বন্ধুদের নিয়ে বাঁচি
বন্ধু শাহেদ কায়েসকে এখন খুব সাহসী আর স্বপ্নচারী মনে হয়। সে আর সবার মতো চাকরির পেছনে না ঘুরে নিজের গ্রামে ফিরে গিয়েছিল। আর দরিদ্র মানুষ ও সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের জন্য কিছু করার লক্ষ্যে আত্ম নিয়োগ করে। তাকে নিয়ে লেখার ইচ্ছা ছিল অনেক দিনের। লিখতে বসে দেখি অন্য কয়েকজন বন্ধু বিভিন্ন সময় সুন্দর কিছু লেখা লিখেছে।
এখন ওই লেখাগুলোর চেয়ে সুন্দর কিছু লিখতে পারবো না। তাই তাদের কয়েকটা লেখা এখানে তুলে দিলাম। একই বিষয়ের উপর বেশ কয়েকটি লেখা বলে পুনরাবৃত্তি বিরক্তির কারণ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে যে কোন একটা লেখা পড়ার অনুরোধ থাকলো। বিশাল পোস্টের জন্য দুঃখিত।
সুবর্ণগ্রামের শিক্ষা আন্দোলন
লেখক: সাইমন জাকারিয়া
ঢাকার অদূরে ইতিহাস খ্যাত সুবর্ণগ্রাম তথা সোনারগাঁওয়ে নিম্নবর্গের মানুষের মধ্যে এখন চলছে শিক্ষা আন্দোলন। এক উচ্চশিক্ষিত তরুণ সমাজের অধিকার বঞ্চিত মানবশিশুদের জন্য এই শিক্ষা আন্দোলন পরিচালনা করে আসছেন। তিনি প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার বিপরীতে এরই মধ্যে শিক্ষার আলো নিয়ে গেছেন নদীতে ভাসমান বেদেদের নৌকা বহরে, ঋষিপাড়ার মন্দির প্রাঙ্গণে, এমনকি মেঘনা নদীর বুকে জেগে ওঠা ছোট্ট দ্বীপ সদৃশ্য নুনেরটেক গ্রামের জেলেদের মহল্লায়।
সুবর্ণগ্রামের এই শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রদূত তরুণের নাম শাহেদ কায়েস। প্রতিভাবান ও মেধাবী এই তরুণ জন্ম নিয়েছিলেন সোনারগাঁও অঞ্চলের ললাটি গ্রামে।
তারপর কৃতিত্বের সঙ্গে এলাকার স্কুল ও কলেজের সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখানে অধ্যয়ণকালে উচ্চতর শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে চলে যান ভারতের মাদ্রাজে অবস্থিত আন্না ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে কম্পিউটার সাইন্সে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ শেষে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন। কিন্তু দেশ ও নিজের এলাকার শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে পড়া মানুষের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের জন্য তিনি বিদেশ বিভূঁইয়ে শিক্ষকতা করার মোহনীয় পেশা-পরিচয়কে পরিত্যাগ করে দেশে ফিরে আসেন। শুরু করেন নিজের গ্রাম ও নিজ এলাকা নিয়ে ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার কাজ। অচিরেই তিনি শনাক্ত করেন কেন বেদে, ঋষি ও মাঝিদের শিশুরা প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় সচারাচার অংশগ্রহণ করে না।
পর্যবেক্ষণমূলক এই গবেষণার ফলাফলের উপর দাঁড়িয়ে তিনি সুবর্ণগ্রাম ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন এবং নতুনধারার শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। কিন্তু কী সেই নতুনধারার শিক্ষা ব্যবস্থা?
