কে নিষিদ্ধ করবে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি
নিয়াজ মোর্শেদ/অমরেশ রায়/ওয়াকিল আহমেদ হিরন
[ সমকাল ২ আগস্ট ২০১০ ]
দেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার এখতিয়ার কার। এ নিয়ে বিতর্ক চলছে। মন্ত্রিপর্যায়ের কেউ কেউ বলছেন, এ দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হচ্ছে, না এ দায়িত্ব সরকারের। কিছু পর্যবেক্ষণ ও সংশোধনসহ সর্বোচ্চ আদালত পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়টি পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ করার পর থেকে এ বিতর্কটি চলছে বিশেষ করে রাজনৈতিক মহলে।
ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ করার বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও নির্বাচন কমিশনের বক্তব্যের পর বিতর্ক আরও দানা বাঁধে। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতামত হলো, সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এমন মতাদর্শের যে কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার এখতিয়ার রাখে সরকার। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের শর্ত ভঙ্গ করলে ওই দলের নিবন্ধন বাতিল করার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের। নিবন্ধন বাতিল ও দল নিষিদ্ধ করা এক নয়। নিবন্ধন বাতিল করলে ওই দল নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার হারাবে।
তবে ওই দল তার রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে। সেখানে বাধা দিতে পারবে না নির্বাচন কমিশন। বাধা দিতে পারে সরকার। প্রয়োজনে ওই দল নিষিদ্ধও করতে পারবে সরকার। আইনানুগ প্রক্রিয়ায় সরকার কোনো দল নিষিদ্ধ করলে সে দলের নিবন্ধন নির্বাচন কমিশনেও বাতিল হবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা মোট ৩৮। এর মধ্যে ধর্মীয় নাম যুক্ত দলের সংখ্যা ১২টি। এ দলগুলোর পরিণতি খারাপ হতে পারে বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু সব মিলিয়ে দেশে ১২০ থেকে ১২৫টি রাজনৈতিক দল রয়েছে। যদিও এর সবই নামসর্বস্ব।
সরকার বিভিন্ন সময়ে নিষিদ্ধ করেছে জঙ্গি সংগঠন জেএমবি, আল্লার দল, হিযবুত তাহ্রীর ইত্যাদি। এ দলগুলো নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ছিল না। ফ্রিডম পার্টি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ছিল। এ দলটির নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু সরকার দলটি নিষিদ্ধ করেনি।
এ দলটির কোনো কার্যক্রমও এখন চোখে পড়ে না।
সরকারের কেউ কেউ বলছেন, সংবিধান সংশোধিত হয়ে '৭২-এর সংবিধানের মূল চেতনায় ফিরে এলে আপনাআপনিই নিষিদ্ধ হয়ে যাবে ধর্মীয় দলগুলোর রাজনীতি। এ ক্ষেত্রে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপের প্রয়োজন পড়বে না। সংবিধান সংশোধনে গঠিত সংসদীয় বিশেষ কমিটির সদস্যরা এ নিয়ে মুখ
খুলতে সম্মত না হলেও আকারে-ইঙ্গিতে তারা বলেছেন, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের মধ্যেই রয়েছে এ প্রশ্নের উত্তর।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদা গতকাল রোববার সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ করার দায়িত্ব সরকারেরই।
নির্বাচন কমিশন ওইসব দলের নিবন্ধন বাতিলের ক্ষমতা রাখে মাত্র।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা সম্পর্কিত বিধান হিসেবে বাহাত্তরের সংবিধানের মূল ১২ অনুচ্ছেদে বলা ছিল, "ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, (ঘ) কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে। " মূল ৩৮ অনুচ্ছেদে ধর্মভিত্তিক সংগঠন নিষিদ্ধ ছিল। সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী এ দুটি অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল হওয়ায় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ হয়ে যাবে।
