মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিটের খোঁজে কায়েস আহমেদ
প্রশান্ত মৃধা
-----------------------------------------------------------
তিন শব্দের সরল একটি বাক্যে গল্পের শুরু। যেন, ‘এক দেশে ছিল এক রাজা’ কথকতায় কোনও-এক গ্রামের উপাখ্যান বা বৃত্তান্ত শোনানো হবে, ‘গ্রামের নাম মালপদিয়া। ’ এরপরে আরও একটি তিন শব্দের বাক্য মালপদিয়াকে আঞ্চলিক উচ্চারণে পরিচয় করিয়ে দেয়া, ‘লোকে বলে মালোইদ্দা। ’ তারপর মাত্র দু’টি বাক্যে গ্রামটির প্রাকৃতিক-ভৌগোলিকতার ছবি। এই নিয়ে প্রথম অনুচ্ছেদ।
কিন্তু গল্পের ওপর একটা শিরোনাম থাকে, থাকতেই হয়, তাই পাঠককে ‘গ্রামের নাম মালপদিয়া। ’ পড়ে-নেয়ার আগেই, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটে ও মালপদিয়ার রমণী মুখুজ্জে’- এই শিরোনাম জেনে নিতে বাধ্য করে : হ্যাঁ, মালপদিয়া আছে, সেখানে রমণী মুখুজ্জেও আছেন, তবে এ কোনও গ্রামের আখ্যান নয়, বৃত্তান্ত তো নয়ই বরং এই গল্প লেখা হচ্ছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটে নিয়ে, রমণী মুখুজ্জে সেখানের এক স্মারক মাত্র। গল্পের লেখক গল্প আর গ্রামের ভেতরে ঢুকছেন পরিব্রাজকের ইচ্ছায়, ‘জৈনসার গ্রাম থেকে পথ প্রদর্শক হয়ে আসা যুবকটি বিরক্ত হয় মনে মনে। ’
২.
অকালপ্রয়াত কথাসাহিত্যিক কায়েস আহমেদের (২৫ মার্চ, ১৯৪৮- ১৪ জুন, ১৯৯২) শেষ গল্পগ্রন্থ লাশকাটা ঘর-এর সবচেয়ে বড় আর দীর্ঘ শিরোনামের গল্প ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটে ও মালপদিয়ার রমণী মুখুজ্জে’তে ছিল পরবর্তী উত্তরণের আভাস। কায়েস আহমেদের মৃত্যুর পরে প্রকাশিত তার মিতায়তন রচনাবলিতে অন্তর্ভুক্ত ‘গোপাল কামারের তলোয়ার’ (এটি সম্ভবত লেখকের শেষ গল্প-প্রচেষ্টা) গল্পটিকে একটু তীব্র-চোখে নজরে পড়লে, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃকঃ ’-এর সঙ্গে ‘গোপাল কামারের তলোয়ার’-এর ভাষার আপাত সাদৃশ্য পাঠকের কোনোভাবে নজর এড়ায় না।
যদিও ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃকঃ’-র বীজ কায়েস আহমেদের মাথায় ঢুকেছিল ১৯৭৯-এ মালপদিয়ায় প্রায় এক অবলম্বনহীন ভ্রমণের ভেতর দিয়ে; ওই সময়ে বাংলাদেশ আগাপাস্তলায় সেনাছাউনির রঙে ছয়লাপ, গল্পটি লিখেছেনও ওই রঙের দোর্দণ্ড প্রতাপের ভেতরেই (১৯৭৮-৮৬); আর, ‘গোপাল কামারের তলোয়ার’ (দৈনিক সংবাদ, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৯১) প্রকাশিত হয়েছে সামরিক উর্দির রঙ নাগরিক জনরোষে মুছে গেলে। ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটে’-র গল্পভাষার সঙ্গে লাশকাটা ঘর-এর আর-কোনও গল্পের গল্পভাষার প্রায় মিল নেই বলে হয়তো উত্তরণের অঙ্গীকারের প্রক্রিয়াটি আবিষ্কৃত হয় সহজেই। এই আবিষ্কারের সূত্র ধরেই গল্পপাঠে সজ্ঞান (!) পাঠককে তাকাতে হয় তাঁর পরবর্তী গল্পের দিকে, এক ভাষা-সাজুয্যের সেতু খুঁজে নেয়ার জন্যেই যেন, আপাতভাবে। ভাষা সাযুজ্য খুঁজে দেখার সঙ্গে এই গল্প পাঠের ভেতর দিয়ে কায়েস আহমেদ পাঠককে বানিয়ে দেন ভেদ-বুদ্ধির রাজনীতির অসাড় পুতুল। গল্প তখন আর শুধুই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিটে খোঁজার গল্প থাকে না।
কায়েস আহমেদ গল্পের শব্দের পর শব্দে গাঁথতে থাকেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, নিজভূমে পরবাসী পঙ্কিল জীবন যাপনে দায়গ্রস্ত মানুষের ছবি। যে পাঠকের শুধুই ভ্রমণ আর সংবাদের ভাষ্যে তথ্য তুলে নেয়ার কথা, সেই ভ্রমণের সেই সংবাদ পাঠ আর পাঠককে নেয়া হয় না; বরং তাকে গ্রহণ করতে হয় মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার সলজ্জ চোখ, যুগপৎ কায়েস আহমেদের সঙ্গে চলতে থাকে অদৃশ্য হাত ধরে চলা পথ।
৩.
মালপদিয়া পৌঁছানোর পরেই কায়েস আহমেদ সংকটে পড়ে যান, ‘এই গণ্ডগ্রামে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে চেনার তো প্রশ্নই ওঠে না, এতো বছর পর এই গ্রামেরই মানুষ তাঁর বাবা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়কেই বা কে চিনবে?’ এই সংশয়ের জিজ্ঞাসা সঙ্গে নিয়ে জনে জনে না খুঁজে তিনি খুঁজে নিতে চান গ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন মানুষটিকে। জানলেন রমণী মুখুজ্জে তার নাম, ‘ওই যে গাছপালা, ওইখানে গেলেই একতলা পাকা দালান, ওইটাই রমণী মুখুইজ্জার বাড়ি। ’ বাড়িতে ঘাটশিলার স্টেশন মাস্টার অশীতিপর রমণী মুখুজ্জেকে পেলেন, আর তাঁর ছেলে এক সময় ঢাকা লায়ন সিনেমার বুকিং ক্লার্ক বিমলকেও পেয়ে যান।
কথোপকথনে কায়েস আহমেদ জানলেন রমণী মুখুজ্জে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিনতেন, ‘হরিহর বাড়ুইজ্জা এই গ্রামের প্রথম গ্রাজুয়েট, তার ছেলে সুধাংশু বাড়ুইজ্জা বড় সরকারী চাকরি করতো [ঃ] সুধাংশু বাড়ুইজ্জার বিয়াতে কলিকাতায় নেমন্তন্ন খাইচি, ভালো খাওন দাওন হইছিলো, গ্রামের মানুষ যে ক’জন কলিকাতায় আছিলো, তাগো খুঁইজা খুঁইজা নেমন্তন্ন করছিলো হরিহর বাড়ুইজ্জা, বেশ বড়ো ঘরে বিয়া হইছিলো। ’ কিন্তু কায়েস আহমেদ যখন তার উদ্দেশে কথা বলেন, আচ্ছা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিনতেন না? হরিহর বাড়ুইজ্জের ছেলে সুধাংশু বাবুর ছোট, খুব বড় লেখক। তখন রমণী মুখুজ্জে মাথা নাড়েন, ‘না চিনি না। ’ তবু একটু জানতে পেরেই কায়েস আহমেদ খুশি। তিনি বিমল বাবুকে তার বাবার কাছে হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিটের কথা জিজ্ঞেস করতে বলেন।
