বুদ্ধদেব গুহের "মাধুকরি" উপন্যাসের পৃথু ঘোষ আমি
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সমসাময়িককালে যেন খুব বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশে তো বটেই উন্নত দেশগুলোও ধুঁকছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে। অপেক্ষাকৃত গরিব দেশগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের আঁচ লাগছে বেশি মাত্রায়। তাই জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত অভিযোজনের পাশাপাশি এর প্রভাব প্রশমন করা বা কমিয়ে আনার দিকে মনোযোগী হওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক অভিযোজনে বেশি দুর্ভোগ পোহায় আমাদের দেশের নারী ও শিশুরা।
বাংলাদেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলার ৮৭টি উপজেলার মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল সরাসরি ভোগ করে। প্রতিনিয়তই তারা ঝড়-ঝঞ্ঝার সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০০৩ সালের হিসেব মতে, উপকূলীয় জেলাগুলোতে জনসংখ্যা ৩ কোটি ৫০ লাখ ৮০ হাজার। এর মধ্যে নারী এক কোটি ৭০ লাখ ১০ হাজার এবং পুরুষ এক কোটি ৭০ লাখ ৯০ হাজার। গত এক দশকেই উপকূলীয় এলাকার জনসংখ্যা বেড়েছে ৮০ লাখের ওপর।
আর এদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। জলবায়ু পরিবর্তনের নানা প্রভাবে ভুগছে তারা। কষ্ট বেড়েছে তাদের।
পৃথিবীব্যাপী ঘটে যাওয়া পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বৈশ্বিক উষ্ণতাকেই দায়ী করেছেন। মানবজাতির নানাবিধ কর্মকাণ্ডের ফলে নিঃসরিত গ্রিন হাউজ গ্যাসের সাথে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে।
গ্রিন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণ ভূ-মণ্ডলীয় জলবায়ুর পরিবর্তনকে প্রভাবিত করছে। জলবায়ুর পরিবর্তন পৃথিবীর উন্নত-উন্নয়নশীল-অনুন্নতণ্ড সব দেশেই সমানভাবে আঘাত হানছে, হানবে। তবে আর্থিক ও কারিগরি সমতার অভাবে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলোকে সামলাতে হবে বড় ঝক্কি-ঝামেলা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনাবৃষ্টি-অতিবৃষ্টি দেখা দেবে। তাপমাত্রার তারতম্য হবে, বন্যা, বেশি বেশি সাইক্লোন-ঘূর্ণিঝড়ের ঘটনা ঘটবে।
গত দু বছরে বাংলাদেশের মানুষ এসব ঘটনা খুব বেশি করে প্রত্যক্ষ করেছে। শীতকালে বৃষ্টি এখন অসাধারণ কোনো ঘটনা নয়। ঋতুবৈচিত্র্য অনেকাংশেই ম্লান। বর্ষাকালে বৃষ্টির পরিবর্তে কাঠফাটা রোদ আর তীব্র গরম সাধারণ চিত্র। এবার বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গত ১২ বছরের চেয়ে বেশি তাপমাত্রা অনুভূত হয়েছে।
হিটস্ট্রোকে মারা গেছে অন্তত ৭-৮ জন মানুষ। চট্টগ্রামে স্বাভাবিকের চেয়ে আড়াই-তিন ডিগ্রি বেশি তাপমাত্রা বিরাজ করেছে বেশকিছু দিন। আবহাওয়ার এমন বিরূপ অবস্থা নারী ও শিশুদের যতটা না ভোগান্তিতে ফেলে তার চেয়েও অনেক গুণ বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয় বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসে। নদীভাঙন বা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিও পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে অনেক ক্ষেত্রেই নারীদের অসহায় করে তোলে। গত দু বছরে দেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তিনটি বন্যা, চারটি ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়।
এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে বহু মানুষ হতাহত হয়েছে। ঘরবাড়ি হারা হয়েছে লাখো মানুষ। খাদ্য নিরাপত্তা হয়েছে বিঘ্নিত।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘরহারা নিরন্ন মানুষের করুণ চিত্র উপকূলীয় জেলাগুলোতে হরহামেশা দেখা যায়। ঘন ঘন সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় আবাদী ফসল নষ্ট হয়।
সুপেয় খাবার পানির অভাব দেখা দেয়। এসব ঘটনা দুর্ভোগ বাড়ায় নারীদের। পরিবারের সদস্যদের খাবার এবং সুপেয় পানির ব্যবস্থা করার দায়িত্ব পড়ে অসহায় নারীটির ঘাড়ে। এ সময় সংসারের প্রাত্যহিক কাজকর্মের বাইরে ঘরদোর মেরামতসহ সংশ্লিষ্ট নানা কাজে বাড়তি পরিশ্রম করে নারীরা। এ বছর নীলফামারীর ডিমলায় পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, যেসব নারী কাজের বিনিময়ে টাকাপয়সা রোজগার করতেন অর্থাৎ যারা নারীশ্রমিক, দুর্যোগের পর সাধারণত তাদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়।