ভাসমান বেদেবহর পাঠশালা
সোনারগাঁওয়ের মেঘনা নদীর ঢেউ চঞ্চল স্রোতধারা থেকে একটি শাখা নদী বেরিয়ে এসে অনেকটা শান্ত স্বভাবে সোনারগাঁওয়ের ভাটিবন্দর-রঘুভাঙ্গা এলাকায় এসে থেমেছে। মেঘনার সেই শান্ত স্বভাবের সুযোগে এখানে নৌকার উপর বসতি স্থাপন করেছে বেদে স¤প্রদায়। আসলে, মাটিতে দখল নেই বলেই তাদের জীবন নদীতে ভাসমান। ভাটিবন্দর-রঘুভাঙ্গায় মেঘনা নদীতে মোট বারোটি নৌকা পাশাপাশি স্থাপন করে বহু দিন ধরে প্রায় স্থায়ীভাবে সংসার পেতেছে বেশ কিছু জেলে পরিবার।
তরুণ ও শিক্ষাদান প্রয়াসী শাহেদ কায়েস অনেক দিন ধরে তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পান, বেদে পরিবারের বড়রা পেশগত কারণে সকালে বেরিয়ে পড়েন বিভিন্ন গ্রামে আর তাদের শিশু সন্তানেরা সারাদিন নৌকাতে থেকে যায়, কিংবা আসে পাশে খেলাধুলা করেই দিন পেরিয়ে দেয়, তাদের কেউই প্রায় স্কুলে যায় না। শাহেদ কায়েস বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি এ বিষয় নিয়ে বেদে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলেন। কিন্তু তারা কেউই প্রায় প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেদেরকে যুক্ত করতে তেমন উৎসাহ দেখান না। অগত্যা শাহেদ কায়েস বিকল্প ভাবনা ভাবতে থাকেন এবং বেদে বহরের নৌকার উপর ভাসমান পাঠশালা স্থাপনের স্বপ্ন দেখেন।
অচিরেই তিনি বেদে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার প্রেক্ষিতে ভাটিবন্দর-রঘুভাঙ্গার মেঘনা নদীর উপর প্রতিষ্ঠা করেন বেদেবহর ভাসমান পাঠশালা। এক দুপুরে সুবর্ণগ্রামে শিক্ষা আন্দোলনের চিত্র পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে দেখি একটি নৌকার ছইয়ে বেদেবহর ভাসমান পাঠশালা-এর একটি সাইনবোর্ড লাগানো। আর সে নৌকার পাটাতনের উপর দিকে কাঠের তকতা বিছিয়ে তার উপর বসে ১৬ জন বেদে শিশু শিক্ষিকার কাছ থেকে সমস্বরে বই থেকে বাংলা ভাষায় পাঠ গ্রহণ করছেন, তাদের বাংলা ভাষায় শিক্ষা শেষ হলে শিক্ষিকা হিমা তাদেরকে ইংরেজি পাঠ শেখান, এমনকি শেখান অংকের সরল পাঠ, সংখ্যা গণনা, নামতা এবং হিসাব নিকাশ, যেন তারা জীবনের পথটা বেবুঝের মতো নয়, একজন বুঝবান মানুষের মতো ঠিকঠাক বুঝেশুনে পাড়ি দিতে পারে।
সেদিন আমাদের আগমন উপলক্ষে শাহেদ কায়েস নিজেও বেদে শিশুদের শিক্ষা তদারক করতে হাজির হয়েছিলেন নৌকাতে। দেখা গেল বেদে পরিবারের নারী সদস্যরা শাহেদের আগমনে বেশ আনন্দ প্রকাশ করলেন।
তারা জানালেন, তাদের সন্তানদের এই শিক্ষা দানের সুযোগ করে দেবার জন্য তারা শাহেদের কাছে ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ।
বেদেবহর ভাসমান পাঠশালা সম্পর্কে শাহেদ কায়েস জানালেন, ইচ্ছা করলেই বেদে শিশুরা লোকালয়ের স্কুলে লেখাপড়া করতে পারে। কিন্তু সামাজিক অবহেলা আর নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখতে সেটা তারা করে না। এটা আমি দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করে বুঝেছি। তাই তাদের নিজেদের নৌকার উপরেই আমি শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।
