এই ব্লগের সব মৌলিক লেখার স্বত্ব লেখকের নিজস্ব। মৌলিক লেখা অনুমতি ব্যতিরেকে অন্য কোথাও ব্যবহার করা যাবে না।
পৃথিবী অভ্যুদয়ের এত বছর পর এসে গ্রহে গ্রহে মানুষের যে অভিযান তা মূলত পানির অনুসন্ধান। বিজ্ঞানীরাই বলছেন, যেখানে পানি আছে সেখানেই আছে জীবনের অস্তিত্ব। এ পৃথিবী প্রাণীর আবাসভূমি হয়েছে শুধু পানির অস্তিত্বের ওপর ভর করে।
পানি বিন্দু থেকে গ্গ্নাসের মতো ছোট্ট কোনো আধারে কিংবা তার একটু এগিয়ে পুকুর বা ছোট্ট জলাশয়ে, আরও একধাপ গিয়ে স্রোতস্বিনী নদীতে, তারপর অসীমের কাছে গিয়ে সাগরের দিকে যদি তাকাই, তাহলে নিশ্চিতভাবেই প্রতিটি প্রাণীই বুঝে নিতে পারে পানিই আমাদের বেঁচে থাকার প্রধানতম নিয়ামক। এ হচ্ছে বিন্দু থেকে সিন্ধুর প্রেক্ষাপট। এ পৃথিবীর সব প্রাণী, সব বৃক্ষরাজি সবই প্রাণশক্তি ধারণ করে আছে পানির সুশীতল পরশে। প্রতি মুহূর্তেই চলছে প্রাণীর পানি গ্রহণ প্রক্রিয়া। ফসল তার শিকড় বিস্তার করে মাটির গভীর থেকে চুষে নিচ্ছে রস, যা তার জীবনীশক্তি।
মাটি হচ্ছে জননী আর পানি হচ্ছে জননীর প্রাণশক্তি। পানি না থাকলে মাটি হারাতে থাকে তার সব বৈশিষ্ট্য। প্রাণীর জন্য যে বায়ুমণ্ডল তাকে আমরা বলি জলবায়ু। পানি ছাড়া স্থল যেমন প্রাণহীন, একইভাবে প্রাণহীন বায়ুমণ্ডলও।
জলবায়ু বৈরী হয়ে উঠছে।
এই বৈরিতার সবই যেন পানিনির্ভর। পানি দিনের পর দিন হারাচ্ছে তার স্বাভাবিক অবস্থা ও অবস্থান। যেখানে তার থাকার কথা হিমশীতল কঠিন পদার্থ হয়ে, সেখানে সে চলে আসছে তরলে; যেখানে পানি সুমিষ্ট থাকার কথা, সেখানে ভর করছে লবণ; যেখানে বিশুদ্ধ পানির প্রস্রবণ থাকার কথা, সেখানে আমরা ময়লা আবর্জনা আর বিষাক্ত রাসায়নিক মেশাচ্ছি। অথচ এই পৃথিবীর জীবন, সভ্যতা, কৃষি সবকিছুই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে পানিকে কেন্দ্র করে।
পৃথিবীতে ২৬৩টি স্বাদু পানির হ্রদ ও নদী অববাহিকা রয়েছে, যা বিশ্বের ১৪৫টি দেশের সীমানায়।
এ অববাহিকাগুলোতেই পৃথিবীর ৪০ ভাগ মানুষের বাসভূমি। একেকটি নদী অববাহিকা একেকটি পরিবার। যে পরিবারের সদ্য অনেক দেশ। ইউরোপের দানিয়ুব নদী অববাহিকায় সতেরটি; কঙ্গো, নাইজার, নীল, রাইন, জাম্বেজি নদী অববাহিকায় নয়টির বেশি এবং আমাজন, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা, মেকং, টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস-শাতিল আরব, ভলগা নদী অববাহিকায় কমপক্ষে পাঁচটি দেশকে অন্তর্ভুক্ত করে। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির উৎস তো রয়েছেই।
ইতিহাস বলছে, এসব আন্তঃসীমান্ত নদী বা হ্রদ যুগে যুগে একাধিক দেশের মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পরিবেশ যেমন বিপর্যন্ত হচ্ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে পানির চাহিদা যা এই সংঘাতকে ভবিষ্যতে আরও বেগবান করবে। দেখা গেছে, গত ষাট বছরে পৃথিবীতে ২০০টির মতো আন্তর্জাতিক চুক্তি হয়েছে, তার ৩৭টির ক্ষেত্রে একাধিক দেশের মধ্যে ঘটেছে সংঘাতের ঘটনা।
কোথায় আছে পৃথিবী বা মানবসম্প্রদায়? জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে কাজ করে ২০০৭ সালে শান্তিতে নোবেলজয়ী মার্কিন বিশেষজ্ঞ আল গোর বছরখানেক আগে যে গবেষণা ফলাফল তুলে ধরেছিলেন তা হচ্ছে, মেরু অঞ্চল ও হিমালয়ের বরফ রেকর্ড পরিমাণে গলে যাওয়ায় বিশ্বের ১০০ কোটি লোক বঞ্চিত হতে পারে বিশুদ্ধ পানি থেকে। ২০০৭ সালের তুলনায় ২০০৮ সালে মেরু অঞ্চলে তুষারধস বেশি হয়েছে।
পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে গ্রীষ্ম ঋতুতে মেরু অঞ্চলের বরফ পুরোপুরি উধাও হয়ে যাওয়ার ৭৫ শতাংশ আশঙ্কা রয়েছে। 'বিশ্বের ১০০ কোটিরও বেশি লোকের সুপেয় পানির উৎস হলো হিমবাহ ও তুষারধস। ' পরিমাপে দেখা গেছে, ২০০৭ সালের তুলনায় ২০০৮ সালে উত্তর মেরুর বরফ আচ্ছাদিত এলাকা ৪৫ লাখ বর্গকিলোমিটার ছোট হয়ে গেছে। গ্রিনল্যান্ড ও এন্টার্কটিকা থেকে বছরে শত শত কোটি টন বরফ উধাও হয়ে যেতে পারে। এ কারণে বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বছরে এক মিটার বৃদ্ধি পেতে পারে।
