নুতন পুরাতন সব লেখাতেই আপনার মন্তব্য প্রত্যাশিত।
দীর্ঘ বিরতির পর ফেরা, সংক্ষেপে তাই একটু রিভিউ করে নেই। পোস্টের পটভূমি রয়েছে প্রথম পর্বে। বিষয়বস্তু পোস্টের শিরোনামে এসেছে। আর এই ধারাবাহিক পোস্টগুলির উদ্দেশ্য প্রচলিত অভিযোগকে আমলে নিয়ে একে একে উত্তর খুঁজে ফেরা, হুট করে কোন চটজলদি চিন্তায় না আটকানো।
প্রথম পর্বে মূলতঃ শিক্ষক আর শিক্ষার মানকে আকাশ ছোঁয়া আবেগি মাপকাঠিতে নয় বরং বিমূর্তহীন ভাবে আমাদের দৈনন্দিন ধরা ছোঁয়ার মাঝে নিয়ে এসে বোঝার চেষ্টা করেছি। দ্বিতীয় পর্বে একজিস্টিং অবকাঠামো ও ল্যাবরেটরী গুলির হাল হকিকত মানে সেগুলি দিয়ে গ্রাজুয়েট তৈরী করা যায় কিনা আর গেলেও সেই গ্রাজুয়েটের কতিপয়ের ভেতর ভবিষ্যৎ গবেষকের ন্যাক টা গড়ে উঠছে কিনা সেটা মূল পোস্টে ও সংশ্লিষ্ট কমেন্টের মধ্যে একধিকবার আলোচনায় এসেছে। সেখানে আমি আশাবাদী। এরসাথে গবেষনা মাত্রই সর্বদা এলাহী যন্ত্রপাতির সমারোহ , এই ধরনের অতি প্রান্তিক চিন্তা থেকে পাঠক কে বের হয়ে আসার সিগন্যাল দেবার চেষ্টা করেছি গত পর্বে। তবে কিঞ্চিত রং-সিগন্যাল পাঠকের মধ্যে অনিচ্ছাসত্ত্বেও চলে গেছে, কতিপয় মন্ত্বব্যে যার বহিঃপ্রকাশ ।
পাঠক আশা করি আগের দুটি পর্বে একটু সতর্ক চোখ রাখবেন,পরিপ্রেক্ষিতটা বোঝা সহজ হবে।
এবার পরের ধাপে এগোই। সিলেবাস, অবকাঠামো আর ল্যাবরেটরীর পর যে মূল উপাদানটা নিয়ে আলোচনার বাকি থেকে গেছে সেটা হচ্ছে শিক্ষক। আজকে এই উপাদানটা একটু ফিরে দেখবো। ভাল শিক্ষক কে? শিক্ষকের মাপকাঠি তো ওভাবে বেঁধে দেয়া যায়না।
এটা অনেকটা আদর্শিক অবস্থান। উপলব্ধির জায়গা। তবে কাগজে কলমে বা অফিশিয়ালি মাপতে গেলে ডিগ্রী, প্যাটেন্ট, পাবলিকেশন, অভিজ্ঞতা এগুলিই মাপকাঠি। সেই প্রচলিত মাপকাঠিতে দেশের অবস্থাটা একটু ফিরে দেখি। দেখা গেছে বেশ সিনিয়র শিক্ষকদের মধ্যে যারা অনেক পূর্বে ডক্টরেট করেছেন তাদের একটা বৃহৎ অংশ ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন ভারত থেকে।
এর সাথে আছে রাশিয়া, ব্রিটেন, ব্যাংকক(এ,আই,টি), উত্তর-আমেরিকা। আবার অনেকে হায়ার ডিগ্রী সম্পন্ন না করে চাকুরীর অভিজ্ঞতার বলে একসময় প্রফেসর হয়েছেন, ইনারা অবশ্য অনেকেই রিটায়ার করেছেন বা কর্মজীবনের শেষের দিকে রয়েছেন। এর কিছু পরে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমা ডিগ্রির সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে, সঙ্গে উল্লেখযোগ্য পরিমান জাপানি ডিগ্রীও । কারণ ইন্টারনেট আর ইমেইলের প্রভাব পড়ছে। যোগাযোগ সহজ হচ্ছে।