এখানে প্রায় ১৬ জন শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দেন ২ জন শিক্ষক। আর এই শিক্ষা কার্যক্রম সম্পূর্ণ অবৈতনিক। এখানকার শিক্ষকরা অনেকটা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে শিক্ষা দিয়ে থাকেন।
ঋষিপাড়া মন্দির পাঠশালা
সোনারগাঁও জাদুঘরের কাছেই বাগমুছা গ্রামের ঋষিপাড়া। সেখানে প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ ঘর ঋষিদের বাস।
এরা পেশায় সকলে মুচি। অর্থাৎ জুতো সেলাই করে। এদের ছেলে মেয়েদের সমাজে ভালো দৃষ্টিতে দেখা হয় না। এরা সকলে সমাজের সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এমনকি আমাদের দেশের এনজিওগুলোও অনেকটা এদের এড়িয়ে চলে।
কারণ, এনজিওগুলো জানে ঋষিপাড়াতে তাদের বিনিয়োগ কখনোই লাভবান হবে না। শাহেদ কায়েস ওইসব সুবিধা বঞ্চিত ঋষিদের ছেলেমেয়েদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন ঋষিপাড়া মন্দির পাঠশালা। ঋষিপাড়ার সার্বজনীন দুর্গামন্দিরের সামনে প্রায় ৬৫ জন শিক্ষার্থী প্রতিদিন দুপুরে ২ জন শিক্ষিকার কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করে থাকে। ঋষিপাড়ার শিশুদেরকে শিক্ষাদান করেন ঋষিপাড়ারই দু’জন শিক্ষার্থী। তারা পাশের উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন।
আমরা সেদিন দুপুরে দেখি মন্দিরের সামনের পাঠশালাটিতে প্রায় ৬০-৭০জন শিশু সরবে ক্লাস করছে। আমরা ঋষিপাড়া মন্দির পাঠশালায় ঢোকা ও বের হবার পথে লক্ষ করলাম ঋষিপাড়ার নারীদের কেউ কেউ ছুটে এসে শাহেদ কায়েসকে বললেন যে, তাদের সন্তানদের এখনও বই-খাতা দেওয়া হয়নি, কবে দেওয়া হবে। শাহেদ মিষ্টি হেসে বললেন আপনাদের সন্তানদের নাম আমাদের শিক্ষিকা তুলসীর কাছে দিবেন। আমি বই-খাতা পাঠিয়ে দেবো।
শাহেদের কথায় আমরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, এখানকার এতোগুলো শিক্ষার্থীর বই-খাতা সবই কী বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়?
শাহেদ উত্তর করেন, হ্যাঁ এখানকার সকল শিশুদের যাবতীয় শিক্ষা উপকরণ আমরা সুবর্ণগ্রাম ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বিনে পয়সায় সরবরাহ করি।
তবে, আশার কথা এই যে, এখানকার শিক্ষকরা কিন্তু স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে আমাদের কাজে সহযোগিতা করছেন। তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।
মায়াদ্বীপ জেলে শিশুদের পাঠশালা
সোনারগাঁও বেড়াতে গেলে অনেকে পার্শ্ববর্তী মেঘনা নদীকেও দেখে আসেন। কিন্তু সেই মেঘনার মাঝখানে যে নুনেরটেক নামে একটি গ্রাম আছে তা হয়তো অনেকেই জানেন না। সেখানে এরশাদ সরকার শান্তিবন নামে গুচ্ছ গ্রাম প্রতিষ্ঠা করে জনমানুষের বসতি স্থাপন করেন।
সে গ্রামে এখন কয়েকশত লোকের বসবাস। পেশাগতভাবে তাদের অধিকাংশ জেলে। সোনারগাঁও থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকাতে সেই জেলেদের গ্রামে পৌঁছাতে প্রায় ৪০ মিনিট সময় লাগে। সেখানকার মানব সন্তানদের জন্য শিক্ষার আলো নিয়ে গেছেন শাহেদ কায়েস। প্রতিষ্ঠা করেছেন মায়াদ্বীপ জেলে শিশু পাঠশালা।
