরা হয়, সেই ভারত কি ধর্মনিরপেক্ষ? আসলেই? ভারতের সংবিধানে সব ধর্মের সমানাধিকারের কথা বলা হলেও কার্যক্ষেত্রে সেখানে হিন্দু ধর্ম ও ভাবধারাই বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে। হিন্দুপ্রধান দেশ হিসেবে সেটাই হয়তো কারণ। বিশাল ভারতের মানুষের মধ্যে ভাষা ও সংস্কৃতিগত ঐক্য যেমন নেই, তেমনি নেই মানবধারাগত ঐক্য। আর্য-অনার্য-দ্রাবিড়দের মধ্যেও আছে বিরাট ব্যবধান।
এবং এটা চলে এসেছে যুগ যুগ ধরে। অনার্য কিংবা দ্রাবিড়দেরকে অবদমনের চেষ্টা হয়েছে। হাজার বছরে মুসলমানরা ভারতজুড়ে যে গৌরবোজ্জ্বল সভ্যতা নির্মাণ করেছে। সেই সভ্যতার কথাও মন খুলে বলা হয়না। (দ্রাবিড় বাংলার রাজনীতি : সৈয়দ মবনু) ।
রাষ্ট্র হিসেবে ভারতকে মোটেই ধর্মনিরপেক্ষ বলা যাবে না। সেখানে প্রতিবছর যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, সেই দাঙ্গায় যারা নির্যাতিত হয়, তারা হয় মুসলমান নয়তো নিম্নবর্ণের হিন্দু। এবং এই দাঙ্গায় পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের ইন্ধন থাকে। গুজরাটের গণহত্যা ও বাবরি মসজিদ তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। কারণ সেখানকার মানুষের মন আজও যথেষ্ট ধর্মপ্রভাবিত।
মানুষ ধর্মনিরপেক্ষ না হলে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়। কেবল আইন করে ধর্মনিরপেক্ষতা বা সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি বাস্তবসম্মত নয়। তাই সংবিধান বা আইন দিয়ে কোনো দেশের সামাজিক অবস্থাকে বিশ্লেষণ করতে যাওয়া একটা বড় রকমের ভুল।
এটা তো গেলো ভারতের কথা, আমেরিকা কি ধর্মনিরপেক্ষ? সেখানকার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট তো বাইবেল স্পর্শ করে শপথ নেন। তাদের মুদ্রার গায়ে লেখা থাকে 'আমরা গডে বিশ্বাস করি'।
তার মানে তারা ধর্মনিরপেক্ষ? জাতিসংঘ কি ধর্মনিরপেক্ষ? জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সব দেশের জন্যে যেমন একটা করে আসন আছে, তেমনি পোপের জন্যেও রয়েছে আলাদা একটা আসন আছে। ( ফরহাদ মজহার : সংবিধান ও গণতন্ত্র ) ধর্মনিরপেক্ষতা মানে যারা বলেন সব ধর্মের সমান অধিকার, এটা কি তবে সমান অধিকারের নমুনা?
‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়, সব ধর্মের সমান অধিকার' – এই শ্লোগানটি বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী দল আওয়ামী লীগ খুব জোরেসোরে বলার চেষ্টা করে। তবে এ শ্লোগানটির মধ্যেই রয়েছে এক ধরণের ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’। এ ফাঁকিটি চমৎকার ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার ‘ইহজাগিতিকতার প্রশ্ন’ প্রবন্ধে।
'ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়, এই কথাটা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর পরই খুব জোরেসোরে বলা হচ্ছে।
কথাটা সত্য বটে আবার মিথ্যাও বটে। সত্য এ দিক থেকে যে, রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা নাগরিকদের এ পরামর্শ দেয় না যে, তোমাদের ধর্মহীন হতে হবে; কিন্তু তা বলে এমন কথাও বলে না যে, রাষ্ট্র নিজেই সকল ধর্মের চর্চা করবে, কিংবা নাগরিকদের নিজ নিজ ধর্ম চর্চায় উৎসাহিত করবে। রাষ্ট্র বরঞ্চ বলবে ধর্মচর্চার ব্যাপারে রাষ্ট্রের নিজের কোন আগ্রহ নেই, রাষ্ট্র নিজে একটি ধর্মহীন প্রতিষ্ঠান, ধর্ম বিশ্বাস নাগরিকদের সম্পূর্ণ ব্যাক্তিগত ব্যাপার। রাষ্ট্রের ওই ধর্মহীনতাকেই কিছুটা নম্রভাবে বলা হয় ধর্মনিরপেক্ষতা। '( সাদ কামালী সম্পাদিত 'স্বতন্ত্র ভাবনা' চারদিক, ২০০৮)
আওয়ামিলীগ ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি তুলে মুখে ফেনা তুলে ফেললেও তারা ধর্মনিরপেক্ষতাকে কতটা অনুধাবন করতে পারেছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় আওয়ামি লীগের ওয়েবসাইট (http://www.albd.org/) দেখলেই।
তাদের ওয়েবসাইটে মাথার উপরে 'আল্লাহ সর্বশক্তিমান'। এটা সাক্ষ্য দেয় আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষ?
