আমি অতি সাধারণ মানুষ খেলাধুলার প্রতি আমার একটা তীব্র আকর্ষন আছে। এই আকর্ষনের শুরু ৯২ এর বিশ্বকাপ ক্রিকেট থেকে। আমি তখন সবেমাত্র নার্সারিতে ভর্তি হয়েছি। তখন খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস ছিল। খেলা শুরু হত ভোর ৫-৬টায়।
আমি ঘুম থেকে উঠেই টিভি ছেড়ে খেলা দেখতে বসে যেতাম। কোনোভাবেই নাকি স্কুলে যেতে চাইতাম না। আমাকে তখন অনেক কসরত করে স্কুলে নিয়ে যেতে হত।
বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের প্রতিও একটা সুতীব্র আকর্ষন আমার আছে। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর থেকেই আমি বাংলাদেশের ক্রিকেটকে নিয়মিতভাবে ফলো করছি।
এদেশের প্রায় সব খেলাই আমি দেখার চেষ্টা করি। বাংলাদেশ যখন নিয়মিতভাবে জঘন্যসব পরাজয় উপহার দিচ্ছিল, আমি তখনও নিয়মিতভাবে খেলা দেখতাম। এখন অসাধারণ খেলছে, আমি এখনো নিয়মিতভাবে খেলা দেখি। খুব কাছে থেকে এই দলটাকে আমি প্রায় ১৩ বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করছি। এই দলটার আজকের এই অবস্থানে আসার পথে বেশ কিছু টার্নিং পয়েন্ট আছে।
সেই টার্নিং পয়েন্টগুলো নিয়েই আজকে আমি লিখতে বসেছি।
টার্নিং পয়েন্ট ১-অস্ট্রেলিয়ার সাথে আশরাফুলের সেঞ্চুরি
তখন আমার ইন্টার পরীক্ষা চলছিল। ফিজিক্স প্রথম পত্র পরীক্ষার আগে এক সাপ্তাহ বন্ধ পেয়েছি। এক সাপ্তাহ ধরে পড়ার কোনো মানে হয় না। পরীক্ষার দুইদিন আগে থেকে পড়লেই হবে।
আমি মোটামুটি ৫ দিন গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরলাম। কয়েকটা গল্পের বই পড়ে শেষ করলাম। বন্ধুদের সাথে নিয়তিমভাবে আড্ডা দিলাম। বাংলাদেশ তখন ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছে। টেস্টে মোটামুটি ভয়াবহ পারফরম্যান্স।
কতটা ভয়াবহ তা হাবিবুল বাশারের একটা কথা থেকেই বুঝা যায়। ইংল্যান্ডের পেসার স্টিভ হার্মিসন সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “হার্মিসন যখন বোলিং করে তখন মনে হয় দোতলা থেকে কেউ বল করছে”!!
দুই টেস্টে নাকানিচুবানি খাওয়ার পর ট্রাই নেশন সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতেও ইংল্যান্ডের কাছে ১০ উইকেটে হারে বাংলাদেশ। এরপর সেই বিখ্যাত ম্যাচ। ১৮ জুন কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি বাংলাদেশ। খেলা দুপুরে শুরু হয়।
আমি তখন শুধু ভেক্টর চাপ্টার পড়ে শেষ করেছি। তারপরও খেলা দেখতে বসে গেলাম। ২য় বলেই যখন গিলি আউট হল, তখন একটু নড়েচড়ে বসলাম। পন্টিংও একটু পরে প্যাভিলিয়নে চলে গেল। হেইডেন যখন আউট হয় তখন অসিদের স্কোর সম্ভবত ৩ উইকেটে ৫০।
মাশরাফির ওপেনিং স্পেলটা ছিল ভেরি ভেরি স্পেশাল, ৬-৪-৫-২ (১০০% শিওর না, তবে কাছাকাছি কিছু একটা হবে অবশ্যই)।
শেষ পর্যন্ত অসিরা টাইগারদের টার্গেট দেয় ২৫০ রান। সোফিয়া গার্ডেনে এর আগে যারা আগে ব্যাট করেছে তারা কেউ ম্যাচ জেতেনি। পন্টিং তারপরও টসে জিতে আগে ব্যাটিঙের সিদ্ধান্ত নেন। সে হয়ত ভাবতেও পারেনি কি অপেক্ষা করছে তার জন্য।
আমার টার্গেট রাত আটটা সাড়ে আটটা থেকে পড়া শুরু করব। ততক্ষণে টাইগারদের ইনিংসের ১০-১৫ ওভার শেষ হয়ে যাবে, আর ৪-৫টা উইকেট পরে গিয়ে ম্যাচটাও শেষ হয়ে যাবে। তাই আমি খুব একটা চিন্তিত নই পরাশুনা নিয়ে। ততক্ষণ পর্যন্ত খেলা দেখি।
তুষার ইমরান দারুণ একটা ৩০+ ইনিংস খেলেছিল ঐ ম্যাচে।
ঐটা ছিল অসিদের বিরুদ্ধে প্রথম একটা কাউন্টার এটাক। তারপর বাশার-আশরাফুলের সেই ম্যাচ উইনিং জুটি। একসময় টাইগারদের স্কোর ১০০/৩। আমার খুশি দেখে কে! আমি মামাকে বললাম আজকে যদি ২০০ করতে পারে তাইলে আমি ম্যাচ জিতছে বলে ধরে নিব। সেই বাংলাদেশই কিনা ২৫০ করে ফেলল!
