গ্লিটজ : আপনার নির্মাণাধীন সিনেমা ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ নির্বাচিত হয়েছে বুসান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের অংশ এশিয়া প্রোজেক্ট মার্কেটের (এপিএম) জন্য। এশিয়ান প্রোজেক্ট মার্কেট বিষয়টা কী একটু বুঝিয়ে বলবেন?
ফারুকী : প্রথমত এটা কোনো ফান্ড না, মানে এখান থেকে আমি কোনো অর্থ পাচ্ছি না। বর্তমানে চলচ্চিত্র উৎসবগুলো চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর পাশাপাশি আরও দুটি কাজ করছে। এর একটা হচ্ছে ফিল্ম ফান্ডিং, আরেকটি হচ্ছে কো-প্রোডাকশন মার্কেট। ফিল্ম ফান্ডিংয়ের জন্য গঠিত উইংয়ে নির্মাতারা চিত্রনাট্য বা চলচ্চিত্র পাঠান।
উইংয়ের নির্বাচকরা তা দেখে অর্থায়ন করেন। আমার আগের চলচ্চিত্র ‘টেলিভিশন’ বুসানের অর্থানুকুল্য পেয়েছিল, প্রি-প্রোডাকশন দেখিয়ে। এটি কো-প্রোডাকশন মার্কেটের জন্যও নির্বাচিত হয়েছিল। কো-প্রোডাকশন মার্কেট হচ্ছে, নির্মাতা-পরিবেশকদের সম্মিলনস্থল। এখানে নির্মাতা চিত্রনাট্য বা ধারণকৃত ‘র ফুটেজ’ অথবা এডিট শেষ করা চলচ্চিত্র ফেস্টিভ্যালের কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠান।
নির্মাণাধীন এসব চলচ্চিত্র ফেস্টিভ্যালের নির্বাচকরা দেখেন এবং গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় এমন চলচ্চিত্রকে কো-প্রোডাকশন মার্কেটের জন্য নির্বাচন করেন। নির্মাতাদের চলচ্চিত্র নির্বাচিত হওয়ায় লাভ হচ্ছে, এক. প্রিমিয়ার হওয়ার আগেই চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে প্রচারিত হয় যে অমুক নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র হচ্ছে। দুই. এই কো-প্রোডাকশন মার্কেটে সারাবিশ্ব থেকে সহ-প্রযোজক, বিক্রয় প্রতিনিধি, পরিবেশকরা চলচ্চিত্রগুলো দেখতে যান। এমনকি চলচ্চিত্রে অর্থায়নের প্রতিষ্ঠান উৎসব প্রযোজকরাও যান সেখানে। তারা নির্বাচিত ত্রিশটি চলচ্চিত্রের নির্মাতাদের সঙ্গে মিটিং করেন, চিত্রনাট্য বা এডিট করা অংশ অথবা পুরো চলচ্চিত্রটি দেখে যে যার পছন্দ ও কাজের আওতা অনুযায়ী চুক্তি করেন বা আগাম কথা বলে রাখেন।
তাই এখন আধুনিক ফিল্ম কালচারের মধ্যে কো-প্রোডাকশন মার্কেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি চলচ্চিত্রের জন্য এর প্রভাব হচ্ছে, আর্ন্তজাতিকভাবে এক ছাদের নিচে সব সুবিধা পাওয়া।
গ্লিটজ : ইমপ্রেস টেলিফিল্মের সঙ্গে স্বত্ব নিয়ে কোনো সমস্যা হয়েছে কি?
