হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে...
আ.ন.ম. বজলুর রশীদ (১৯১১-’৮৬) কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও সাহিত্যের প্রায় সব শাখায়ই তাঁর স্বচ্ছন্দ্য বিচরণ ছিল। তাঁর রচনাদির পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় বাংলা নাট্যসাহিত্যে তাঁর অবদান সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। বলা যায়, তিনি অনেকটাই নাটকগ্রস্ত ছিলেন। তিনি একদিকে নাটক রচনা করেছেন, অন্যদিকে নাট্যনিরীক্ষাও অব্যাহত রেখেছিলেন। ফলে বাংলাদেশের সাহিত্যে পরবর্তী সময় কাব্যনাটকের যে বহুমুখী প্রসার প্রচার ও জনপ্রিয়তা ঘটে তার ভিত্ নির্মাণ করেছিলেন আ.ন.ম. বজলুর রশীদ।
তাঁর নাটকে মানবজীবনের সমস্যা সংকট সামাজিক বাস্তবতা ও জটিলতার নানা মাত্রা রূপায়িত হয়েছে। তিনি ‘ঝড়ের পাখি’ (১৩৬৬), ‘যা হতে পারে’ (১৯৬২), ‘উত্তর ফাল্গুনী’ (১৩৭১), ‘সংযুক্তা’ (১৩৭২), ‘শিলা ও শৈলী’ (১৩৭৩), ‘সুর ও ছন্দা’ (১৩৭৩), ‘একে একে এক’ (১৩৭৬), ‘ধানকমল’ (১৩৭৬) প্রভৃতি নাটক রচনা করেছেন। তাঁর নাটকগুলোর শিল্পসাফল্য নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও এগুলোর পরিমিতি বোধ এবং সংলাপের কাব্যমাধুর্য বিশেষত্বপূর্ণ। নাটকে শিক্ষণীয় বিষয় বা আদর্শ প্রচার করাই ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য।
কবি-নাট্যকার বজলুর রশীদের নাটক এবং কাব্যনাটকে আদর্শের সাথে বাস্তুবতার সংঘাত, ব্যক্তি মানসিকতার সাথে চারপাশের বৈরীতা এবং মানব জীবনের চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধান সংহত শিল্পকৌশলে চিত্রিত হয়েছে।
উল্লেখ্য, বাংলা কাব্যনাটকের ইতিহাসে মুসলমান কবি-সাহিত্যিকগণের মধ্যে ফররূখ আহমদ এবং আ.ন.ম. বজলুর রশীদ কাব্যনাটক রচনায় যথেষ্ট শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষত বজলুর রশীদের রচনায় নাট্যগুণের সাথে কবিত্বের অপূর্ব মিলন ঘটেছিল। তিনি ১৯৬৬ সালে ‘ত্রিমাত্রিক’ শীর্ষক একটি কাব্যনাট্য সংকলন প্রকাশ করেন। এ সংকলনে তাঁর ‘ধনুয়া গাঙের তীরে’, ‘মেহের তোমার নাম’ ও ‘কোন এক দীপক সন্ধ্যায়’ শীর্ষক তিনটি কাব্যনাট্য পর্যায়ের রচনা স্থান পেয়েছে। এসব রচনায় একাধারে কাব্যসুষমা ও নাটকীয়তা লক্ষণীয়।
বজলুর রশীদের কাব্যনাট্যধর্মী রচনাগুলোতে মূলত লোকায়ত জীবনের উদ্ভাসন পরিলক্ষিত হয়। ময়মনসিংহ গীতিকার ‘দেওয়ানা মদিনা’ পালার কাহিনী অবলম্বনে তাঁর ‘ধনুয়া গাঙের তীরে’ রচিত। তাঁর স্বকীয়তা, কাব্যকল্পনা এবং উপস্থাপন রীতি লোকজ এই কাহিনীকে সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রা দান করেছে। ফলে ‘ধনুয়া গাঙের তীরে’ অতিপরিচিত কাহিনী অবলম্বনে রচিত হলেও একটি আলাদা শিল্পমাধ্যম হিসেবে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
ধনুয়া গাঙের তীরে...