বিদেশী প্রফেসরের দোরগোড়ায় সরাসরি নক করা সম্ভব হয়েছে দেশে বসে। আর বর্তমান বা নিকট অতীতে যারা ডিগ্রী করেছেন বা করছেন সেখানে আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান আর অস্ট্রেলিয়ার প্রকোপটা চোখে পড়ার মত। এই হোল একটা এভারেজ চিত্র, নিঃখুত পরিসংখ্যানের প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। এগুলি উল্লেখ করার কারণ এই নয় যে আমরা এখন বসে পড়বো কোন দেশের ডিগ্রী কত বড় আর কোন দেশেরটা গোনার মধ্যে পড়েনা এই হিসাব করতে। বরং উদ্দেশ্য হচ্ছে এটা বলা যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে দেশ-বিদেশ থেকে ফেরা, উন্নত ল্যাবে রিসার্চ করা, আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা ব্যবস্থা ও সমাজব্যাবস্থার সাথে পরিচিত ব্যাক্তিদের আগমন ঘটেছে বা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ঘটছে হাইব্রিডাইজেশন। এটা আশার কথা, খুব ভাল একটা দিক।
তবে হতাশারও কিছু কথা আছে। বড় একটা ডিগ্রী অর্জন করার পর তিনি শিক্ষক হিসাবে সুযোগ্য হয়েছেন কিংবা এই অবক্ষয়ের যুগে সকলেই দেশে ফিরে নিজ নিজ মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহারে আত্মোনিয়োগ করেছেন এরকমটা সবসময় দেখা যায়নি। দেখা গেছে কেউ উচ্চশিক্ষা শেষে ফিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছকমিটি, মাছ কমিটি, টেন্ডার কমিটি, বাসা বরাদ্দ কমিটি, বিউটিফিকেশন কমিটি ইত্যাদি সব নানান কিসিমের নন-একাডেমিক কর্মকান্ডে বাকি জীবনটা আনন্দে কাটিয়ে দিচ্ছেন।
কারো কারো মৌমাছি চাষে বুৎপত্তি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে মৌমাছি দেখেই বলে দিতে পারেন কোন মৌমাছিটা বেয়াদব আর কোনটা আদবকায়দা জানে, মানে পোষ মানবে। কেউ কেউ আবার এই দুনিয়ায় বসবাস করেননা, দুই দুনিয়ার মাঝে সেতু বাঁধার কাজে মশগুল। সময় অল্প। এই দুনিয়া তো কিছুনা। মায়া আর মায়া।
তাই এই দুনিয়ায় মশগুলদের কিভাবে দুনিয়ার কাজে উদাসীণ করা যায় সেই মহান কর্মের কৌশল নির্ধারণে তাঁদের দিন এগোয়। তবে কিভাবে তাঁরা এরই ফাঁকে উত্তরা-পূর্বাচলের প্লটের আবেদনটা সময় মত করে ফেলেন অনেকের মত আমার কাছেও সে এক অধরা রহস্য। ক্লাসে আসেন দুই যুগের পুরোনো হলুদ হয়ে যাওয়া চোথা নিয়ে। ব্লাকবোর্ডে ৫০-৫৫ মিনিট হুবহু তুলে দিয়ে জীবিকা হালাল করেন। আরেকটা শ্রেণী আছে যারা রাজনৈতিক দলের কাছে বিক্রী হয়ে যান।
বিশেষ বিশেষ দিবসে মুখটা তাঁদের ভাবগম্ভীর হয়ে উঠে। নজরানা হিসাবে একসময়ে ভিসি, প্রোভিসি, রেজিস্ট্রার, প্রক্টর, ছাত্রকল্যান উপদেষ্টা হবার সৌভাগ্য জোটে। তবে এ লাইনেও আজকাল প্রতিযোগিতা অনেক, থাক সে কথা।
মনে রাখতে হবে জীবনযাত্রা জটিল হয়েছে, চারিদিকে শুধু অবৈধ পুঁজির প্রতাপ। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান এখন নৈতিকতা আর প্রতীকি দেশপ্রেমের বিপনণে মত্ত।
এখন এরা একটা প্রজন্মের কেবলা । তরুন সমাজের মুখ-মন-মগজ সবই সেই কেবলামুখি। ঠান্ডা মাথায় কিছু ভেবে দেখার সময় তার নাই। আত্মসুখ আর আত্মচিন্তায় সে মগ্ন। যে ভেবে দেখে সে তো বোকা, ফাস্ট লাইফ লিড করতে শেখেনি।