এই পাঠশালাটিতে প্রায় ৫০ জন সুবিধা বঞ্চিত জেলে শিশু লেখাপড়া করছে। আমরা যখন সেখানে গেলাম তখন সেখানে পাঠদান করছিলেন সেখানকার একজন শিক্ষিকা শামসুন নাহার। এখানেও প্রতিদিন দুপুরের পর দুইজন শিক্ষিকা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে জেলে শিশুদের জন্য শিক্ষাদান করছেন।
শিক্ষাপ্রেমী শাহেদের অপরাপর কার্যক্রম
তরুণ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার শাহেদ কায়েস তার অন্য বন্ধুদের সঙ্গে যৌথভাবে ২০০৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে ঢাকার পান্থপথে ‘প্রিজম ইনফো সেল’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে তথ্যপ্রযুক্তির আর্কাইভ প্রস্তুতির কার্যক্রমে ব্যস্ত ছিলেন। একই সময়ে তিনি একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন এবং নিজের গ্রামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছিলেন।
তার আগে ২০০৩ সালে নিজের গ্রাম ললাটিতে প্রতিষ্ঠা করেন ছোটদের স্কুল বিদ্যানিকেতন। পরে স্কুলটির নাম পরিবর্তন করে সুবর্ণগ্রাম আইডিয়াল স্কুল নাম রাখেন। ২০০৪ সালে নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন প্রগতি পাঠচক্র। ৪টি কলেজ আর ৪টি গ্রামের ৬০০ শ’র অধিক ছেলেমেয়ে এই পাঠচক্রে অংশগ্রহণ করেন। এই পাঠচক্রের কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে তরুণ শাহেদ কায়েস তার নিজ এলাকায় রীতিমতো বই পাঠের বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেন।
এদিকে শিশুদের পড়ালেখা আর তরুণ প্রজন্মকে সংস্কৃতির আবহে রাখতে স্কুল আর পাঠচক্র গঠনের পাশাপাশি ওই এলাকার মানুষদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য শাহেদ কায়েস ২০০৪-এ যোগ দেন সমবায় আন্দোলনে, প্রতিষ্ঠা করেন সোনারগাঁ বেনিফিট ফান্ড নামের একটি সমবায় সমিতি। এই প্রতিষ্ঠানটি ২০০৭-এ উপজেলার শ্রেষ্ঠ সমবায় সমিতি হিসেবে সমবায় অধিদপ্তর থেকে পুরস্কার অর্জন করে। এতসব কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রয়োজনে তিনি ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে সুবর্ণগ্রাম ফাউন্ডেশন গঠন করেন। বর্তমান শাহেদ কায়েসের সকল শিক্ষা ও সামাজিক কর্মকাণ্ড এই ফাউন্ডেশনের নিয়মিত কার্যক্রম হিসেবে পরিচারিত হচ্ছে।
কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
শাহেদ কায়েস নিজে যেহেতু একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক সেহেতু তাঁর সামাজিক শিক্ষা কার্যক্রম থেকে কম্পিউটার শিক্ষা বাদ যাবে কেন।
তাই তো শাহেদ সোনারগাঁয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন সুবর্ণগ্রাম আইটি ভিশন। সোনারগাঁওয়ের একটি দোতলা ভবনের পুরো দোতলার অনেকগুলো রুম নিয়ে সুবর্ণগ্রাম আইটি ভিশন সেন্টার। সেখানে থরে থরে সাজানো কম্পিউটার। জানা গেল, এই প্রতিষ্ঠানেও এলাকার ছেলেমেয়েদের নামমাত্র খরচে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ বিষয়টিও প্রায় অবৈতনিক।
সুবর্ণগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল স্কুল