আ.ন.ম. বজলুর রশীদ ‘ত্রিমাত্রিক’ কাব্যনাট্য সংকলনে তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের লোককাহিনীর সার্থক রূপায়ণে যতœশীল হয়েছেন।
কোন কোন সমালোচক ‘ত্রিমাত্রিক’ সংকলনে গানের প্রাধান্য লক্ষ করে কেউ কেউ এ সংকলনটি গীতিনাট্য হিসেবে আখ্যায়িত করতে চেয়েছেন। প্রকৃতার্থে এগুলো গীতিনাট্য নয়, আবার সার্থক আধুনিক কাব্যনাটক না হলেও কাব্যনাট্য পর্যায়ের রচনা হিসেবেই বিবেচ্য। বজলুর রশীদের এইকাব্যনাট্য সংকলনে তাঁর কবি-মননের আবেগ-উচ্ছ্বাস, আনন্দ-বেদনা অপরূপ কাব্যসুষমামণ্ডিত হয়ে শিল্পিতরূপে প্রকাশ লাভ করেছে। বজলুর রশীদ তাঁর কাব্যনাট্যধর্মী রচনায় কবিতার বহুল ব্যবহার করেছেন। বিশেষত তাঁর এসব রচনার সংলাপ কাব্যময় এবং সাংগীতিক মাধুর্যে পরিপূর্ণ।
বজলুর রশীদ কবিতায় নাট্যরচনার যে প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন, তার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যে সার্থক কাব্যনাটকের বিকাশ তরান্বিত হয়েছে। মানুষের অহংচেতনা ঈশ্বরের ধ্যানে মগ্ন রাখলে তার দুঃখ-বেদনা কিছুটা উপশম হয়। মানুষ যদি নিজেকে সম্পূর্ণ নির্ভরতায় ঈশ্বরের নিকট সমর্পণ করতে পারে, তাহলে সব ব্যথা-বেদনা, শোক-সন্তাপ থেকে মুক্তি পায়। সমর্পিত মানুষের কাছে পৃথিবী হয়ে ওঠে সুন্দর-- আ.ন.ম. বজলুর রশীদ ‘ধনুয়া গাঙের তীরে’ কাব্যনাটকে মূলত এ জীবনাভিজ্ঞান প্রকাশ করেছেন।
কোন এক দীপক সন্ধ্যায়...
আধুনিক কালের সাহিত্যে নারীর সতীত্ব সম্পর্কে সীতা বিষয়ক প্রবাদ চালু থাকলেও কোন চরিত্রকে এ ধরনের অগ্নিপরীক্ষা দিতে দেখা যায় না।
লোককাহিনীতে এবং লোকবিশ্বাসে এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত হওয়া একেবারে অসম্ভব নয়। কাব্যনাটকের নায়িকা মারুঈ-এর স্বেচ্ছাকৃত অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে বজলুর রশীদ নারীর সতীধর্মের বাণী প্রচার করেছেন। ‘কোন এক দীপক সন্ধ্যায়’ কাব্যনাটকে নাট্যগুণ এবং কাব্যগুণের সুমন্বয় ঘটেছে। সাধারণ লোককাহিনীকে অসাধারণ কাব্যগুণে এবং নাট্যগুণে ভূষিত করতে সক্ষম হয়েছেন নাট্যকার। গ্রামের রাখাল খেতসীনের সাথে মারুঈ-এর ভালোবাসার কাহিনীকে নাট্যকার ফগের প্রতিহিংসা পরায়ণতা, উমরের প্রেম নিবেদন এবং ব্যর্থতা, উমরের অনুতাপ এবং তাকে ভগ্নী হিসেবে গ্রহণ, মারুঈ-এর সতীত্ব নিয়ে গ্রামবাসীর সন্দেহ প্রকাশ, পরিশেষে মারুঈ-এর অগ্নি-পরীক্ষার মতো প্রভৃতি নাটকীয়তার মাধ্যমে কাহিনীটি সর্বাঙ্গ পূর্ণতা লাভ করেছে।
নাট্যকার ‘কোন এক দীপক সন্ধ্যায়’ নর-নারীর শাশ্বত প্রেমকাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে সমাজ জীবনের নিষ্ঠুরতার দিকটিও তুলে ধরেছেন। নিষ্পাপ মারুঈকে তার প্রতিবেশীরা যেভাবে অপবাদ দিয়েছে তাতে তার আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। যদিও মারুঈ অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছে কিন্তু সে তো নিজে কোন অপরাধ করে নি, তাকে জোর করে উমর তুলে নিয়ে গিয়ে প্রেম নিবেদন করেছিল; এতে তার কোন দোষ ছিল না।