একটা প্রজন্ম তো ইতোমধ্যেই তৈরী হয়েছে যারা দেশ বলতে ঢাকা শহরের কিছু চৌহদ্দিকেই বুঝে। ঢাকার বাইরে যারা, তারা তার কাছে অচ্ছুৎ, যথেষ্ট স্মার্ট না। এই অবক্ষয় আর বিভক্তি সমাজের সব লেভেলকে স্পর্শ করবে। বিশাল পুঁজির সুচিন্তিত ও লক্ষ্যভেদী কারবার। শিক্ষক, সন্যাসী, পীর,ফকির, ব্রহ্মচারী কেউ তার নাগালের বাইরে থাকবেনা।
বিশ্ববিদ্যালয় তো এ সমাজের বাইরে নয়। আর বাইরে নয় বলেই সেখানেও তার দেখা মেলে।
উপরে যেটা বললাম সেটা একটা দিক। আরেকটা দিক বা আশার কথা হল এত কিছুর পরেও আত্মনিবেদিত, প্রচারবিমুখ, স্বমহিমায় উজ্জ্বল ব্যাক্তিদের সংখ্যা কিন্তু নেহাত কম না। মোটেই কম না।
তবে তাঁদের পরিচয়ের গন্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমা ছাড়িয়ে পত্রিকার পাতায় উঠে আসেনা। সম্ভাব্য কারন, উনাদের কাজের কোন রাজনৈতিক বা মিডিয়া ভ্যালু নাই অথবা মিডিয়ায় উঠে আসতে হলে যে পরিমান বেহায়া হতে হয় ,নীচে নামতে হয় সেটা তারা পারেননা। নিভৃতে থেকে কাজ করেন। নজরুল ইসলাম কে স্মরণ করে বলতে হয় ইনারা আছেন ফুলের মাঝে মাটির মমতা রসের মত অলক্ষ্যে, যে চাঁদ সাগরে জোয়ার জাগায় সে তার শক্তি সম্বন্ধে আজো না ওয়াকিফ। আর তাঁদের হাত ধরেই অনেক প্রতিকূলতার পর প্রতিবছর উঠে আসছে অসংখ্য সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুনী।
প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা বলে রাখি। দেশের আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেলে শেষ বর্ষে ছাত্রদের একটা থিসিস করতে হয়। গতানুগতিক কপিপেস্ট মার্কা অনেক কাজের মাঝেও মৌলিক বেশ কিছু কাজ এই আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেলেও হয়ে থাকে। তবে যে থিসিসগুলি তারা করে থাকে সেগুলি যথাযথ সংরক্ষন, রিভিউ ,সঠিক ফোরামে উপস্থাপন বা পরবর্তিতে সেই কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষার ব্যাবস্থা না থাকায় অনেক মূল্যবান কাজ কিন্তু আমারা হারিয়ে ফেলেছি এবং ফেলছি।
শিক্ষক প্রসঙ্গে কথা শেষ করার আগে একটা উক্তি স্মরণে নেই।
“What does your teacher teach? He teaches nothing, only points the way.” অনুবাদ করলে এরকম দাঁড়ায়- “শিক্ষক তোমায় কি শেখান? মোটেই কিছুনা। কেবল কিভাবে শিখতে হয় সেটাই দিকনির্দেশ করেন। ” উচ্চশিক্ষার প্রকৃতিটা এরকমই হওয়া উচিত। তাই এই দূর্যোগের দিনে সঠিক দিকের নির্দেশণাটুকুও যিনি দেন তিনিও তাঁর দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন বলেই আমরা ধরে নেব।
এবার থামি, তা না হলে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে।
এই তিনপর্বে মূলতঃ রিসার্চ পূর্ব ম্যানপাওয়ার তৈরীর পরিবেশ আর তার নিয়ামকগুলি নেড়েচেড়ে দেখার চেষ্টা করলাম। পরের পর্বে একটা ছোট্ট সামারি টেনে রিসার্চ প্রসঙ্গে কথা শুরু করব। আশা করি সঙ্গে থাকবেন। চলবে-
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।