সাহাপুর উপজেলা শহর সোনারগাঁয়ে অবস্থিত। সেখানে শাহেদ কায়েস চৌকস শিশুদের জন্য গড়ে তুলেছেন সুবর্ণগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। সাহাপুরের শহিদুল্লাহ প্লাজায় ব্যাংক ভবনের উপর তলায় এই স্কুল। শাহেদ জানান, শিশুদের এ স্কুলটি কিন্তু অবৈতনিক নয়। কারণ এই স্কুলে যেসব শিশু লেখাপড়া করে এরা সবাই স্বচ্ছ্বল পরিবারের।
সে দিক দিয়ে এ স্কুলটি আমাদের একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান। আর এ স্কুলের আয় দিয়েই চলে আমাদের অন্য তিনটি অবৈতনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
এতক্ষণে আমাদের ঘোর ভাঙে, কেননা এতক্ষণ আমরা একটি প্রশ্নের মধ্যে আটকে ছিলাম, আর তা হচ্ছে বেদেবহর ভাসমান পাঠশালা, ঋষিপাড়া মন্দির পাঠশালা ও মায়াদ্বীপ জেলে শিশু পাঠশালার জন্য বিনামূল্যে দেওয়া বই-খাতা-কলমের টাকাটা শাহেদ কায়েস কোথা থেকে সংগ্রহ করেন, এবার আমরা উত্তর পেয়ে যাই, একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের অর্থে কতটা মানবসেবা, শিক্ষাসেবা প্রদান করা সম্ভব। অতএব, ধন্য হোক তরুণ শিক্ষাপ্রেমী শাহেদ কায়েসের সকল কার্যক্রম।
৮ আগস্ট ২০০৯ প্রথম আলোর ছুটির দিনে কাভার স্টোরি হিসেবে প্রকাশিত
০০০০০০০০০০০০০০০০০
সুবর্ণগ্রামের খোঁজে
লেখক: কবির হুমায়ূন
আমাদের শাহেদ কায়েস আকাশের মতো বিস্তৃতি নিয়ে চলে।
তাকে আমরা কোনও ভাবে আমাদের সীমাবদ্ধ বারান্দায় আটকে রাখতে পারি না। যেখানে যার সমস্যা সেখানে শাহেদ কায়েস আপন বেগে গিয়ে হাজির। দিন রাত, অমাবশ্যা পূর্ণিমা কোনও কিছু শাহেদের কাছে ধর্তব্য বিষয় নয়। প্রাণ ভরপুর শাহেদ লাটিমের মতো ঘুরছেতো ঘুরছে। এর মধ্যেই অসাধারণ ফলাফল করে শাহেদ ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়ে অল্প কিছুদিনের মাথায় তাকে গুডবাই জানিয়ে একদিন কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে বুয়েটে ভর্তি হয়ে যায়।
কিন্তু তার মন পড়ে থাকে কবি, কবিতা আর শিল্পের আঙ্গিনায়। শাহেদ শিশির ভট্টাচার্যের প্রেমে পড়ে একদিন বগলে তুলে নেয় স্কেচ খাতা। যেভাবেই হোক তাকে ভর্তি হতে হবে চারুকলায়। শাহেদের এই উত্তেজনায় আমরা কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারিনা। আমাদের কারো কথা শুনার মতো সময় শাহেদের নেই।
নানা রকম পাঠচক্র, সাহিত্য প্রত্রিকা প্রকাশ আর শিল্প সাহিত্যের সংগঠন নিয়ে শাহেদ সীমাহীন ব্যস্ত সময় কাটায়।
এর মধ্যেই একদিন শাহেদ হাজির। প্রথম বর্ষের ফলাফল আবার অসাধারণ হওয়ায় স্কলারশিপ পাওয়া গেছে। এবার শাহেদ পশ্চিমা কোনও দেশ পছন্দ না করে পছন্দ করে পাশের দেশ ভারত। একদিন আমাদের সকলকে বিস্মিত করে সুবোধ বালকের মতো শাহেদ চলে যায় ভারতের মাদ্রাজের আন্না ইউনিভার্সিটিতে।
সাদ কামলী, সরকার আমিন, মুজিব ইরমসহ আমরা তাকে বিদায় দিতে মৌচাকে সোহাগের কাউন্টারে ভিড় জমাই। হাসতে হাসতেই আমাদের প্রাণবন্ত শাহেদ গতির পথে মিলিয়ে যায়। মাদ্রাজ চলে গেলেও আর দশ জনের মতো শাহেদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় না। আলাপে-আড্ডায় শাহেদ আমাদের সঙ্গে আগের মতোই আলোচনায় জড়িয়ে থাকে। এসব করতে করতেই ডিগ্রি লাভের পর শাহেদ বাংলাদেশে আমাদের ভূবনে আবার ফিরে আসে ২০০৩-এ।