আ.ন.ম. বজলুর রশীদ নাট্যকাহিনীতে মানুষের প্রত্যাশা এবং তা থেকে বঞ্চিত হওয়া বা আকাক্সিক্ষত কোন কিছুর অপ্রাপ্তির মুখে যে প্রতিশোধস্পৃহা কতটা হিংসাত্মক হয়ে ওঠে তা ফগের চরিত্রে প্রকাশ করেছেন। মারুঈ-এর নিকট প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফগ তাকে অপহরণে উমরকে প্রলুব্ধ করে অত্যন্ত নীচু মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে।
তথাপি একথা সত্য যে মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রাপ্তি না ঘটলে, তার হৃদয়ে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে ওঠে। ফগ সাধারণ রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ। তার বিশেষ কোন মহত্ত্ব নেই। সে নারীলোভী এবং প্রতিহিংসা পরায়ণ। অন্যদিকে উমরও লোভী, নারীলোলুপ এবং রূপজ মোহে মত্ত।
তবে কাব্যনাটকে উমর চরিত্রের আকস্মিক পরিবর্তন বেশ নাটকীয়। উপরন্তু নারীলোভী উমর কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ প্রকাশ করে মারুঈকে ভগ্নী হিসেবে স্বীকৃত প্রদানের মধ্য দিয়ে যে ঔদার্য দেখিয়েছে তা মহত্ত্বের স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য। সর্বোপরি ‘কোন এক দীপক সন্ধ্যায়’-এর প্রকাশশৈলী, সংলাপে শব্দযোজনায় যে নৈপুণ্য এবং উপমা উৎপ্রেক্ষা চিত্রকল্পের সমন্বয়ে কাব্যময় প্রকাশ ঘটেছে। অতএব রচনাটিকে সফল শিল্পোত্তীর্ণ কাব্যনাটক গণ্য করা যায়।
মেহের তোমার নাম...
আ.ন.ম. বজলুর রশীদ সৃষ্টিশীল মানুষ।
তাঁর ‘মেহের তোমার নাম’ শীর্ষক কাব্যনাটকের কাহিনী স্বকল্পিত হলেও এর পরিবেশনার রীতি ঐতিহাসিক। এখানে মানবহৃদয়ে যৌবনকালে যে সৌন্দর্য ও শাশ্বত প্রেমবোধ বিকশিত হয়ে ওঠে তার প্রকৃত স্বরূপ আবিষ্কারে সচেষ্ট হয়েছেন নাট্যকার। ত্রিভুজ প্রেমের এ নাট্যকাহিনীতে নারীর প্রণয় একনিষ্ঠ। তবে পুরুষের দ্বৈত প্রণয়নীতির চিত্র অঙ্কন করেছেন বজলুর রশীদ। মেহের নিগার প্রিয়তমের বিরহে ব্যাকুল হয়ে বান্ধবী ফিরোযাকে পাঠায় তার সন্ধানে।
কিন্তু ফিরোযার যৌবন সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে নওশের তাঁকে নিয়েই সংসার শুরু করতে চায়। নওশেরের প্রস্তাবে ফিরোযা কিছুটা বিভ্রান্ত ও বিচলিত হয়। এ সময় তার মনে পড়ে, সখী মেহের নিগারের কাছে সে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এরকম উভয় সংকটে নিপতিত ফিরোযা শেষপর্যন্ত বিবেকের তাড়নায় নওশেরের প্রেমপ্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। ফিরোযা স্বীয় হৃদয়ের আকাক্সক্ষা চাপা দিতে বাধ্য হয় এবং নওশেরকে বান্ধবীর নিকট পৌঁছে দিয়ে অন্তরালে চলে যায়।
এখানে নাট্যকারের সুযোগ ছিল-- ফিরোযার রক্তাক্ত হৃদয়ের রহস্য উন্মোচন করে কাহিনীকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলার। নাট্যকারের আরোপিত পরিণামে দেখা যায়-- মেহের ও নওশেরের প্রণয়জটিলতার নিরসন হয় এবং তাদের প্রণয় পরিণয়ে পরিণত হয়।
বিন্দু বিন্দু রক্ত হোক পাষাণে জমাট...
