সত্যের চেয়ে অপ্রিয় আর কিছু নেই
আবু আহমেদ
অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
-------------------------------------------
অবশেষে অনেক বাধা এবং সন্দেহ নিরসন করে অর্থনীতির বৃহত্তম কোম্পানি গ্রামীণফোন সফলভাবে তার আইপিও বা গণ-অফার জনগণের কাছে বিক্রি করতে পারল। গ্রামীণফোন শেয়ারবাজারে আসুক, আমরা তা এ জন্যই চেয়েছিলাম যে, এই আসার একটা প্রতীকী অর্থ আছে। এর মাধ্যমে জনগণ অর্থনীতির বৃহত্তম কোম্পানির মালিক হবে।
এখন থেকে পাঁচ বছর আগে অনেকেই গ্রামীণফোন কেন শেয়ারবাজারে আসছে না, সেই কথাটি অতি জোরের সঙ্গে তুলে ধরেছিলেন।
আমি সেই দিন অবাক-বিস্ময়ে দেখছিলাম, কীভাবে আমাদের অর্থনীতিতে মোবাইল টেলিফোন কোম্পানিগুলো একটা মনোপলি ধাঁচের বাজার তৈরি করে মিনিটে সাত টাকা করে কলচার্জ ধার্য করে জনগণকে শোষণ করছিল। তাদের ওই অর্থনৈতিক এবং বেআইনি বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ টেলিকম রেগুলেটরি কমিশন ব্যর্থ ছিল। মনে হচ্ছিল, নিয়ন্ত্রক সংস্থা অর্থনীতি এবং বাজারের প্রাথমিক ধারণাটুকু জানে না। বরং উল্টো নিয়ন্ত্রক সংস্থার লোকজন ওদের দাওয়াতে অতিথি সেজে এমন বক্তব্য দিত যেন আমাদের অর্থনীতিতে মোবাইল টেলিফোন কোম্পানিগুলো অনেক উপকার করে চলেছে।
এই সেই দিন অর্থ মন্ত্রণালয় সিমকার্ডের ওপর সামান্য ট্যাক্স আরোপ করল।
এটা নিয়েও হইচই হলো। ওই হইচইয়ে শামিল হলো আমাদের ব্যবসায়ী সমাজের অনেক চেনা মুখও। কিন্তু তারা ঘুণাক্ষরেও এটা বলল না যে কেন এই গরিব অর্থনীতিতে এত বেশি কলচার্জ নেওয়া হচ্ছিল।
আমি যখন টেলিফোন কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে আসার পক্ষে বলতাম, তখন অনেকে বলতেন, ‘আরে ভাই, এটা তো ওদেরকে দেওয়া লাইসেন্সে নেই। ’ আমি ভাবলাম, আমাদের রেগুলেটররা জনস্বার্থ সম্বন্ধে কত উদাসীন হলে জনগণের কাছে শেয়ার বেচতে হবে, এমন কোনো শর্ত ছাড়াই এত বড় বিদেশি কোম্পানিকে এই বাজারে ব্যবসা করার অনুমতি দিল।
গ্রামীণ টেলিফোন টেলিনর নামে পাকিস্তানেও ব্যবসা করেছ। স্বেচ্ছায় এই কোম্পানি শেয়ারবাজারে আছে এবং অনেক মূল্য দিয়ে লাইসেন্স কিনেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, এখানে লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে তেমন কিছু ঘটেনি।
এক বড় ব্যাংকার আমাকে বাজেট-পরবর্তী কোনো একদিন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এক আলোচনায় নিয়ে গেলেন। সেখানে করপোরেট ট্যাক্স এবং সিমকার্ডের ওপর ট্যাক্স বসানো নিয়ে আলাপ হচ্ছিল।
আমি তখনকার গ্রামীণফোনের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বললাম, ‘গ্রামীণফোন কেন শেয়ারবাজারে আসছে না?’
তিনি প্রশ্ন শুনে কিছুটা রাগই করলেন। বললেন, ‘শেয়ারবাজারে আসতে হবে কেন? আমাদের শেয়ারবাজার গ্রামীণফোনকে কেনার জন্য উপযুক্ত নয়। ’ তাঁর ওই কথা শুনে যত না হতাশ হয়েছি, তার চেয়ে বেশি রাগ হচ্ছিল আমাদের রেগুলেটরের ওপর। লাইসেন্স শর্তে যদি আইপিও ব্যাপারটা থাকত, তাহলে জিপির এমডি এ প্রসঙ্গে এমন কথা বলতে পারতেন না।
তার পরও আমার মতো কিছু লোক এই ইস্যুটাকে বারবার সামনে এনেছিল।
সরকারও তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর জন্য করহার কমিয়ে দিলেন। এভাবে চাপ তৈরির বিষয়টি শেষ পর্যন্ত কাজে আসে। গ্রামীণফোন দেখল, শেয়ারবাজারে এলে তাদের তিন ক্ষেত্রে লাভ। প্রথমত, জনগণ ভাববে, এটা তাদের কোম্পানি। দ্বিতীয়ত, আইপিও থেকে প্রাপ্য অর্থ দিয়ে উঁচু সুদের ঋণ শোধ করা হবে।
তৃতীয়ত, বিরাট অঙ্কের কর ছাড়ের সুযোগ গ্রহণ করা যাবে।
আজকে গ্রামীণফোনের ৪৮৬ কোটি টাকার গণ-প্রস্তাবে চার গুণ বেশি চাঁদা জমা পড়েছে বলে শুনেছি। এর দ্বারা এও প্রমাণ হলো, যাঁরা এত দিন বলে আসছিলেন যে আমাদের শেয়ারবাজার কোনো বড় ইস্যুকে হজম করতে পারবে না, তাঁরাও ভুল । আমি শুধু এই কথাই বলব, গ্রামীণফোনের সফল আইপিও অন্যদের জন্য চোখ খুলে দিয়েছে। আমাদের বিনিয়োগকারীরা সম্পূর্ণভাবে তৈরি বড় বা কথিত মেগা আইপিও কিনে নিতে।
এখন সরকার এবং ব্যক্তি খাতের অন্য বড় কোম্পানিগুলোর দায়িত্ব হলো, এই বাজার ব্যবহার করে তাদের প্রকল্পগুলোর অর্থায়নের উদ্যোগ নেওয়া। গ্রামীণফোন মাত্র ১০ শতাংশ ইক্যুইটি জনগণের কেনার জন্য অফার দিয়েছে। (গ্রামীণ ব্যাংকের ৩.৮ শতাংশ মালিকানা আছে) তাদের মেজরিটি শেয়ার ৫২ শতাংশ হাতে রাখতে হয়েছে। তাতে আমাদের আপত্তি নেই বরং আমরা খুশি। আমরা চাইছি, বিদেশি কোম্পানিগুলো তাদের মূলধনের সামান্য অংশ এই দেশের জনগণের কাছে বেচে তাদেরকে তাদের ব্যবসায়ের খুদে অংশীদার হওয়ার সুযোগ দিক।
------------
সুত্র: প্রথম আলো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।