একটি কৌতুহলের সূচনা ঃ
ইরানের রাষ্ট্রীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে চলমান বৎসর টি ১৩৮৯ সাল , যার প্রথম দিনটি ছিল গত ২১ মার্চ ২০১০। ইরানীয় বা পারসিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসরণকারী সারা বিশ্বের ইরানী, আফগান , তাজিক প্রমুখদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের চিত্র আমাদের দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় ও ইন্টারনেটে দেখে একটি বিষয় আমার মনে কৌতুহলের সৃষ্টি করে। আর তা হচ্ছে ইরানীয় বর্ষ শুরুর দিন টি বা 'নওরোজ ' এমন একটি দিনে যে দিন সূর্য এমনই এক অবস্থানে থাকে যার কারণে উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে দিন রাতের দৈর্ঘ্য সমান (প্রায়) ।
কৌতুহলের থেকে বিস্ময় ঃ
ইরানীয় নববর্ষ দিন টির সাথে সূর্যে উপরুক্ত বিশেষ অবস্থান মিলে যাওয়া কে আমি প্রথমে কাকতলীয় ব্যাপার মনে করে ছিলাম। কিন্তু, ইরানীয় বর্ষপঞ্জিকার পাতা উল্টাতে আমাকে আরও অবাক হতে হয়েছে।
প্রচলিত সকল বর্ষপঞ্জির মত ইরানীয় বর্ষপঞ্জি ১২ মাসের সমন্বয়ে গঠিত , যাকে Farvardin , Tir , Mehr ও Dey এই ৪ (চার) টি ঋতুতে ভাগ করা হয়েছে। আসুন ১৩৮৯ ইরানী বর্ষের প্রতিটি ঋতুর প্রথম দিনটির দিকে নজর দেই।
Farvardin এর বা বৎসরের প্রথম দিন টি ইংরেজি ২১ মার্চ , জ্যোতিবিদ্যায় সূর্যের এই দিনের অবস্থানকে বলে vernal equinox এবং দিন-রাতের দৈর্ঘ্য সমান।
Tir এর প্রথম দিন টি ২২ জুন , যে দিন টিতে উত্তব গোলার্ধে দীর্ঘতম দিন এবং দক্ষিণে দীর্ঘতম রাত।
Mehr এর প্রথম দিন টি ইংরেজি ২৩ সেপ্টেম্বর , জ্যোতিবিদ্যায় সূর্যের এই দিনের অবস্থানকে বলে autumnal equinox এবং দিন-রাতের দৈর্ঘ্য সমান।
Dey এর প্রথম দিন টি ২২ ডিসেম্বর, যে দিন টিতে উত্তব গোলার্ধে দীর্ঘতম রাত এবং দক্ষিণে দীর্ঘতম দিন।
মাসে কেন ৩০ দিন, কেন বা ৩১ দিন!
Gregorian calendar , ( যা বর্তমান দৃনিয়ায় আন্তর্জাতিক বর্ষপঞ্জি হিসাবে স্বীকৃত) , অনুসারের ৩০ দিন বা ৩১ দিনের মাসগুলো প্রায় পর্যায়ক্রমিক ভাবে আবর্ততিত হয়। শৈশবে অনেকেরই মুষ্টিবদ্ধ হাতের আঙ্গুলের খাঁজের ছন্দের ৩০ দিন বা ৩১ দিনের মাসের ছন্দ গণনা অভিজ্ঞতা আছে।
অপর দিকে,পারসিয়ান বা ইরানী বর্ষপঞ্জিতে প্রথম ৬ (ছয়) মাস গণনা করা হয় ৩১ দিনে আর পরবর্তী ৫ (পাঁচ) ৩০ দিনে ও শেষ মাস টি ২৯ বা ৩০ দিনে।
৬ X ৩১ + ৫ X ৩০ + ১ X ২৯ = ৩৬৫ দিনে।
অধিবর্ষ বা leap year ক্ষেত্র ,
৬ X ৩১ + ৫ X ৩০ + ১ X ৩০ = ৩৬৬ দিনে।
এই গণনা পদ্ধতির পশ্চাতে লোকছড়ার ছন্দের পরিবর্তে রয়েছে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষন ।
লক্ষণীয় যে , সূর্য কে র্পৃথিবীর পরিভ্রমণ সময় উত্তর গোলার্ধের বসন্ত-গ্রীষ্ম কালে শরৎ-শীত কালের তুলনায় মন্থর। অর্থাৎ, ২০/২১ মার্চ হতে ২২/২৩ সেপ্টম্বর এই অর্ধপথ পরিভ্রমণ কাল (the vernal equinox থেকে the autumnal equinox) যেখানে ১৮৬ দিন ১০ ঘন্টা; সেখানে ২২/২৩ সেপ্টেম্বর থেকে ২০/২১ মার্চ বাকি অর্ধপথ পরিভ্রমণ কাল ( the autumnal equinox to the vernal equinox ) ১৭৮ দিন ২০ ঘন্টা। উক্ত বিবেচনায় , ইরানীয় বর্ষপঞ্জির প্রথম ৬ মাস (১৮৬ দিন ভাগ ৬ মাস = ) ৩১ দিন।