যে কারণে বছরে বাস্তুহারা হতে হবে ১০ কোটি লোককে।
আসা যাক আন্তর্জাতিক পানি দিবস প্রসঙ্গে। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক অধিবেশনে একটি বিশেষ দিনকে স্বাদু পানি দিবস হিসেবে পালন করার কথা সুপারিশ করা হয়। পরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে ১৯৯৩ সালের ২২ মার্চকে প্রথম আন্তর্জাতিক পানি দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ইতিমধ্যে পালিত পানি দিবসগুলোতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল_ নারী ও পানি, তৃষ্ণার জন্য পানি, পানির প্রতুলতা, ভূগর্ভস্থ পানি, ভাটির অধিবাসীর জীবন, একুশ শতকের পানি, পানি ও স্বাস্থ্য, উন্নয়নের জন্য পানি, ভবিষ্যতের জন্য পানি, জীবনের জন্য পানি, পানি ও সংস্কৃতি, পানির অপ্রতুলতা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ইত্যাদি।
এর মধ্যে 'পানি ও জীবন' শিরোনামে ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত একটি পানি দশকও পালিত হয়েছে। এবারের পানি দিবসের প্রতিপাদ্য_ সু্ন্দর পৃথিবীর জন্য নিরাপদ পানি।
গঙ্গা-পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং সুরমা-মেঘনা এই তিনটি নদীপ্রণালি বাংলাদেশে তৈরি করেছে অসংখ্য নদ-নদী, তাদের শাখানদী এবং উপনদী যা বিস্তৃত হয়েছে জালের মতো। যুগ যুগ ধরে বাংলার মানুষের কৃষি, যোগাযোগ, অর্থনীতি, শিল্প-বাণিজ্য, বিনোদন, সর্বোপরি জীবনযাপনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে এ নদীগুলো। নদী যেমন আমাদের পরম বন্ধু, তেমনি চরম শত্রুও।
বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলোসহ মোট ৫৮টি নদী রয়েছে, যার ৫৫টি ভারত ও ৩টি মিয়ানমার থেকে এদেশে প্রবেশ করেছে। এ নদীগুলোই বাংলাদেশের আন্তঃসীমান্ত নদী বলে বিবেচিত। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এসব আন্তঃসীমান্ত নদী যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। এই আন্তঃসীমান্ত নদী এবং আমাদের পানিপ্রাপ্তির প্রশ্নটিই যুগ যুগ ধরে থেকে গেছে বঞ্চনার কেন্দ্রবিন্দুতে। যেখান থেকে পানি নিয়ে আমাদের সমস্যা ও সংকটের ফিরিস্তি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে।
দেশের প্রধান প্রধান নদ-নদীর বুক ভরাট হয়ে যাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলোর বিপন্ন দশা বিপর্যস্ত করছে আমাদের কৃষিকে। অনেক জায়গায় পানির স্বাভাবিক গতিকে রুদ্ধ করছি আমরা নিজেরাই। এই তো সেদিনের কথা, মুন্সীগঞ্জের আলুচাষ এলাকা ও হিমাগারগুলোতে কাজ করে ঢাকা ফিরছিলাম। ঠিক মুক্তারপুর থেকে কিছুদূর এগিয়ে আসতেই অবাক করা এক দৃশ্য দেখলাম।
জলজ্যান্ত একটি নদীকে গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে। ওই সড়কে যারা চলাচল করেন, তারা নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ সড়কের নারায়ণগঞ্জের চর সৈয়দপুরে শীতলক্ষ্যা নদীটি সোজাসাপ্টা ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এখন নদীর ওপর সরকারি ঢাকায় গড়ে তোলা ব্রিজটিকে একেবারেই অর্থহীন মনে হচ্ছে। সেখানে নদীর বিশাল এলাকাজুড়ে বালি তুলে ভরাট করা হয়েছে। দু'পাশে বাঁশ ও চাটাই দিয়ে ভরাট করা মাটি ঠেকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সেখানে মাঝনদীতে ভরাট করা মাটির ওপর একটি সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। সেখানে লেখা_ 'এই জমির মালিক...'। এভাবেই 'মালিক'দের হাতের পুতুল হয়ে পড়েছে নদী যা ছিল এদেশের মানুষের পানির চিরন্তন উৎস। এ দৃশ্যগুলো সরকারের লোকজনও হরহামেশা দেখছেন, বহু সচেতন মানুষ প্রতিদিন দেখছেন; কিন্তু কাউকেই এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করতে শোনা যায় না। দেশের প্রতিটি নদী কোনো না কোনো জায়গায় এ ধরনের আগ্রাসনের শিকার হয়েছে, যা নদীমাতৃক বাংলাদেশের নিজস্ব পরিচয় ও অবস্থানের জন্য দারুণ কষ্টের কারণ।