মাদ্রাজে আবার ফিরে যাওয়ার তার কোনও ইচ্ছা থাকে না। এই সময়টায় আমি তারকা কাগজ নামে আজকের কাগজের একটা ম্যাগাজিন সম্পাদনা করি। শাহেদ আমার সঙ্গে কাজে লেগে পড়ে। অসাধারণ তিনটা কাভার স্টোরি করে শাহেদ। সেসব ছাপাও হয় তারকা কাগজে।
এর মধ্যে একদিন ওই ২০০৩ সালেই আমি চীন দেশে চলে যাই। যাওয়ার কালে আমি একমাত্র শাহেদ কায়েসকে পেয়েছিলাম পাশে।
২০০৫-এ কিছুদিনের জন্য দেশে ফিরলে সেই শাহেদময় আমার সময় আবার। তখন শাহেদ পান্থপথে ‘প্রিজম ইনফো সেল’ নামে বিশাল অফিস করে তথ্যপ্রযুক্তির আর্কাইভ প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। এ সময়টায় আমি জানতে পারি এরই মধ্যে শাহেদ কিছুদিন একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছে।
পাশাপাশি নিজ গ্রাম ললাটিতে ২০০৩ সালেই প্রতিষ্ঠা করেছে ছোটদের স্কুল বিদ্যানিকেতন। পরে এই স্কুলটিই নাম পরিবর্তন করে হয়ে যায় সুবর্ণগ্রাম আইডিয়াল স্কুল। সুন্দর আর শুভবোধের ঘোরলাগা শাহেদ ঘোরের ভিতরেই ঘুরে বেড়ায়। ফলে ওই ললাটি গ্রামেই ২০০৪ সালে সে আবার প্রতিষ্ঠা করে প্রগতি পাঠচক্র। ৪টি কলেজ আর ৪টি গ্রামের ৬০০ শ’র অধিক ছেলেমেয়ে এই পাঠচক্রে অংশগ্রহণ করে ওই এলাকায় রীতিমতো বই পাঠের বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলে।
আমরা মানে সাদ কামালী দেশে ফিরলে তিনি সহ সবাই আবার ছুটে যাই ললাটি। দেখে আসি শাহেদের স্বপ্নের স্কুল আর পাঠচক্র। অংশ গ্রহণ করি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে।
এদিকে শিশুদের পড়ালেখা আর তরুণ প্রজন্মকে সংস্কৃতির আবহে রাখতে স্কুল আর পাঠচক্র গঠনের পাশাপাশি ওই এলাকার মানুষদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য শাহেদ ২০০৪-এ যোগ দেয় সমবায় আন্দোলনে। এর পাশিাপাশি ওই এলাকায় প্রতিষ্ঠা করে সোনারগাঁ বেনিফিট ফান্ড নামের একটি সমবায়।
এই প্রতিষ্ঠানটি ২০০৭-এ উপজেলার শ্রেষ্ঠ সমবায় সমিতি হিসেবে সমবায় অধিদপ্তর থেকে পুরস্কার অর্জন করে।
তারপর অনেকদিন শাহেদের খবর জানিনা আমি। চীনে ফিরে গেলে লেখাপড়ার চাপে আমাদের কবিতার জগতও আমার কাছ থেকে হারিয়ে যায়। ২০০৮-এ ডিগ্রি লাভের পর যখন দেশে ফিরে আসার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, সাদ কামালী ফোন করে বলেন দেশে ফিরেই শাহেদের খোঁজ নিয়ে তাকে জানাতে। তার সঙ্গেও অনেকদিন শাহেদের যোগাযোগ নেই।
দেশে ফিরে শাহেদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সমস্যা হবে এটা আমার জানা ছিলো না। হলো। কেউ শাহেদের ফোন নাম্বার দিতে পারলো না।
অবশেষে ফোন নাম্বার সংগ্রহ হলেও শাহেদ সে ফোন ধরে না। এর মধ্যে আমি দোভাষির কাজ করতে গিয়ে তিন মাস সময় পার করে দেই।
তারপর প্রিয় সরকার আমিন আমাদের আমিন ভাই একদিন আমাকে নিয়ে সোনারগাঁয়ে নদীতে বেড়াতে যান। আমিন ভাইয়ের তৎপরতায় আমরা আবার শাহেদকে ফিরে পাই। সোনারগাঁ এর সাহাপুরে আমাদের শাহেদ অবস্থান করছে।
পাওয়ার পর মনেই হয়না বহুকাল শাহেদের সঙ্গে দেখা হয়নি। মনে হয় এইতো কাল কি পরশু শাহেদের সঙ্গে তুমুল আড্ডা হয়েছে।
সোনারগাঁয়ের রাস্তায় হাটতে হাটতে শাহেদ এক ফাঁকে জানিয়ে দেয় তার কর্মকাণ্ডের সা¤প্রতিক অবস্থা। আমি ততো গুরুত্ব দিয়ে শুনিনা। কিন্তু সুবর্ণগ্রাম কোথায়? আমি সুবর্ণগ্রাম খুঁজি। শাহেদ জানায় এইতো সামনেই সুবর্ণগ্রাম। তখন আমার ভুল ভাঙ্গে।