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর মুক্তিযুদ্ধের সেকুলার ও কমিউনিস্ট নেতৃত্ব সেই পটভূমিকায় বঙ্গবন্ধুর আকাশচূম্বী জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ইসলামি আন্দোলনের বিরুদ্ধে এক তরফা প্রচারণা চালিয়ে জনগণ থেকে ইসলামপন্থীদেরকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের ৭০-এর নির্বাচনী ইশতেহারে সেকুলারিজম কথা ছিলনা, শুধু ছয় দফার কথা ছিল। পরে, '৭২-এ সেকুলারিজম এবং সমাজতন্ত্রকে আমদানী বা সংযোগ করা হয়েছে এবং এর প্রেক্ষিতও ছিলো ভিন্ন। '৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর ওয়াদা ছিল, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন করবে না।
নীতিগতভাবে বঙ্গবন্ধুও সেকুলারিজমে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর রাজনৈতিক গুরু মওলানা ভাসানী ও মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগিশ ছিলেন দারুল উলুম দেওবন্দের সন্তান। তাঁদের চিন্তাধারার একটা প্রভাব বঙ্গবন্ধুর উপর পড়েছিলো, স্বাভাবিকভাবেই। তাই ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করলেও পাকিস্তানী কারাগার থেকে ঢাকায় ফিরে এসে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে বক্তৃতা দেন তাতে তিনি বাংলাদেশকে 'দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র' হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। সুতরাং আজকের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা শুধু হাজার বছরের ঐতিহ্যবিরোধিতা নয়,বঙ্গবন্ধুর চেতনাবিরোধীও।
ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা যতই বলুক অপর ধর্মের প্রতি তারা সহনশীল, এটা ঠিক নয়। অধ্যাপক খুরশীদ আহমদের লিখেছেন-- “কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রেই নয়, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই ধর্মবিরোধী উন্মত্ততা আরো বেশি পীড়াদায়ক। গ্রীসে সমগ্র মুরিয়া সম্প্রদায়ককে নির্মম মৃত্যুর শিকারে পরিণত করা হয়েছিলো। এমনকি নারী শিশুদের প্রতিও সামান্য করুণা প্রদর্শন করা হয় নি। মুরিয়া সম্প্রদায়ের প্রায় তিন লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিলো।
স্পেন ও সিসিলি থেকে মুসলমানদের উজাড় করা হয়েছে হত্যা ও নির্বাসনের মাধ্যমে। বাল্টিক রাষ্ট্রসমুহে সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমানদের সংখ্যালঘূতে পরিণত করা হয়েছে। আর এজন্য হত্যা, নিপীড়নসহ সব রকমের পন্থাই অনুসৃত হয়েছে। ফিলিস্তিনে বিদেশী এক সম্প্রদায়কে অন্যায়ভাবে আমদানি করা হয়েছে এবং মুসলমানদের ঘরবাড়ি ও সহায়সম্পদ থেকে উচ্ছেদ করে সেখানে বিদেশি ইহুদীদের গৃহদান করা হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নে মুসলমানদের ভাগ্যে যা ঘটেছে, তাও আজ সকলের জানা।
ধর্মনিরপেক্ষ পশ্চিমে এবং ধর্মহীন রাশিয়ায় এ ব্যাপারে একই মানসিকতা বিরাজ করছে। ধর্ম থেকে রাজনীতিকে পৃথক করার পর এই যে মানসিকতার অভ্যুদয়, একে যদি সহনশীলতা বলা হয়, তাহলে অসহনশীলতা বলা হবে কাকে? (ধর্মান্ধতা বনাম ইসলাম : অধ্যাপক খুরশীদ আহমদ)
সেকুলারিজমের মূল মিশন হলো, ইহলৌকিক স্বার্থ হাসিলের ফন্দি-ফিকির ও প্রচেষ্টা। সে লক্ষ্যে আত্মনিয়োগ ও নিজের সামর্থের পূর্ণ বিণিয়োগ। সে পার্থিব লাভের চিন্তাভাবনা থেকেই নির্ণিত হয় সেকুলারিষ্টদের রাজনীতি। এমন কি ধর্ম পালনেও সে সেকুলার।
ধর্মপালনের মধ্যেও সে পার্থিব স্বার্থ খুঁজে।
সেকুলারিজমের ইহকালমুখি চেতনার বিপরীতে ইসলামী চেতনাটি হলো পুরাপুরি পরকালমুখি। এখানে প্রবলভাবে কাজ করে আল্লাহকে খুশি করার চেতনা। কাজ করে, আল্লাহকে খুশি করার মধ্য দিয়ে মৃত্যু-পরবর্তী অনন্ত-অসীম সুখময় জীবন লাভের চেতনা। তখন প্রবলভাবে বেড়ে উঠে, ক্ষুদ্র পার্থিব স্বার্থ ছেড়ে অসীম পরকালীন স্বার্থের প্রতি নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার চেতনা।
এটি এমনই এক শক্তিশালী চেতনা যে প্রবল বিপ্লব আনে ব্যক্তির সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে। তখন পাল্টে যায় ব্যক্তির বাঁচার মূল উদ্দেশ্য, আচার-আচরন, কর্ম ও চরিত্র। তখন সে সমুদয় শারীরিক, আর্থিক, মানসিক সামর্থ নিয়োগ করে নিছক আল্লাহকে খুশি করতে, কোন মানুষ, কোন সরকার বা কোন প্রতিষ্ঠানকে নয়। এই আখেরাতমুখি চেতনার কারণেই অসম্ভব হয় দুর্নীতিপরায়ন হওয়া। সুন্দর সমাজ নির্মাণের জন্যে তাই কুরানে নির্দেশ এসেছে বারবার।
যাই হোক, সরকার যদি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে ফেলে, তবে বাংলার মুসলমানরা সরকারের আইন মেনে রাজনীতি ছেড়ে দেয়, নাকি আল্লাহ'র নির্দেশ পালনে দিগুণ শক্তিতে আভির্ভুত হয়_দেখার অপেক্ষায় আছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।