পড়াশুনা সব বাদ দিয়ে আমি খেলা দেখতে থাকি।
মামাও এসে আমাদের সাথে খেলা দেখে। একেকটা চার হয়, আমরা দুই ভাই লাফালাফি শুরু করি, মামা লাফালাফি করতে পারেন না, ফ্লোরে বসে ফ্লোর থাবড়া দেন।
৫ উইকেট পরার পর যখন রফিক নামে আমি মনে মনে এটাই চাইছিলাম যে রফিককে যাতে বাউন্সার না দেয়। ওকে অফ স্ট্যাম্পের বাইরে যে কোনো বল দিলে ও চার ছক্কা মারতে পারবে, কিন্তু বাউসার দিলেই ওর দুর্বলতা ফাঁস হয়ে যাবে। প্রথম বলে গিলেস্পি অফ স্ট্যাম্পের বাইরে একটা লেন্থ বল দেয়, রফিক কাভার দিয়ে চার মেরে দেয়।
একটা দৃশ্যের কথা আমি কখনই ভুলব না। তখন সম্ভবত আর ৪-৫ ওভার খেলা বাকি। আতাহার আলি কমেন্ট্রি বক্সে বসে উশখুশ করছে। সে এখন কমেন্টেটর থেকে বাংলাদেশি সাপোর্টার হয়ে গেছে। ওকে কয়েকজন ইংলিশ কমেন্টেটর বাতাস করে ঠান্ডা করার চেষ্টা করছে!
লাস্ট ওভারের আগের ওভারে যখন ম্যাকগ্রাকে পয়েন্ট দিয়ে চার মারল রফিক, তখন আর মাত্র ৭ রান দরকার ৮ বলে।
পন্টিং কিছুক্ষণ ম্যাকগ্রার সাথে কথা বলে আবার নিজের পজিশনে দাঁড়াল। পরের বলে ম্যাকগ্রা দিল বাউন্সার। রফিক ব্যাটে লাগাতে পারল না। তারপরের বলে আবার একটা বাউন্সার। এবারো ব্যাটে লাগাতে পারল না।
অস্ট্রেলিয়া রফিকের দুর্বল জায়গা ধরে ফেলেছে।
শেষ ওভারে যখন আফতাব স্ট্রাইকে, আমি চাচ্ছিলাম যেন কোনোভাবেই রফিক আর স্ট্রাইক না পায়। ও স্ট্রাইকে গেলেই আবার বাউন্সার দিবে। মাত্র ছয় বলে সাত রান দরকার, তাও আমি শিওর ছিলাম না যে জিতে যাব। এই অস্ট্রেলিয়া বিশ্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া।
জিম্বাবুয়ের সাথে এক ম্যাচে শেষ ওভারে দরকার ছিল জিম্বাবুয়ের ১৫ রান। প্রথম তিন বলে ওরা নেয় ১০ রান। কিন্তু লাস্ট তিন বলে মাত্র ৩ রান দিয়ে এক রানে ম্যাচ জিতে যায় অসিরা। আমি কিভাবে এই অসিদের ব্যাপারে এত শিওর হই!
কিন্তু আফতাব যখন প্রথম বলেই গিলেস্পিকে ছক্কা মারল, তখনই সব শিওর হয়ে যাই। আর হারানো সম্ভব না আমাদের।
আর সম্ভব না!
পড়াশুনা সব লাটে উঠল। পরেরদিন দোকানে গেলাম পেপার কিনতে। গিয়ে দেখি প্রথম আলো শেষ। আমি দুইটা পেপার কিনে বাসায় আসলাম। খেলার সব নিউজ পড়ে শেষ করলাম।
একটু পরে আসল এক বন্ধু। তার সাথে আড্ডা চলল দুপুর পর্যন্ত। মনে আমার ফুর্তি। আমার যে মাত্র দেড় চ্যাপ্টার ততক্ষণে শেষ হয়েছে সেটা নিয়ে আমার মাঝে কোনো চিন্তা কাজ করছে না। আরে আজকে তো এখনো বিকাল সন্ধ্যা বাকি আছেই, কালকে সারাদিন বাকি, পরশু দুপুরে পরীক্ষা; এখনো ম্যালা টাইম বাকি-এই বুঝালাম নিজেকে।
এই বুঝানোর ফলাফল হচ্ছে পরীক্ষার ১ মিনিট আগেও আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে রিভিশন দিচ্ছি। আমার তখনো এক চ্যাপ্টার রিভাইস করা বাকি!
এই জয়টা এদেশের ক্রিকেটকে ভীষণভাবে বদলে দিয়েছে। আগে আমার মত এতো আশাবাদী সাপোর্টারও “বাংলাদেশ আজকে জিতে যাবে”-এই আশা নিয়ে খেলা দেখতে বসতাম না। এই ম্যাচের পর অন্তত এই বিশ্বাসটা এসেছে যে, যদি আশরাফুল ভাল খেলে, তাহলে আমরা জিতে যাব। ম্যাচের আগেই ম্যাচটা আর হেরে বসে থাকি না!
(চলবে)
©Muhit Alam
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।