সোনারগাঁয়ের প্রাচীন নাম সুবর্ণগ্রাম। সে নামেই শাহেদ তার গড়া প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেছে। সেদিন রাত হয়ে যাওয়ায় আমরা আর সময় দেই না। ঢাকায় ফিরতে হবে। আমিন ভাইকে বলে শুধু দেখে আসি সুবর্ণগ্রাম আইটি ভিশন।
ঢাকায় ফিরে এলে বিষয়টি আমার মাথা থেকে যায় না। সাহাপুরে শাহেদ অনেক বেশি শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে বসেছে। কিন্তু কিভাবে চলে এসব প্রতিষ্ঠান? কিভাবে ব্যবস্থা করে শাহেদ? শুনেছি শাহেদ তার সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে প্রান্তিকের এই মানুষগুলোর জন্য সব ত্যাগ স্বীকার করে নিচ্ছে। মোবাইলে আমার সঙ্গে মাঝে-মাঝে কথা হয় শাহেদ কায়েসের। তারই সূত্র ধরে শাহেদ বারবার আমাকে অনুরোধ করে তার কাছে গিয়ে ক’দিন থেকে আসতে।
কথা দিয়েও সেটা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। দেখতে পাই সূবর্ণগ্রাম নামে ইস্যু ভিত্তিক একটি পত্রিকাও শাহেদ সম্পাদনা করছে সাহাপুর থেকে। এদিকে বিচিত্র আড্ডায় কবি রহমান হেনরী যিনি আবার সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তার সঙ্গে এবং আমার বন্ধু বিশ্ব পর্যটক আশরাফুজ্জামান উজ্জলের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা হয়। আমি এই দু’জনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করি কোনও একটা পথ খুঁজে পাওয়া যায় কিনা শাহেদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করার জন্য। এরা দু’জনই প্রচুর আগ্রহ দেখালে কোনও এক সকালে আমি তাদের নিয়ে সূবর্ণগ্রামের খোঁজে সাহাপুরের দিকে রওয়ানা দেই।
আমাদের সে যাত্রায় ভাষাচিত্রের তরুণ প্রকাশক এবং স্বাংস্কৃতিক যোদ্ধা খন্দকার সোহেলও অংশ গ্রহণ করে। দিনটি ছিলো শুক্রবার। দুপুরে সাহাপুর পৌঁছালে সেখানকার মিষ্টির দোকানে টাটকা মিষ্টি রান্না হতে দেখে হেনরী আর আমি লোভ সামলাতে পারিনা। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে মিষ্টি খাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি। শাহেদ আমাদের নিয়ে যায় তার সুবর্ণগ্রাম আইটি ভিশন সেন্টারে।
দোতলা ভবনের পুরো দোতলার অনেকগুলো রুম নিয়ে সুবর্ণগ্রাম আইটি ভিশন সেন্টার। সেখানে থরে থরে সাজানো কম্পিউটার। তারই পাশে একটি কক্ষে শাহেদের থাকার ব্যবস্থা। মনে মনে ভাবছিলাম অজপাড়াগাঁয়ে শাহেদ এসব কি করছে? সেটার জবাব শাহেদ দিয়ে দেয়। এলাকার ছেলেমেয়েদের সেখানে নামমাত্র খরচে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
বিষয়টি প্রায় অবৈতনিক। সাহাপুর উপজেলা শহর সোনারগাঁয়ে অবস্থিত। সেখানেই শাহেদ চৌকস শিশুদের জন্য গড়ে তোলে সুবর্ণগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। সাহাপুরের শহিদুল্লাহ প্লাজায় ব্যাংক ভবনের উপর তলায় এই স্কুল। আমরা দল বেঁধে ঘুরে ঘুরে সেসব দেখি।
আর বিষ্মিত হই। পাশ থেকে উজ্জল বলে, আমাদের শাহেদতো সন্ত হয়ে গেছে। অসাধারণ সব কাজ। আর শাহেদ জানায় এই শিশুদের স্কুলটি কিন্তু অবৈতনিক নয়। কারণ এই স্কুলে যেসব শিশু লেখাপড়া করে এরা সবাই স্বচ্ছ্বল পরিবার থেকে আসা।