নদীকেন্দ্রিক আরও যেসব সমস্যা ও সংকট আছে, সেদিকে আমরা মনোযোগ দিতে পারি। এক. নদীতে প্রবাহ কমে যাওয়ায় উপকূল এলাকায় সমুদ্রের লবণাক্ত পানি চলে আসছে নদীতে। দুই. বিভিন্ন নদীর স্বাভাবিক নাব্য ও পানিপ্রবাহ ব্যাহত হওয়ায় মাছের প্রজননক্ষেত্র নষ্ট হয়ে গেছে, হাজার হাজার জেলের জীবন হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। তিন. নদীর নাব্য কমে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুম থেকে ছয় মাসেরও বেশি সময় দেশের বিভিন্ন এলাকা পরিণত হচ্ছে প্লাবনভূমিতে। কোথাও সৃষ্টি হচ্ছে স্থায়ী জলাবদ্ধতা।
চার. ভাটি অঞ্চলে নদীকেন্দ্রিক শিল্প ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছে। পাঁচ. কলকারখানার বর্জ্যের কারণে প্রধান প্রধান নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। এতে যেমন মাছসহ সব জলজ প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, একইভাবে পরিবেশেও নেমে আসছে বিপর্যয়। এছাড়াও আছে পানিতে আর্সেনিক, লবণ ও আয়রনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার মতো দুর্যোগ।
প্রতিটি বিপর্যয়ের ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে কৃষিতে।
বর্তমানে এদেশে ভূগর্ভস্থ ও ভূউপরিস্থ পানির স্তর নেমে গেছে উদ্বেগজনক পর্যায়ে, যা জনজীবন ও কৃষির জন্য বয়ে আনছে এক অশনি সংকেত।
পানির জন্য কৃষি, পরিবেশ ও জলবায়ু সবই বিপন্ন ও বৈরী দশায় পড়েছে। আজ অষ্টাদশতম আন্তর্জাতিক পানি দিবসে আমরা যখন ভাবছি নিরাপদ বা বিশুদ্ধ পানির কথা, ঠিক তখন পৃথিবীর সার্বিক পানিদূষণ ও ভয়াবহতার চিত্রই আমাদের সামনে ধরা দিচ্ছে।
পানিদূষণ এখন বড় একটি আতঙ্কের নাম। বিশুদ্ধ পানির অভাবে প্রতি বছর ১০ লাখ ৫০ হাজার শিশু মৃত্যুবরণ করে।
প্রতিদিন ২০ লাখ টন আবর্জনা বিভিন্ন জলাশয়ে পড়ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশ আবর্জনা এবং ৭০ শতাংশ শিল্পবর্জ্য এ অঞ্চলের পানি বিনষ্ট করছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মানুষ বেশি ধাবিত হচ্ছে শহরের দিকে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বর্তমানে বিশ্বের শহুরে মানুষের সংখ্যা ৩০০ কোটি ৪০ লাখ। এ সংখ্যাটি ২০৫০ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ৬০০ কোটি ৪০ লাখে।
পানিদূষণের আরও একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়াবে জনসংখ্যা, যা এখনই সুষ্ঠু পানিপ্রাপ্তি এবং এর গুণগত মানের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি।
পানির প্রশ্নে শুধু মুখের কথা কিংবা কাগজি পরিকল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার দিনও শেষ হয়ে যাচ্ছে। এখন সময় এসেছে সতর্ক কিংবা আন্তরিক হওয়ার। সে সতর্কতার মধ্যে থাকবে পানির অপচয় রোধ, পানির স্বাভাবিক গতিপথ বন্ধের চক্রান্ত রুখে দেওয়া, আন্তঃনদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করা এবং সর্বোপরি পানি নিয়ে যত অপতৎপরতা তার মোকাবেলায় যার যার অবস্থান থেকে আরও সক্রিয় হওয়া। এর বিকল্প আর নেই।
হ শাইখ সিরাজ : কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব পরিচালক ও বার্তা প্রধান, চ্যানেল আই
[সূত্রঃ সমকাল, ২২/০৩/১০]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।