কিন্তু উত্তর আসে সেই একই, এ গ্রামে ঢোকার পরে যে প্রশ্নের মুখে তিনি আরও অন্তত বারদুয়েক পড়েছেন, ‘ক্যান্, জায়গা জমির কোনও ব্যাপার?’ বিমল বাবু তার বাবাকে ব্যাপার বুঝিয়ে বলার পরে, রমণী মুখুজ্জে প্রথম কায়েস আহমেদের উদ্দেশে কথা বলেন, ‘ভিটা তো আর নিজের না, হরিহর বাড়ুইজ্জার বাবার মামা ব্রজনাথ চক্তোত্তির, হরিহর বাড়ুইজ্জা ওই বাড়িতে মানুষ; কিন্তু সেই ভিটার কিছুই অহন আর নাই, অন্যেরা আছে, কেউ চিনবোও না। ঃ আমার তো সেই অবস্থা নাই, নাইলে আমিই নিয়া যাইতাম, আমি ছাড়া আর চিনবো একমাত্র মোহান্ত মণ্ডল, আপনারা তার লগে দেখা করেন। ’
মোহান্ত মণ্ডলও সরাসরি একই প্রশ্ন ঠুকে দেন, ‘বিষয়টি কি কন তো? হরিহর বাড়ুইজ্জা, ব্রজনাথ চক্কোত্তি হগলেরই নাম জাইন্যা এত দূর থেইকা ভিটার খোঁজে আইছেন, আসল বিষয়টা কি, জায়গা জমিনের ব্যাপার?’ তাকে বুঝিয়ে বলার পরে, সেই ভিটাতে কারা থাকে জানতে চাইলে মোহান্ত মণ্ডলের গলায় অসন্তোষ ধ্বনিত হয়, ‘কারা আর থাকবো? যারা থাকনের তারাই আছে। ’ মোহান্ত মণ্ডল কায়েস আহমেদকে হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিটে চিনিয়ে দেবার জন্য একটি বারো-তের বছরের ছেলেকে সঙ্গে দেয়। ‘বালকের সঙ্গে আমরা বাঁদিকের উঁচু পাট ক্ষেতে উঠে যাই, ছোট্ট এক টুকরো উঁচু ডাঙ্গা জমি, (হয়তো মোহান্ত মণ্ডলেরই) তার সরু আল ধরে এগিয়ে সেই ডাঙার শেষ সীমানায় গিয়ে পৌঁছাই।
’ তখন কায়েস আহমেদ দেখতে পান, ‘নীচের আগাছা ভরা ঢালুর পরেই একটি ডোবার মতো পুকুর, সেই পুকুরের ওপারে ভেঙে যাওয়া ছোট্ট পুরানো ঘাট, মাটির ভেতর থেকে ভাঙাচোরা নোনা ধরা ইট বেরিয়ে আছে, তার ওপরই টিনের চালের খান দুই হতশ্রী বেড়ার ঘর দাঁড়িয়ে আছে, তার উঠোনে শাঁখা-সিঁদুরহীন মহিলাকুল, শিশু এবং বালক-বালিকা দেখা যায়। ’
‘এই হলো ব্রজনাথ চক্রবর্তী ভিটে। ’ কিন্তু এখানো গল্পের শেষ নয়। শেষে যেতে কায়েস আহমেদকে লিখতে হয় আরও দুটো পৃষ্ঠা। ‘এই হলো ব্রজনাথ চক্রবর্তীর ভিটে।
’ লিখতেই তার ভ্রমণ শেষ হয় ঠিকই, পাঠককে আর তাঁর সঙ্গে হাঁটতে হয় না, পাঠকও হাঁটেন না। গল্পকথক সগত সংলাপে নিজের উপলব্ধির গল্প শোনান ওই দু’ পৃষ্ঠায়। সেখানে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আছেন, তার বাবা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ও আছে, আছেন ব্রজনাথ চক্রবর্তীও; এই এতক্ষণের ভ্রমণে কায়েস আহমেদ যাদের এখানে সঙ্গে পেয়ে যান- রমণী মুখোপাধ্যায়, বিমল মুখোপাধ্যায় ও মোহান্ত মণ্ডলই যেন হয়ে ওঠেন এতক্ষণের মূল প্রাপ্তি, ‘কিন্তু কি পেতে চেয়েছিলাম? দরিদ্র বারুইদের বাড়ি বাড়ি পুজো করে সংসার চালানো অকৃতদার দরিদ্র ব্রাহ্মণ ব্রজনাথ চক্রবর্তীর বাড়ি এতো দিনে আমাদের কি রূপ দেখাবে? কিন্তু সেই বাড়ি দেখতে এসে যা পেলাম- রমণী মুখুজ্জে, বিমল, তার পরিবার, মোহান্ত মণ্ডল- এমন অপ্রত্যাশিতভাবে এত পাওয়া কে ভেবেছিল আগে?