অপর দিকে , পরবর্তী মাসগুলো সামান্য ছোট ।
অধিবর্ষ বা Leap year এর বিভ্রাট ঃ
ইরানী বর্ষপঞ্জির সবচেয়ে আকষণীয় দিক এর ' অধিবর্ষ' বা ' leap year' সমন্বয় পদ্ধতি।
এক সৌরবর্ষ বলতে বুঝায়, একটি নির্দিষ্ট অবস্থান থেকে সূর্যের চারপাশে একবার পূর্ণ আবর্তন করে একই অবস্থানে ফিরে আসতে পৃথিবীর প্রয়োজনীয় সময়। আর এর জন্য পৃথিবীর প্রয়োজন হয় ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৫.৫ সেকেন্ড ( 365.24224 solar day) । ৩৬৫ দিন বর্ষ গণনা করলে প্রতি বর্ষ ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৫.৫ সেকেন্ডের একটি বিভ্রাট তৈরি হয় যা ধীরের ধীরের ঋতু পরিবর্তণের সাথে বর্ষপঞ্জির অসামঞ্জস্যতা সৃষ্টি করে।
তাই, ১৫৮২ সাল থেকে Gregorian calendar বা বর্তমান দৃনিয়ায় আন্তর্জাতিক বর্ষপঞ্জিতে ৪ বর্ষ অন্তর অন্তর ফেব্রুয়ারী মাসের শেষে অতিরিক্ত ১ দিন যোগ করা হয়। ফলে , গড়ে একটি বর্ষের দৈর্ঘ দাড়ায় ৩৬৫.২৫ দিন (৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা)। এর পরেও ১১ মিনিট ১৪.৫ একটা গড় মিল থেকে যায় , যা ফলে ১২৮ বৎসরে একদিন বা ১১ ,৫২০ বৎসরে একটি সম্পূর্ণ ঋতু হেরফের হয়ে যায়। তাই প্রতি ৪০০ বৎসরে একটি 'অধিবর্ষ' বা' leap year' বাদ দিয়ে গননা করা করা হয়। এতো কিছুর পরেও দেখা যাচ্ছে, এখানে প্রকৃত সৌরবর্ষের থেকে আন্তর্জাতিক বর্ষ ২৬ সেকেন্ড দীর্ঘ হয়ে যায়।
পূর্বোক্ত জটিলতা দূর করতে ইরানীয় বর্ষপঞ্জিতে leap year পদ্ধতির পরিবর্তে নববর্ষের প্রথম দিন বা 'নওরোজ' জ্যোর্তিবিদ্যার সূক্ষ্ম হিসাবের মাধ্যমে নিধারণ করা হয়। ফি বৎসর যে বিশেষ মূহুর্ত বা লগ্নে সূর্য বিষুবরেখা অতিক্রম করে উত্তরাভিমুখি যাত্রা (vernal equinox) শুরু করে সেই মূহুর্তটিই 'নওরোজ ' লগ্ন ।
আর বৎসরের প্রথম দিন টি নির্ধারণ করা হয় ,এই ভাবে.............
'নওরোজ ' লগ্নটি (vernal equinox) টি যদি কোন নির্দিষ্ট দিনের মধ্যাহ্নের আগে হয় তবে , উক্ত দিনটিই হবে নববর্ষের প্রথম দিন বা সূচনা। আর যদি 'নওরোজ ' লগ্নটি (vernal equinox) দিনের মধ্যাহ্নের পরে তবে , তার পরের দিনটি থেকে ' নতুন' বর্ষের সূচনা। আর এ ভাবে জ্যোর্তির্বিদ্যার সূচারূপ প্রয়োগে, ইরানী বর্ষপঞ্জির সুক্ষ্মতা ১ মিলি সেকেন্ডে।
****************************************************
উৎসর্গ ঃ
তাঁদের প্রতি যাঁরা আমাকে মুসলিম বিদ্বেষী ভাবেন
এবং...........
তাঁদের প্রতি যাঁরা মুসলিম বিশ্বের বিজ্ঞানমনস্কতাকে হীনদৃষ্টিকে দেখেন।
****************************************************
কিছু সূত্র ঃ
১) Iranian calendar
Click This Link
২) A concise review of the Iranian calendar
Click This Link
৩) THE PRECISE IRANIAN CALENDAR,
http://www.zoroastrian.org/articles/The Precise Iranian Calendar.htm
৪) Zodiac – Calendar (Z-Calendar)
http://analyze.uselwatch.com/Zodiac calendar.htm
৫) Calendar 1389
http://www.shop4iran.com/taghvim.htm
৬)The March Equinox Explained
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।