আ.ন.ম. বজলুর রশীদ ‘বিন্দু বিন্দু রক্ত হোক পাষাণে জমাট’ শীর্ষক কাব্যনাটকটিও প্রেমনির্ভর লোককাহিনী ভিত্তিকা। এ কাব্যনাটকে ধনী এবং দরিদ্রের প্রণয়গাথা রচনা করেছেন নাট্যকার। থাট্টার রাজা তামাজি জেলে কন্যা নূরীর সাথে মিলিত হয় কিনঝর হ্রদের তীরে।
রাজার প্রেমে খাঁদ নেই জানা সত্ত্বেও দরিদ্র জেলে কন্যা নূরীর মনে সদা শঙ্কা ও সদা ভয়।
রাজার গৌরব, অহংকার, বিত্ত-বৈভব এবং অনেক রূপসীর সঙ্গ ত্যাগ করে রাজা তামাচি জেলে কন্যা নূরীর প্রেমে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। নূরীও প্রেমে আত্মহারা হয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদন করে তার কাছে। নূরী-তামাচির প্রেম যখন এমনি মিলন-বিভোর তখন রাজার অনুগত সহচর নীচু জাতের কন্যাকে ভুলে যাওয়ার জন্য তামাচিকে পরামর্শ দেয়। কিন্তু রাজা নূরীর রূপে-প্রেমে এতটাই মগ্ন যে, তার কাছে ‘ম্লান যত থাট্টার গৌরব।
’ তামাচির এই কথায় বালোচ এবং রাজমাতা স্পষ্ট অনুভব করে যে, তামাচির মন থেকে সহজে নূরীকে মোছা যাবে না। তাই বালোচ এবং রাজমাতা গোপন পরামর্শ করে তামাচির সঙ্গে প্রেম করতে ইরা নামের এক সুন্দরী মেয়েকে নিয়োজিত করে। এতেও কার্যোদ্ধার না হওয়ায়, বালোচ কৌশলে একদিন মদ্যপ অবস্থায় রাজার বাহুলগ্ন করে দেয় সুন্দরী ইরাকে এবং বালোচ গুপ্ত ঘাতক সেজে নূরীকে খুন করে। এভাবেই তামাচি-নূরীর পবিত্র প্রণয়ের ট্র্যাজিক পরিণতি দেখিয়েছেন আ.ন.ম. বজলুর রশীদ।
সার্বিক বিচারে বলা যায় কাহিনী ও বিষয়বস্তুর উপস্থাপনে বজলুর রশীদ যে কাব্যিকতা এবং নাটকীয়তার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন তা কাব্যনাটকের বৈশিষ্ট্যানুগ।
কাব্যময়তার অতিরঞ্জনে কখনো কখনো নাট্যঘটনার গতিশীলতা ব্যাহত হলেও সার্বিক বিচারে বাংলাদেশের কাব্যনাট্যাঙ্গনে তিনি স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিগণিত। সামগ্রিকভাবে আ.ন.ম. বজলুর রশীদের কাব্যনাটকে যতটা কাব্যোৎকর্ষ পরিলক্ষিত হয়, ততটা নাট্যোৎকর্ষ পাওয়া যায় না। এর কাব্যগুণ নাট্যদর্শকের হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করে ছন্দ এবং সুরের মূর্ছনায়। বজলুর রশীদের রোমান্টিক কবিমানস জুড়ে জীবনের আবেগী সুরের অনুরণন ছিল। বজলুর রশীদের কাব্যনাটকের কাহিনী অনেকাংশেই বৈচিত্র্যহীন, সবগুলো কাব্যনাটকের কাহিনী প্রেমনির্ভর।
তবে তাঁর প্রকাশভঙ্গিতে নিবিড় রসবোধ এবং মাধুর্যপূর্ণ কাব্যিকতা আছে। বাংলাদেশের সাহিত্যে আ.ন.ম. বজলুর রশীদ আধুনিক কাব্যনাটকের শৈলী নির্মাণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।