৪.
শেষ হওয়ার পরও এই গল্প পাঠকের সামনে ঝুলিয়ে দেয়া প্রশ্নবোধক। কায়েস আহমেদ যখন রমণী মুখুজ্জের বাড়ির পৈঠায় পৌঁছেছিলেন, তখন তার পুত্রবধূ জানতে চেয়েছিলেন, ‘আপনারা কি হিন্দু না মোসলমান?’ কেন এই প্রশ্ন? এর জবাব জানতে, জেনে নিতে কায়েস আহমেদকে দ্বিধায় পড়তে হয়নি, কিন্তু পাঠক স্পৃষ্ট হন বিমল মুখুজ্জের সঙ্গে কায়েস আহমেদের সংলাপে। বিমল মুখজ্জে যখন নিঃসঙ্কোচে জানান, ‘কি আর কমু, দ্যাশ গ্রামের অবস্থা ভালো না, আত্মীয় স্বজন সব ওই পারে, যে কোনো দিন চইলা যাইতে পারি, পারি না খালি বাবার জন্য, এমন বৃদ্ধ, দুর্বল, অক্ষম মানুষ নিয়ে এতো দূরের পথ কেমনে যাই, বাবা দেহ রাখলেই যামু গিয়া।
কেমনে থাকি কন, নিজের জায়গা জমি তা-ও রক্ষা করা দুষ্কর, জীবনের ওপর দিয়াও হামলা গেছে, ঘরে ওইলো ডাকাতি, এমুন কইরা ভয়ে ভয়ে মানুষ বাঁচে কেমনে!’ অথচ দেশ ছেড়ে যেতে নারাজ মোহান্ত মণ্ডল। কায়েস আহমেদ তাকে, ‘এদিকের অবস্থা কেমন?’ জানতে চাইলে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেন, ‘অবস্থা আর কি!’ হাসলেন। ‘আছি, বাড়িতে দুইবার কইরা ডাকাইত পড়লো, আছি। ’ ‘আছি’ বলার সঙ্গে সঙ্গে আবার হাসি। বড় বিচিত্র সেই হাসি।
যেন কাউকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছেন, দেখি আমার কি করতে পারিস!
বিমল মুখুজ্জে আর মোহান্ত মণ্ডলের সংলাপে ফারাক বিস্তর, ফারাক তাদের শ্রেণিতে, বর্ণেও- অন্তত পদবি তো তাই বলে। বিমল মুখুজ্জের বাবা ছিলেন ঘাটশিলার স্টেশন মাস্টার, কলকাতা শহরে কাটিয়েছেন, বিমল নিজে চাকরি করেছেন ঢাকায়, এক ভাই পশ্চিমবঙ্গের বাটানগরে সংস্কৃতের শিক্ষক। আর মোহান্ত মণ্ডল মৃত্তিকা-নির্ভর ঘোর কৃষক। এই নিজস্ব জমি ছেড়ে তিনি যাবেন কোথায়?
