লোকালয়ে মোর আলয়, তবু বাস করি অন্যলোকে
আমরা কথায় কথায় বুচ্ছেন, বুচ্ছ, কী বুঝলা, এই জাতীয় শব্দ প্রায়ই ব্যবহার করে থাকি। শুনতে অপ্রয়োজনে মনে হলেও আসলে প্রয়োজনে। কারণ “বুচ্ছ” শব্দটা ব্যবহারের ফলে একটা আত্মতৃপ্তি আসে। মনে হয় যেন কথাটার গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেল বা বক্তব্যটা জোরালো হল। কারো কারো ক্ষেত্রে এটা একটা মুদ্রাদোষে পরিণত হয়।
যা মহা বিরক্তিকর এবং কখনও কখনও মহা হাস্যকর। কারণ শব্দটার প্রকৃত উচ্চারণ “বুঝেছেন” হলেও বলার সময় দেখা যায় সবার নিজস্ব স্টাইল, নিজস্ব উচ্চারণভঙ্গী, যা রীতিমত “ক্রিয়েটিভ”! আমার ব্যক্তিগত গভীর পর্যবেক্ষণ এবং আমার বোনের নানাবিধ অভিজ্ঞতার সম্মিলিত প্রচেষ্টা এই মূল্যবান সংগ্রহ:
বুজলা তো:
প্রথমেই আসুক আমার রুমমেটের কথা (নামটা উহ্য থাক। নাইলে মাইর খাব)। ও রুমে ঢুকেই ননস্টপ বলে যায় ওর জীবনে আজ সারাদিনে কী কী মহা গুরুত্বপূর্ণ(এবং অগুরুত্বপূর্ণ) ঘটনা ঘটে গেছে। এবং একটু পরপর তার সন্দেহ হয় যে আমরা মন দিয়ে শুনছি না, তখন প্রতিটা বাক্যের আগে ও পরে যোগ করে- বুজলেন জাফরিন আপু,......বুজলেন তো? এবং তাতেও শান্তি না পেয়ে সবার নাম ধরে আলাদা আলাদা ভাবে জিজ্ঞেস করে, বুজলা তো নিপা? বুজলা তো অমুক? বুজলা তো তমুক?
বুসচেঁও:
আমাদের একজন পুরোনো টীচার ছিলেন যাঁর কাছে আমরা প্রাইভেট পড়তাম।
তিনি খুব সুন্দর করে অংক বোঝাতেন এবং সঙ্গে সঙ্গে নাকি সুরে অদ্ভুত টানে জিজ্ঞেস করতেন- “বুসচেঁও?” স্যারের সেই অদ্ভুত উচ্চারণ বানান করে লিখাটা খুব কঠিন, শব্দটা যে আসলে কী তা উদ্ধার করতেই আমাদের অনেকদিন লেগেছে। সবাই মিলে গোলমিটিং এর মাধ্যমে এর শ্রুতিউদ্ধার করে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে স্যারের এ অভিনব বচনের উপযুক্ত জবাব দেওয়া ছাত্র হিসেবে আমাদের পবিত্র কর্তব্য। অতঃপর স্যার যখন যথারীতি বোর্ডে অংক বুঝিয়ে বললেন “বুসচেঁও?” তখনই আমাদের একজন বলে উঠল, “জ্বি স্যার বুসচিঁউ”। স্যার পিছন ফিরে তাকালেন। সবাই চুপচাপ।
এরপর আবারো একই ঘটনা। তখন এটা আমাদের কাছে সুপার ইন্টারটেইনমেন্ট ছিল। যদিও আমরা হাজার চেষ্টা করেও স্যারের সেই ঐতিহ্যবাহী ডায়লগ চেঞ্জ করতে পারিনি, যার ফলে আমার ছোটবোন এখন সেই স্যারের কাছে পড়ে এবং অংক বোঝানো শেষে তাকেও শুনতে হয়, “বুসচেঁও?”
বুসতে পাশচ:
আবারো আরেকজন টীচারের কথা। ইনি আমাদের স্কুলের ম্যাডাম। ম্যাডাম ছিলেন দারুন স্মার্ট।
আমরা রীতিমত তার ফ্যান ছিলাম। আর আমার চোখে তিনি ছিলেন হিরো (হিরোইন)। এমনিতে তার কথা বলাও সুন্দর। কিন্তু ক্লাসের অল্প সময়ে অতি দ্রুত পড়া বোঝাতে গিয়ে না কি অধিক স্মার্টনেসের ঠেলায় জানিনা, তিনি আরো একধাপ এগিয়ে বলতেন- “বুসতে পাশচ?” এত সুন্দরী এবং এত প্রিয় ম্যামের মুখে এমন ভাষা শুনে দুঃখই লাগতো। আমরা তার সবকিছু ফলো করার চেষ্টা করতাম, খালি “বুসতে পাশচ” বাদে।
বুশচিস বুশচিস:
এক যে ছিল জিনাত। আমার ছোটবোন জুঁইয়ের বান্ধবী। কেমন বান্ধবী জানিনা কারণ জুঁই সবসময় ওর র্দুনাম করে। এই লেখাটা দেখে পিচ্চি অনেক মজা পাবে। জুঁইয়ের মতে জিনাত খালি ঝকরমকর করে কথা বলে, আর ঝগড়া করে আর “ বুশচিস বুশচিস ” করে শাসায়! “দেখে নিব বুশচিস? বুশচিস?...”