ফারুকী : না, ইমপ্রেস চলচ্চিত্রটির বাংলাদেশ অংশ প্রযোজনা করছে। আর আর্ন্তজাতিক স্বত্ব সংরক্ষণ করছে ছবিয়াল প্রোডাকশন লি.।
গ্লিটজ : পিঁপড়াবিদ্যার গল্প আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।
ফারুকী : (হাসি) গল্প বলার আগে আমি এটুকু বলতে চাই, সবাই জানে আমি গল্প বলতে পছন্দ করি না। গল্পটা বেশ মজার। আমরা ছোটবেলা থেকেই পড়ে আসছি, লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে। ফলে বড় হয়ে, মাস্টার্স ডিগ্রি পেয়ে আমাদের প্রথম স্বপ্ন থাকে গাড়িঘোড়া কেনা। যারা গাড়িঘোড়া কিনতে পারে না বা ব্যাংক ব্যালান্স করতে পারে না, যাদের সুন্দর বাড়ি করা হয় না, তাদের আমরা ব্যর্থ মনে করি।
এমনকি তারা নিজেরাও মনে করে যে, তারা ব্যর্থ। এ কারণে সবার লক্ষ্য থাকে সুনীতি বা দুর্নীতি করে যেভাবে হোক সম্পদ অর্জন করা। আমাদের সমাজের বর্তমান উপলদ্ধি হচ্ছে এটা। এখন ব্যাপার হচ্ছে জীবনে তো সবাই সফল হয় না। ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে, মাস্টার্স ডিগ্রি করেছেন অনেকেই।
কিন্তু সবাই তো সফল হয় না। এই ব্যর্থ হয়ে তারা তখন কোথায় যায়? আবার এই ব্যর্থদেরও কিন্তু অনেক স্বপ্ন থাকে। তাদের স্বপ্ন-- ওই যে পিঁপড়া যেমন দশগুণ ওজন বয়ে বেড়ায়, তেমন। আসলেই তারা তো দশগুণ স্বপ্ন বয়ে বেড়ায় প্রতিনিয়ত। ফলে, এই যে, যোগ্যতার চেয়ে স্বপ্নর ভার যখন বেশি তখন কিন্তু মনোজগতে একটা ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়।
এই ভারসাম্যহীনতা আপনাকে দিয়ে এমন সব কাজ করায়। কখনও সেটা হাস্যকর হয়, কখনও সেটা ঘৃণ্য হয়, কখনও প্রচণ্ড বিপদে ফেলে দেয়। এসব বিষয় নিয়েই অস্থির তারুণ্যের গল্প পিঁপড়াবিদ্যা। এটার মধ্যে এমএলএমের প্রসঙ্গও আছে। তারপর আরও আছে ব্যক্তিগত প্রেম, প্রেমে ব্যর্থতা, লোভ।
আমাদের আশপাশের জীবনটা পুরোপুরি আছে চলচ্চিত্রটিতে।
গ্লিটজ : এবার নির্বাচিত নির্মাতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েক জনের নাম বলুন।
ফারুকী : আমরা সবাই মোহসিন মাখমালবাফের নাম জানি। ইরানের লিজেন্ডারি পরিচালক। নাওমি কাওয়াসে, জাপানের লিজেন্ডারি পরিচালক।
উনি এবার কান ফেস্টিভ্যালের জুরির দায়িত্ব পালন করেছেন। কিম জি-উন, যিনি কিছুদিন আগে ‘দ্য লাস্ট স্ট্যান্ড’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন আরনল্ড শোয়ার্জনেগারকে নিয়ে। কিম উনের প্রথম ইংরেজি চলচ্চিত্র এটি। ইন্দোনেশিয়ার গারি নুগরুহ আছেন, যার চলচ্চিত্র কান, ভেনিস, বার্লিন এমন বহু জায়গায় দেখানো হয়। ইন্দোনেশিয়ার আরও একজন আছেন এডুইন, যার চলচ্চিত্র বার্লিন কম্পিটিশনে দেখানো হয়েছে।
সমসাময়িক, প্রবীণ এ রকম অনেকের নামই আছে, যারা বিশ্ব চলচ্চিত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গ্লিটজ : বহির্বিশ্বে টেলিভিশনের অবস্থা কী?
ফারুকী : টেলিভিশনের ফেস্টিভ্যাল রান এখনও চলছে, আমরা সবসময় সব তথ্য সাংবাদিকদের দিতে পারি না। এত নিউজ কীভাবে করব। সম্প্রতি এটা সিডনি, মেলবোর্ন হয়ে এশিয়া প্যাসিফিক স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ডে যাবে, যেটা এশিয়ান একাডেমি অ্যাওয়ার্ডের মর্যাদা কুড়িয়েছে ইতিমধ্যে। সেখানে আমাদের চলচ্চিত্রটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ পেয়েছে।
৩ থেকে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে পারস্পেক্টিভ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানো হবে। আমি যাচ্ছি সেখানে। এটা আসলে চলতেই থাকবে।
গ্লিটজ : তাহলে কি শুধু ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেই দেখানো হচ্ছে আপনার টেলিভিশন?
ফারুকী : না, ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যাচ্ছে, টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছে। কোরিয়াতে সামনে থিয়েট্রিক্যাল রিলিজ হবে।
আমি আগেই তা বলতে চাই না। আগে হোক, তারপর দিন-তারিখসহ ঘোষণা করব। ওরা অবশ্য মাত্র দুমাস সময় দিয়েছে আমাদের। আর থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনেই, লাওস, কম্বোডিয়া-- এই পাঁচটা জোনের জন্য আমাদের চলচ্চিত্রের টিভিস্বত্ব বিক্রি হয়েছে বলা যায়। তবে এজেন্সির পাঠানো চুক্তিপত্রে সই দেওয়া হয়নি এখনও।
সই করলে এটাও জানাব।
গ্লিটজ : বাণ্যিজিক চলচ্চিত্র ও শৈল্পিক চলচ্চিত্র এই দুই ধরন নিয়ে বহির্বিশ্ব কী ভাবে? আদৌ কি এমন বিভাজন স্বীকৃত?
ফারুকী : দুই রকমের চলচ্চিত্র আছে, থাকবে। এটা নিয়ে কোনো মারামারি নাই এবং পৃথিবীতে এটা নিয়ে মারামারি হয়ও না। যে যার মতো চলচ্চিত্র বানাবে, এটাই স্বীকৃত।
গ্লিটজ : আপনার পিঁপড়াবিদ্যা কবে মুক্তি পাচ্ছে?