পূর্ণাঙ্গ রায় অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামীসহ কমপক্ষে ১২টি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল অস্তিত্বের সংকটে পড়বে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হওয়ায় সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধিবিধান থাকায় এ দলগুলো সরকারও নিষিদ্ধ করতে পারে। এদিকে নির্বাচন কমিশনও নিবন্ধন বাতিল করতে পারে। আর নিবন্ধনহীন ধর্মীয় দলগুলো সরকার প্রয়োজনে নিষিদ্ধ করতে পারে। এ দলগুলোর তেমন কোনো কার্যক্রম না থাকলে সরকার নিষিদ্ধ না-ও করতে পারে। আদালতের রায়ের আলোকে সংবিধান সংশোধনের পর এ দলগুলো আর থাকতে পারবে না_ এ বিষয় নিয়ে কোনো সংশয় নেই বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই গত ২২ জুলাই আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার ইচ্ছা তার সরকারের নেই। তিনি বলেন, এটা নির্বাচন কমিশনই করবে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ ইসলামী দলের নেতারা পরদিনই প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে ইতিবাচক হিসেবে অভিনন্দন জানান। কিন্তু আপিল বিভাগ সংশোধনীসহ যে রায় বহাল রেখেছেন তাতে ধর্মভিত্তিক দলগুলো রাজনীতি করতে পারবে না।
এ প্রসঙ্গে সংবিধান সংশোধনে গঠিত সংসদীয় বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারম্যান এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের রায় এখন আর কেবল রায় নয়।
এটা আইনে পরিণত হয়েছে। আর এ রায়কে আত্মস্থ করে সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটি কাজ করবে। সংসদের মাধ্যমেই বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর সংসদ সংবিধানের কোনো সংশোধনীটি গ্রহণ কিংবা বাতিল করে, তা দেখার অপেক্ষায় আছেন তারা। বিশেষ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন হবে, এর আগে নয়। এদিকে বাহাত্তরের সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন বলছেন, সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হওয়ার পরই সংবিধানে সংযুক্ত হয়ে যায়। এর জন্য সংসদের অনুমোদনের প্রয়োজন নেই।
'পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া আদালতের রায়ের ভিত্তিতে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের'_ আইনমন্ত্রীর এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ড. এটিএম শামসুল হুদা।
গতকাল সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার দায়িত্ব সরকারের। নির্বাচন কমিশন কেবল দলগুলোর নিবন্ধন বাতিলের কাজ করবে।
তিনি বলেন, 'সরকার যে দল নিষিদ্ধ করবে, আমরা তার নিবন্ধন বাতিল করব। এখন যা বলা হচ্ছে, তা অগ্রিম বলা হচ্ছে। আমরা রাজনীতি বুঝি না, রাজনীতি করি না।
তাই অগ্রিম কথা বলার প্রয়োজন নেই। সংবিধান সংশোধনে গঠিত কমিটি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিলে আমরা দেখব। '
নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন গতকাল সমকালকে বলেছেন, 'ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করতে হলে সরকারকেই করতে হবে। তবে যা করা হবে, সামগ্রিকভাবে সবার ভালোর জন্যই করা হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ প্রথম থেকেই বলে আসছেন, ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের।
তবে গতকাল তিনি তার আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। গতকাল সমকালের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংবিধানে ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের বিধিনিষেধ রয়েছে। যদি কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল সংবিধানকে লঙ্ঘন করে বা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধিবিধান অনুসরণ করে, তাহলে নির্বাচন কমিশন তাদের নিবন্ধন বাতিল করতে পারে। সংবিধানই হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন। সংবিধান লঙ্ঘন করে ও ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করবে_ এটা তো হতে পারে না।
তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিতে পারে। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিল করার ক্ষমতা আছে, কিন্তু দল বাতিল করতে পারবে না।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত সংবিধানের ১২ ও ৩৮ অনুচ্ছেদ দুটি জাতীয় সংসদে কার্যকর হলে তখন নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত পদক্ষেপের প্রশ্নটা আসবে। তিনি বলেন, আইনগত পদক্ষেপ হিসেবেই ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২০ ধারায় সরকারকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা দেওয়া আছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।