বোজ্জো:
এ প্রসঙ্গে বরিশাইল্ল্যা মনুর কথা না বললেই নয়।
এ যে কী আজব ব্যপার, একটা এলাকার প্রতিটা মানুষের মুখে একই বুলি! বরিশালে গেলে চারিদিক থেকে শুধু কানে আসে “বোজ্জো মনু বোজ্জো?” একটু জোর দিয়ে একটু টেনে। পাত্রপাত্রী, বয়স, সম্পর্ক নির্বিশেষে সবাইকে একই ডাক।
খুব মজার। এটা সম্ভবত বরিশালবাসীর উপর নাযিলকৃত স্রষ্টার বিশেষ বাণী!
বুচ্ছন্নিইই:
এটা বলে আমাদের পাশের বাসার আন্টি। বেশ সুরেলা গলায়।
একেবারে গানের টানে। উনার বাড়ি নোয়াখালী। জানিনা এটা আঞ্চলিক ভাষা নাকি উনার স্বউদ্ভাবিত ডায়লগ!
কী, কথাটা বুঝতে হবে তো:
আমাদের জ্ঞানী ছোট্ট বন্ধু মীম এই বাক্যটির জননী। সবকিছুতেই ওর জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব। আর ওর ধারণা কোনও বিষয় ওর মত করে কেউ বোঝে না।
তাই পুনঃ পুনঃ এই বাক্যটি ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে ব্যপারটা বুঝতে হবে তো!
বুঝোনাই, কী বুঝলা:
(আল্লাহ মাফ করুক, নিজের খালার কাহিনী ফাঁস কইরা দিতাছি)
আমার খালা আমাকে খুব আদর করেন। গেলেই পেট ভরা খাবার আর গাল ভরা গল্প উপহার দেন। আমি আধা শুনি, আধার চেয়ে বেশি শুনিনা। মাঝপথে হঠাৎ বেফাঁস প্রশ্ন করে বসি। তখন আন্টি অত্যন্ত হতাশ হয়ে করুন গলায় জিজ্ঞেস করেন, বুঝোনাই? আবার প্রথম থেকে বলা শুরু করেন।
আর আমি নিজের গাধামির জন্য আফসোস করি। এরপর মুখ খুলি খাওয়ার জন্য, কথা বলার জন্য নয়। তথাপি বিপত্তি! আন্টি কিছু কথা আধা বলেন, বাকিটা চোখের ইশারায় মেকআপ করেন। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় থাকি। আন্টি আবার হতাশ।
আবার করুন নয়নে “বুঝোনাই” + জিহ্বা সহকারে বিরক্তিসূচক ধ্বনি “চ্যা”! তারপর থেকে বুঝোনাই বললেই সাথে সাথে আমি বলি হ্যাঁ। এবং সাথে সাথে পাল্টা প্রশ্ন-কী বুঝলা? এই বুঝোনাই, কী বুঝলার হাত থেকে আমার বোধহয় রেহাই নাই।
আমি বোধহয় আপনাকে বোঝাতে পারলাম না:
আমার এক টীচার আমাকে বাসায় পড়াতে আসতেন। আমি কোনও কিছু ভুল করলে বা উল্টাপাল্টা কথা বললে স্যার বলতেন, ওহ! আমি বোধহয় তোমাকে বোঝাতে পারলাম না...। আমার অরেক হাসি পেত।
স্যারের সাথে বেশ ফ্রী ছিলাম। তাই একদিন বলে ফেললাম, স্যার আপনি এই কথাটা বলেন কেন বারবার? তখন স্যার বেশ গম্ভীরভাবে বলেছিলেন, "বড় হলে বুঝবে, যখন চাকরী করবে। "
"কেন স্যার?"
"অফিসে বস যতই উল্টাপাল্টা কথা বলুক, কখনই বলা যাবে না যে, আপনি বুঝতেছেন না। তাইলেই চাকরী খতম! বলতে হবে, বিনয়ের সাথে, আমি বোধহয় আপনাকে বোঝাতে পারলাম না। "
জানিনা এটা কতটুকু সত্য।
কারণ স্যার চাকরী জীবনের নানা টিপস আমাকে বিনামূল্যে বিতরণ করলেও নিজে ছিলেন বেকার!
বুজতারছেন/বুজবার পারসেন,ইত্যাদি:
আমাদের বাড়ির দারোয়ান চাচা বলেন,“বুঝবার পারছেন”? কোনো এক নাটকে শুনেছিলাম “বুঝতারছেন”? এছাড়া বুঝলা নাকি,বুচ্ছেন ভাই ইত্যাদি কত যে ডায়লগ,সুর আর ভঙ্গী! পুনমের “বুচ্ছ বুচ্ছ বুচ্ছ” গান শুনলেও আমাদের জীবনে শব্দটার গুরুত্ব বোঝা যায়!
আসল বুঝছ:
এইবার বলি আসল বুঝছর কথা। এই পৃথিবীতে আমার পরিচিত একজন মানুষই খালি শুদ্ধভাবে বলেন “বুঝেছ?” আর তিনি আমার আম্মু। সেই প্রসঙ্গে হাসাহাসি, হানাহানি, এবং তা থেকে এ বিষয়ে অনুসন্ধান এবং তা থেকেই এ লেখার জন্ম।
কী বুঝলেন!
আশাকরি আপনারাও আপনাদের মূল্যবান অভিজ্ঞতা এতে এ্যাড করে লেখনীটিকে সমৃদ্ধ করবেন। যাতে আমরা আরো ভালোমত বুঝতে পারি...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।