ফারুকী : আশা করছি এ বছরের শেষে অথবা আগামী বছরের শুরুতে।
কিন্তু যখনই হোক, আমি একটা শান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে চলচ্চিত্র মুক্তি দিতে চাই। মারামারি কাটাকাটি, হরতালের মধ্যে আমি আর পড়তে চাই না। কারণ একটা চলচ্চিত্র একবার পিছিয়ে পড়লে, ওটাকে আর তোলা যায় না। এই বিপদের মধ্যে দ্বিতীয়বার পড়তে চাই না আমি।
গ্লিটজ: বাংলায় পিঁপড়াবিদ্যা ইংরেজিতে অ্যান্ট স্টোরি, এমন নামকরণ কেন?
ফারুকী : আমি বাংলা নাম ঠিক করেছি পিঁপড়াবিদ্যা এবং পিঁপড়াবিদ্যার বাইরে আমি যাব না, সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
ইংরেজি নাম আমরা নিজেরা বানিয়ে দিতে পারতাম ‘অ্যান্টওলজি’। সেটা ঠিকও করেছিলাম, কিন্তু দেশের বাইরের শুভানুধ্যায়ীরা আমাকে জানাচ্ছিলেন, চলচ্চিত্রটির সঙ্গে ওই নামটা যায় না। তখন আমি বললাম কী করা যায়? সবাই বলল, পিঁপড়াবিদ্যার হুবহু ইংরেজি অনুবাদ হওয়ার দরকার নাই। ইংরেজি নামটা আমরা দেই অ্যান্ট স্টোরি বা পিঁপড়া সমাচার। কিন্তু বাংলা নামটা আবার পরিবর্তন করতে আমি রাজি ছিলাম না।
এরমধ্যে আমি পিঁপড়াবিদ্যার প্রেমে পড়ে গেছি। কিন্তু যুৎসই ইংরেজি নাম না পেয়ে শেষে অ্যান্ট স্টোরিতেই থাকতে হচ্ছে আমাদের।
গ্লিটজ : অভিযোগ আছে, আমাদের দেশে এখন চলচ্চিত্র তেমন ব্যবসা করতে পারছে না। আপনার কি মনে হয় চলচ্চিত্রের বিপণন পদ্ধতি বা বিজ্ঞাপনে কোনো পরিবর্তন আনা উচিত? সেটা কেমন হতে পারে?
ফারুকী : এক্ষেত্রে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি আমি। কারণ আমার চলচ্চিত্রের জন্য প্রচুর দর্শক পাই আমি।
সপ্তাহর পর সপ্তাহ ধরে টিকিট কেটে দর্শকরা আমার চলচ্চিত্র দেখেন। কিন্তু সবার কথা ভেবে আমাদের সিস্টেমে কিছু পরিবর্তন আনা উচিত বলে মনে করছি। দর্শকরা তিনশ টাকা দিয়ে চলচ্চিত্র দেখতে সিনেমা হলে ঢোকেন। হল কর্তৃপক্ষের হাতে ওঠা সেই তিনশ টাকা থেকে আমি প্রযোজক কত টাকা পাই! আমি তিনশ টাকা থেকে পাই মাত্র ছেচল্লিশ টাকা। এই যে শেয়ারিংটা, এটা খুবই অনায্য।
বিশ্বের আর কোনো দেশে এমন শেয়ারিং হয় না। তাই আমি মনে করি সরকারিভাবে একটা নীতিমালা হওয়া উচিত এ বিষয়ে। যেমন-- টিকিটের দাম কত হলে প্রযোজকদের কাছে নুন্যতম কত যেতে হবে। নীতিমালা না হলে আমাদের সমস্যা দূর হবে না, হাহাকার কমবে না, বাজার চাঙ্গা হবে না। আর একটা বিষয় বাস্তবায়ন করতে হবে, বাধ্যতামূলকভাবে অনলাইনে টিকিট বিক্রি করতে হবে।
যাতে আমরা নজর রাখতে পারি এবং প্রতিরোধ করতে পারি কিছু মিথ্যাচারের। এটাকে যদি আমাদের সিস্টেমে আনতে পারি, তাহলে সরকার কর বেশি পাবে, হল মালিক ও প্রযোজকদেরও লাভ হবে। প্রকৃতপক্ষে এমন একটা স্বচ্ছ নিয়ম থাকলে হল মালিক, প্রযোজক, সরকার এই তিনপক্ষের কারও কোনো লোকসান হবে না। সারাবিশ্ব এখন এই সিস্টেমেই চলে, আমরাই শুধু এমন ঘোরপ্যাঁচের মধ্যে আছি। আরও দরকার একটা বক্স অফিস ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
যা বাংলাদেশে নাই, কিন্তু অত্যন্ত প্রয়োজন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।