তবে এই শ্রেণিগত পার্থক্যই কিন্তু শেষ কথা নয়। উভয়ের সম্প্রদায়গত মিল আছে বলেই কায়েস আহমেদ লিখেছেন: ‘যার জন্যে বিমলকে পিতার মৃত্যুর প্রতীক্ষায় প্রহর গুনতে হয় এবং ব্রজনাথ চক্রবর্তীর ভিটেতে এখন কারা থাকে জানতে চাইলে মোহান্ত মণ্ডলের গলায় অসন্তোষ ধ্বনিত হয়, ‘কারা আর থাকব? যারা থাকনের তারাই আছে।
’
অথচ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা তার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, ‘অধিকাংশ বারুইজীবী ও ২/৩ ঘর কায়স্থ ছিল। বারুইগণ চাষী শ্রেণীর লোক, পানের ব্যাবসা তাদের ছিল না। ক্ষেতের ফলস, বাড়ির শাক সবজি ও কলা, কাঁঠাল, আম ইত্যাদি বিক্রি করিয়া সংসার চালাইতো। ঃআমাদের গ্রামে হিন্দু মুসলমান দু’ জাতীয় লোকেরই বাস, কিন্তু হিন্দুর সংখ্যা অনেক বেশী। মুসলমানগণ এক ভিন্ন পাড়ায় বাস করিয়া আছে।
দু’ জাতির মধ্যে তখন এতো সদ্ভাব দেখিয়াছি যে, তাহার শতাংশ এখন থাকিলেও বর্তমান কালের বীভৎস কাণ্ড ঘটিতে পারিত না। ’ ঘটে-যাওয়া সেই ‘বিভৎস্য কাণ্ডের’ সশরীর সাক্ষী হয়েছিলেন তার পুত্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৬ আগস্ট ১৯৪৬-এর হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে শান্তি স্থাপনে জন্যে বের হয়েছেন তিনি। তখন সংসারে তাঁর দারিদ্র্য চরমে, পরিবারের জনেরা বিপন্ন। রাতে চোর এসে রান্নাঘরের সব কিছু নিয়ে গেছে।
তবু এই ব্যক্তিগত দুঃখকষ্ট দূরে ঠেলে রোগজর্জর শরীর নিয়ে তিনি ছুটে যান উপদ্রুত এলাকায়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ডাইরিতে লিখেছেন: ‘দাঙ্গার সংবাদ শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। দাঙ্গা হাঙ্গামা হবে এরকম জানাই ছিলো, তবু মনে হলো- কি আপশোষ! কি আপশোষ!ঃ কালীঘাট অঞ্চলে শিখদের সঙ্গে মুসলিমদের ভীষণ সংঘর্ষ হয়েছে শুনলাম। ফাঁড়ির ওদিকে নাকি গোল বেঁধেছে। মসজিদের সামনে ভিড় দেখে এলাম।
ঃ মিটমাটের চেষ্টা ব্যর্থ হবে, কাল বিকালের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছি। ঃ ধীরে শান্ত আত্মপ্রতিষ্ঠা ভাব না বজায় রাখতে পারলে নিশ্চয় মার খেতাম। ‘শালা কম্যুনিস্ট! ‘মুসলমানের দালাল। ’ রব উঠেছিলো চারদিকে। ঃ ফাঁড়ির মোড়টা জনহীন।
দূরে চারু মার্কেটের দিকে রাস্তায় হাঙ্গামা হচ্ছে। পাশে একটা বাড়িতে আগুন লেগেছে। কেপি লেনে বহু লোক উত্তেজিন, হিংস্র। ছাদ থেকে এক ব্যাটা চিৎকার করল- ‘ওই সেই ব্যাটা ঔপন্যাসিক যায়। ’ ধীর পদে চলতে লাগলাম।
৫.
আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটে খুঁজতে আসা কায়েস আহমেদ তো হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বীভৎস কাণ্ড’-এর উত্তর খুঁজতে হয় পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় সচেতন প্রয়াসে, চোখকে কাগেজের একবারে কাছে নামিয়ে যেন চোখ ঝাপসা দেখতে দেখতে লিখতে পারে এমন নম্র ইচ্ছায় শব্দের উত্তাপ তিনি ছড়িয়ে যান :
১। ‘আপনারা কি হিন্দু না মুসলমান?’ বড়ো বিব্রত কর প্রশ্ন। আমাদের সঙ্গী গাইডটি সঙ্গে সঙ্গে বলে, ‘না আমরা হিন্দ না মুসলমান। ’ মহিলা রান্নঘরের দরজায় খুঁটি ধরলেন। তারপর আমদের দিকে আবার তাকালেন, সেই বিষাদময় মুখের দৃষ্টি দেখে বুকের ভেতর আবার মুচড়ে উঠলো, আহা, কেনো পরিচয় দিতে গেলো।
মনে মনে বলি, পরিচয় পেয়ে ওই যে তিনি হঠাৎ রান্নাঘরের দরজার খুঁটি ধরলেন, ওই যে চোখের তার কেঁপে উঠলো, ওই যে দৃষ্টি ছায়া পড়লো- ওসব দেখে আহত হয়ো না, লজ্জিত হও। এ তোমার এ আমার পাপ!
২। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির পর আজ পর্যন্ত- এতো বছর পরও বিভক্ত ভারতবর্ষে প্রবল দুই ধর্ম সম্পদায় হিন্দু-মুসলমান- যারা তাঁদের স্ব স্ব জন্মভূমিতে ‘সংখ্যালঘু’ এই নামে অভিহিত হয়ে আসছে- অর্থাৎ সংখ্যাগুরু দ্বারা রাষ্ট্রীয়ভাবে শাসিত হয়ে আসছে, কি হিন্দু কি মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের এক ধরনের মানস সংকট সৃষ্টি হয়ে আছে, মনোজগতের সেই পরবসী চেতনাই তার শিকড় আলগা করে দিয়েছে স্বদেশের ভূমিতে। কিন্তু পাশাপাশি সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের একজন নিঃস্ব ব্যক্তি এ ধরনের মানসসংকটে ভোগেন না- তার কারণও সেই একই রাজনীতি।
৩।
এই যে মানুষজন দূরে দূরে, এই যে দূরে দূরে ছায়া-ঘন-বাড়ি-ঘর না- কোনও অশান্তি নেই, কেমন শান্ত, স্থির, মন্থর, সরল- এই আকাশ আর গাছপালার মতোই স্বাভাবিক। অথচ এর গভীরে যে জটিল কুৎসিত কূটিল বাস্তবতা সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে! মানুষের শ্রমে ঘামে, ক্ষুধায়-দারিদ্র্যে, ভালোবাসায়, আতঙ্কে, অশ্রুতে, দীর্ঘশ্বাসে মিশে আছে। তাকে তো এর মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে না। কী সীমাহীন অসঙ্গতিময় এই বাস্তবতা!
৬.
এক ভিটে খোঁর গল্প শোনাতে শুরু করেছিলেন কায়েস আহমেদ নিজস্ব ভ্রমণের হাত ধরে, সেই হাত দিয়েছিলেন পাঠকের হাতে। গল্প, গল্পে পেয়ে-যাওয়া মানুষেরা মানে গল্পের চরিত্রেরা আর তাকে সে পথে যেতে দিল কই? প্রত্যেকে সশরীরে জীবন্ত হয়ে মূর্তিমানের মতো আপনাকে খুলে দেখিয়ে দিল- কায়েস আহমেদও দূঢ় কলেমে লিখে গেলেন সেই কাহিনি।
আজও এই গল্প লিখিত হচ্ছে সন্দেহে, সংশয়ে আর কূচালের রাজনীতিতে। বাংলাভাষী পাঠকমাত্রই ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটে ও মালপদিয়ার রমণী মুখুজ্জে’ পড়ে নিজেকে দেখে নেবেন নিজের মতো করে নিজস্ব বোধ বিশ্বাস উপলব্ধিতে। এই উপলব্ধির রাসায়ন পান করে আলোর সন্ধানে বেরিয়ে তখন রক্তাক্ত হৃদয়ে তখন শুধুই অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা, কায়েস আহমেদের চাবুকের তোড়ে রক্তাক্ত হয়।
[দৈনিক ইত্তেফাক / ২ এপ্রিল ২০১০ ]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।