এ সময় নারীরা ত্রাণ সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শতকরা ৮৪ দশমিক ৮২ ভাগ নারী বিশুদ্ধ পানির খোঁজে ছোটেন। খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রেও নারীরা বৈষম্যের শিকার হয়। যেন প্রথাগতভাবেই এখানকার নারীরা তার স্বামীর খাবার গ্রহণের পর নিজে খাবার খায়। এ বছর পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘বর্ণালী’ পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, শতকরা ৯৮ দশমিক ৩ ভাগ মহিলা তার স্বামী খাবার খাওয়ার পর নিজে খায়।
শতকরা ৩৮ দশমিক ৯১ ভাগ নারী কোনো খাবারই খেতে পায় না। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় অপ্রতুল চিকিৎসাসেবার কারণেও দুর্ভোগ বাড়ে নারী ও শিশুদের। খরার সময় পানির অভাবে নারীরা নিজের স্বাস্থ্যগত দিকের সঠিক যত্ন নিতে পারেন না। বিশেষ করে রজঃচক্র চলার সময় তারা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে পারেন না। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া নারীরা অনেক সময়ই আলাদা ব্যবস্থা না থাকার কারণে প্রস্রাব-পায়খানা করতে গিয়েও বৈষম্যের শিকার হন।
তাই লজ্জাবশত প্রস্রাব চেপে রাখার ঘটনায় তাদের অনেকে মূত্রনালীর প্রদাহে ভোগেন। এতে তাদের কষ্ট বাড়ে। মানুষ অনুপাতে আশ্রয়কেন্দ্র বেশি দরকার এমন এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র কম। আবার অনেক আশ্রয়কেন্দ্রই ঝুঁকিপূর্ণ। দেশের ২ হাজার ৯৪১টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে বেশিরভাগই নানা ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে।
এছাড়া উপকূলীয় এলাকার প্রায় চার কোটি মানুষের বিপরীতে আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে মাত্র ২৮ লাখের জন্য। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে গাদাগাদি করে থাকতে গিয়েও নানা ধরনের বৈষম্য এবং হয়রানির শিকার হন নারীরা।
আশ্রয়কেন্দ্রে যৌন হয়রানির বিষয়টি অতি সাধারণ একটি ঘটনা। অনেক নারী এসব ঘটনা চেপে যান। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।
এ বছর পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, আশ্রয়কেন্দ্রে শতকরা ১৯ দশমিক ৩৫ ভাগ নারী যৌন হয়রানির শিকার হন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মেয়ে শিশুরা পড়াশোনার সুযোগ থেকে বেশি মাত্রায় বঞ্চিত হয়। এ সময় তাদেরকে পরিবারের কাজে বেশি সময় দিতে হয়, যেতে হয় ত্রাণ সংগ্রহে, যোগাড় করতে হয় খাবার পানি।
গত ২০০ বছরে এ অঞ্চলে প্রায় ৭০টি ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয়েছে। বন্যা তো নদীমাতৃক বাংলাদেশের ফি বছরকার চিত্র।
এ দীর্ঘ সময়ে কত নারী প্রাণ হারিয়েছে, কতজন আহত হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগে কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রে কত নারী হয়েছে যৌন হয়রানির শিকার সে হিসেবে কষা আসলেই কঠিন। এ ব্যাপারে সমাজকর্মী জেসমিন সুলতানা পারু বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল এবং থাকবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয় নারী ও শিশুরা। তাদের কথা মাথায় রেখে নিরাপদ স্থানে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিয়ে সরকারি খাস জমিতে পুনর্বাসনের মাধ্যমে তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
নভেম্বর-২০০৭ থেকে মে-২০০৯, মাত্র দেড় বছরের ব্যবধানে ঘূর্ণিঝড় সিডর, নার্গিস, বিজলী এবং আইলা হানা দিয়েছে বাংলাদেশের উপকূলে। সরকারি হিসেবে সিডরে মারা গেছে ৩ হাজার ৪৪৭ জন। বেসরকারি হিসেবে তা ১০ হাজারেরও বেশি। ১৯৭০ কিংবা ১৯৯১ সালের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়ের কথা বাদই দেওয়া যাক। সাম্প্রতিক আইলায় মারা গেছে দু শয়ের মতো মানুষ।
