কোকিলের কুহুকুহু শোনেনি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া ভার। বিশেষ করে বসন্ত এলে ব্যস্তনগরী ঢাকার দালান-কোঠার ফাঁকে ফাঁকে দু’একটি গাছপালা যেখানে চোখে পড়ে সেখান থেকেও মাঝে মাঝে এ পাখির মন মাতানো কলতান শোনা যায়। শহরের যন্ত্রদানবগুলোর অবিরাম শব্দের মাঝে কোকিলের এই মনভোলানো ডাক নিমিষেই মনে এনে দেয় কোনো এক স্বর্গীয় অনুভূতি। শহর ছেড়ে দূর বহুদূরে গ্রাম বাংলার সবুজে ঘেরা ওই ছায়াময় পরিবেশে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। যেখানে পাখিদের এ মোহনীয় শব্দে সন্ধ্যা নামে আবার ভোর হয়।
বিজ্ঞানীদের রুক্ষ-সূক্ষ্ম মনে সতেজতা এনে দিতে পাখিদের এ কলতান দারুণ কার্যকর। সম্ভবত এ কারণেই প্রাণিবিজ্ঞানীরা এসব পাখির নাম রেখেছেন ‘সংবার্ড’ বা গায়কা পাখি। আমাদের দেশে কোকিল ছাড়াও চড়ুই, টিয়া, ময়না, ঘুঘু ইত্যাদি গায়ক পাখির অন্তর্ভুক্ত। ইংল্যান্ডে আছে সুইফট সোয়ালো। এ পাখির সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন জগত্ বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিকরা।
এদের নিয়ে গবেষণাও হয়েছে প্রচুর। সর্বশেষ গবেষণা হয়েছে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ড. জশ ভন বাসকির্কের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানীর গবেষণায় গায়ক পাখিদের সম্পর্কে বেরিয়ে এসেছে নতুন তথ্য। বিজ্ঞানীরা তাদের এ গবেষণায় বলেছেন, জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে গায়ক পাখিদের দৈহিক আকার ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। তারা এ গবেষণার জন্য বিশ্বের ১০০টিরও বেশি প্রজাতির ৫ লাখ পাখিকে বেছে নিয়েছিলেন।
তারা বলেছেন, এসব পাখির বেশিরভাগই ক্রমেই ওজনে হালকা ও ডানা ছোট হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থার শুরু পঞ্চাশ দশক আগে। গরম আবহাওয়ায় বাস করা পাখিদের ক্ষেত্রেই ওই পরিবর্তন বেশি দেখা গেছে। যদিও জলবায়ু পরিবর্তনে পাখিদের ক্ষতি হয়েছে সামান্যই।
পাখিদের ওপর জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষণা কর্মটি প্রকাশ করেছে ‘ওইকোস’ জার্নাল।
ড. ভন বাসকির্ক ছাড়াও এ গবেষণায় আরও দুই বিজ্ঞানী যুক্ত ছিলেন। তারা হলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার কানিজ মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি ইন রেক্টরের রবার্ট মালভিহিল ও রবার্ট লিবারম্যান। তারা কানিজ মিউজিয়ামের পাউডার মিল রিংগিং স্টেশনে বসে ওই গবেষণা চালিয়েছিলেন। গবেষণার জন্য মোট ৪ লাখ ৮৬ হাজার বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ধরা হয়। ১৯৬১ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০ বছর সময় লাগে এ কাজে।
এসব পাখি ছিল ১০২টি প্রজাতির। যেগুলো বিভিন্ন ঋতুতে পেনসিলভানিয়ায় যেত। পরে এগুলোর যাবতীয় তথ্য যেমন—ওজন, ডানা ও পালকের দৈর্ঘ্যের মাপ ইত্যাদি সংরক্ষণ করা হতো। তবে এদের এক সময় ধরা হতো না। বিভিন্ন ঋতুতে কি ধরনের দৈহিক পরিবর্তন ঘটে তা বোঝার জন্য ওইসব ঋতুতেই এদের ধরা হতো।
বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ ৪৬ বছরের গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন, বসন্তকালে পেনসিলভানিয়া ভ্রমণে যাওয়া ৮৩ প্রজাতির পাখির মধ্যে ৪৬টিরই ওজন নিয়মিত কমে আসছে এবং ডানা ছোট হয়ে যাচ্ছে। এদিকে শরত্কালে ভ্রমণে যাওয়া ৬৬টি প্রজাতিও আকারে ছোট হচ্ছে। একই ঘটনা বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন, গ্রীষ্মকালে ভ্রমণে যাওয়া ৬৫টি প্রজননক্ষম প্রজাতির মধ্যে। এসবের ৫১টিরই আকার কমে যাচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন, পাখিদের আকার পরিবর্তনের তারতম্য খুব বেশি নয়।
ড. বাসকির্ক বলেন, বসন্তকালে ভ্রমণে যাওয়া পাখিদের আকার পরিবর্তনের হার মাত্র ১.৩ ভাগ। যেমন—ওয়েবলার পাখির কথা বলা যায়। ১০ গ্রাম ওজনের বসন্তকালীন এরকম একটি গায়ক পাখির ওজন গত ৪৬ বছরে কমেছে মাত্র ১৩০ মিলিগ্রাম। তবে কিছু কিছু পাখির ক্ষেত্রে ওই সময় ওজন খুব বেশি কমে যেতে দেখা গেছে। যেমন—রোজ-ব্রিস্টেড গ্রোসবিক।
এর ওজন কমার হার ৪ ভাগ। একই সময় কেনেটকি ওয়েবলারের ওজন কমেছে ৩.৩ ভাগ। স্কারলেট ট্যানেজারের কমেছে ২.৩ ভাগ। আকার পরিবর্তনের এ লক্ষণ শীতকালে ছিল উল্লেখ করার মতো। ক্যারাবিয়ান, মধ্য আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার পাখিদের মাঝে লক্ষণ দেখা গেছে।
যদিও বিজ্ঞানী বাসকির্কের মতে, আকার পরিবর্তনের লক্ষণ বেশি দেখা গেছে উত্তর আমেরিকার পাখিদের মাঝে। বিশেষ করে গায়ক পাখিদের ক্ষেত্রে। তবে আশার কথা হলো, আকারের দিক এসবের সামান্য পরিবর্তন যা লক্ষ্য করা গেছে অন্যদের ক্ষেত্রে চেহারার সৌন্দর্যে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। তাছাড়া সংখ্যাগত দিক দিয়েও কোনো রূপ পরিবর্তন দেখা যায়নি।
অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে এসব পাখি অভিযোজন ক্ষমতাও অর্জন করছে।
এর ফলে একই দলভুক্ত পাখিদের ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে বসবাসের কারণে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে গঠনগত পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এর আগে ড. বাসকির্ক অন্য এক গবেষণায় বলেছেন, অভিযোজনের কারণে পাখিদের কেউ কেউ লাভবান হবে। আবার কারও কারও হবে ক্ষতি।
এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে পাখিদের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা অনেক দিন ধরে ঝুলে থাকা আরেকটি সমস্যারও সমাধান খুঁজে পেয়েছেন। তা হলো, বার্গম্যান’স তত্ত্বের একটি অজানা দিক।
এতে গরম আবহাওয়ার সঙ্গে কিছু কিছু প্রজাতির প্রাণীর ছোট হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এতদিন এ বিষয়টি অনেকের কাছেই রহস্যজনক ছিল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।