আইলায় ১৪টি উপকূলীয় জেলার ৬২টি উপজেলার প্রায় ৩০ লাখ মানুষ পানিবন্দী ছিল বেশ কয়েকদিন। আইলার আঘাতে ৬৮ হাজার ৩৮৫ একর জমির ফসল পুরোপুরি এবং ২ লাখ ৩৯ হাজার ২১২ একর জমির ফসল আংশিক নষ্ট হয়। ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮২৩টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি ২৫৮ দশমিক ৫ কিলোমিটার রাস্তা ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৫১৯টি বেড়িবাঁধ। ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে পরিবেশ বিপর্যয় তথা জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস-এর পরিচালক ড. মোহাম্মদ আল-আমীন দৈনিক আজাদীকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকার মানুষ আর্থ-সামাজিক নানা সমস্যায় ভুগছে। নানা অপ্রতুলতায় সেসব এলাকায় বসবাসরত মানুষজন বিশেষ করে নারী ও শিশুরা পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে বা অভিযোজন ঘটাতে পারছে না। তিনি বলেন, বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে ‘জলবায়ু-উদ্বাস্তু’র সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। এতে করে আর্থ-সামাজিক নানা অসঙ্গতি দেখা দেবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবো।
কিন্তু সে অর্থে প্রস্তুতি নেই আমাদের।
ইন্টার গভর্নমেন্ট প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)-এর তথ্য মতে, গত শতাব্দীতে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়েছে শূন্য দশমিক ৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় ইতোমধ্যে মেরু অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করেছে। তাই সমুদ্রের পানিও বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া দেশগুলোর মধ্যে ভৌগোলিক অবস্থান, ঘনবসতি, দারিদ্র্য এবং জীবিকার জন্য প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীলতা প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম সারিতে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশে গড় বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। ভয়াবহ বন্যার পুনরাবৃত্তিসহ বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বেড়েছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খরা, লবণাক্ততা ও ফসলচক্রের পরিবর্তনসহ নানা বিরূপ এবং প্রতিকূল পরিসি'তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। লোনা পানি ও মাটির পরিমাণ বাড়ার ফলে জমি ফসল উৎপাদনে অযোগ্য হয়ে পড়লে খাদ্য নিরপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে, যার ফল হবে সুদূরপ্রসারী। এ ব্যাপারে বর্ণালী’র গবেষণা কর্মকর্তা মুহম্মদ আবদুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কৃষি ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়ছে।
লোনা পানির পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল নষ্ট হচ্ছে, উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে উপকূলীয় এলাকার মানুষজনের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। তিনি বলেন, খাবারের অভাবে বেশি কষ্ট করে নারী ও শিশুরা। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে ভবিষ্যত প্রজন্ম দুর্বল মেধার হয়ে বেড়ে উঠবে।
গবেষকদের মতে, ২০২৮ সালের মধ্যে দেশে বর্তমান সময়ের তুলনায় শতকরা ১৪ ভাগ বৃষ্টিপাত বাড়বে।
তার মানে আরো বেশি জল, আরো বেশি বন্যা, আরো বেশি দুর্ভোগ! সমুদ্র পৃষ্ঠের পানি বাড়ার ফলে জমির লবণাক্ততা বাড়বে, বিপরীতে কমবে ফসল উৎপাদন। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে সরকার বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান (বিসিসিএসএপি) প্রণয়ন করেছে। বিসিসিএসএপি-তে ৬টি বিষয়ের আওতায় প্রায় ৪০টি কার্যক্রম চিহ্নিত করা হয়েছে। ভবিষ্যত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজন কার্যক্রম চালাতে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে ‘জলবায়ু পরিবর্তন তহবিল’ নামে ৩শ কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করেছে। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত যে বিশাল অভিযোজনমূলক কার্যক্রম গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে তার তুলনায় আমাদের নিজস্ব বরাদ্দ অথবা আন্তর্জাতিক অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনা নিতান্তই অপ্রতুল।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ আন্দোলন, চট্টগ্রাম-এর আহ্বায়ক শাহরিয়ার খালেদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মূলত উন্নত দেশগুলো দায়ী। সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেসব নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সে বিষয়েও তাদের দায়িত্ব রয়েছে। উপকূলীয় এলাকার বাস্তুহারা মানুষগুলোকে উন্নত দেশগুলোতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা উচিত। এ জন্য আন্তর্জাতিক ফোরামে দাবি তুলতে হবে। তিনি বলেন, উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ মানুষই নিম্নবিত্ত, দিনমজুর কিংবা জেলে সম্প্রদায়ের লোক।
সেসব এলাকায় বসবাসরত মানুষ তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের সুযোগ পায় না।
পরিবেশবাদী সাংবাদিক ভূঁইয়া নজরুল বলেন, উপকূলীয় এলাকার মানুষেরা অভিযোজন করতে গিয়ে পেশার পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। ফলে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থারও পরিবর্তন ঘটছে। দুর্ভোগ বাড়ছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, লবণাক্ততার কারণে সাতক্ষীরায় এখন কৃষিকাজ নেই বললেই চলে।
সেখানকার মানুষ এখন চিংড়ি ঘেরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এক সময় এটাও পরিবর্তন করতে হবে। সরজমিনে বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জেলেপল্লীর নারী-শিশুরা মানবেতরভাবে জীবনযাপন করছে। কুতুবদিয়ার পূর্ব আলী আকবর ডেইলের বাসিন্দা গৃহবধূ হেমা রাণী দাশ বলেন, ভাঙনে বসতভিটা বিলীন হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে বেড়িবাঁধের ওপর ডেরা বানিয়ে বাচ্চাকাচ্চাসহ আশ্রয় নিতে হয়েছে।
বেড়িবাঁধে তার মতো আরও ২০-২২টি পরিবারের সন্ধান মিললো। পটুয়াখালীর কলাপাড়া, বেতাগীসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে আসা সাংবাদিক আজাদ তালুকদার এ প্রসঙ্গে বলেন, তাদের জীবনযাত্রা নিম্নমানের। তারা একটু সোজা হয়ে দাঁড়ানোর আগেই আবার কোনো না কোনো দুর্যোগ এসে সব কেড়ে নেয়। উপকূলীয় এলাকায় নারীদের নানান সমস্যা প্রসঙ্গে নারীনেত্রী নূরজাহান খান বলেন, ওদের পাশে সহানুভূতির মনোভাব নিয়ে দাঁড়াতে হবে। শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
এ ব্যাপারে মিডিয়াকে আরও সোচ্চার হতে হবে।
কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, ১৯৬০ সালে যেখানে কুতুবদিয়ার আয়তন ছিল ৬০ বর্গকিলোমিটার, অব্যাহত ভাঙনের মুখে এখন তা নেমে এসেছে মাত্র ২৫ বর্গকিলোমিটারে। এমন অবস্থা দেশের অনেক উপকূলীয় এলাকারই। এর ফলে মানুষের অসহায়ত্ব অনেক বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাফর জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে।
এর ফলে ভাঙন বাড়ায় বাস্তুহারা হচ্ছে অনেকে । লবণাক্ততা সহ্য করে টিকে থাকতে না পেরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন তার প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা হারাচ্ছে। প্রকৃতির বর্ম-খ্যাত ৫ হাজার বছরের পুরোনো প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবন থাকায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ নানা প্রাকৃতিক উপদ্রব থেকে রক্ষা পেয়েছে। সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় আইলায়ও সুন্দরবন সেই প্রমাণ দিয়েছে। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) জানায়, আইলার সময় সুন্দরবন জলোচ্ছ্বাসের গতি ৩০ এবং উচ্চতা ১০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছিল।
তাই জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব থেকে বাঁচতে বেশি বেশি বনায়নের পক্ষে বিশেষজ্ঞরা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।