এই স্কুলটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান। এই স্কুলের আয় দিয়ে চলে অন্য আরো তিনটি অবৈতনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আমরা শাহেদের কথা শুনি আর বিষ্মিত হই। শাহেদ এতো কিছু সামাল দেয় কিভাবে? আমি চিনতাম নব্বই দশকের দুর্দান্ত তরুণ কবি শাহেদ কায়েসকে, যে শুধুই শিল্পঘোরে উন্মাতাল ছিলো, সেই শাহেদের এতোসব সামাজিক কর্মকাণ্ড দেখে আমাদের যেন বিশ্বাস হতে চায় না। কারণ সময়টা হলো মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেভাবে হোক নিজের আখের গুছিয়ে নেয়ার সময়।
সেখানে আমাদের শাহেদ নিজের আরাম-আয়েসি জীবন অবলীলায় পরিত্যাগ করে বেছে নিয়েছে মানুষ সংশ্লিষ্ট অত্যন্ত দূরুহ কাজ।
২০০৫-এ আমার অবস্থান চীনে। ফলে আমি কিছুই জানি না। ২০০৫-এর সেপ্টেম্বরে শাহেদ প্রতিষ্ঠা করে সুবর্ণগ্রাম ফাউন্ডেশন। এই সুবর্ণগ্রাম ফাউন্ডেশনের আওতায় শাহেদের সমস্ত কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
সুবর্ণগ্রাম আইটি ভিশন কিংবা সুবর্ণগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল স্কুল দেখে শাহেদের মূল কাজের কিছুই বুঝার উপায় নেই। আমরা তখন বুঝতে পারিনি। ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের ক্লাস সমূহের অসাধারণ সব নদী ঘেষা নাম : মেঘনা, শীতলক্ষ্যা, ব্রহ্মপুত্র- দেখে আমরা আপ্লুত।
দুপুরের পর শাহেদ আমাদের নিয়ে যায় ঋষিপাড়া মন্দির পাঠশালায়। বাগমুছায় একটি ঋষিপাড়া আছে।
সে কথা আমাদের জানা নেই। এরা পেশায় সকলে মুচি। অর্থাৎ জুতো সেলাই করে। এদের ছেলে মেয়েদের সমাজে ভালো দৃষ্টিতে দেখা হয় না। এরা সকলে সমাজের সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
এমন কি আমাদের দেশের এনজিওগুলো পর্যন্ত এদের এড়িয়ে চলে। কারণ তাদের বিনিয়োগ সেখানে লাভবান হবে না। শাহেদ ওইসব সুবিধা বঞ্চিত ছেলেমেয়েদের জন্য ওই পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেছে। ৬৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য সেখানে ২ জন শিক্ষক রয়েছেন। তারাও ওই স¤প্রদায়ের।
বইপত্র সহ শিক্ষার সব উপকরণ বিনে পয়সায় সরবরাহ করা হয়। এমন একটি উদ্যোগ দেখে আমাদের দলের সবাই আবেগে তিরতির করে ওঠে। আমরা শাহেদকে সাহস দিতে থাকি। শাহেদ তার সারল্যের হাসি হাসে। কারণ গত প্রায় চার বছর ধরে সে তার এই সংগ্রাম একাই চালিয়ে আসছে।
সেখানে আমাদের সাহস তার জন্য কতোটুকু কি করবে সেটা আমরাও বুঝতে পারি না। ঋষিপাড়া থেকে আমরা চলে যাই সাহাপুরের পাশ ঘেষে যাওয়া মেঘনা নদীতে। সেখানে বাস করে বেদেরা। পাশেই লোকালয় থাকলেও নৌকার জীবনই তাদের প্রিয়। বারোটি নৌকা একত্রিত করে সেখানে সংসার পেতেছে বেদেরা।
তারই একটি নৌকায় শাহেদ গড়ে তুলেছে বেদে বহর ভাসমান পাঠশালা। এসব আমরা ঢাকায় বসে কল্পনাও করতে পারি না। ওই পাঠশালায় রয়েছে ১৬ জন শিক্ষার্থী। ইচ্ছা করলেই এরা লোকালয়ের স্কুলে লেখাপড়া করতে পারে। কিন্তু সামাজিক অবহেলা আর নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখতে সেটা তারা করে না।
এই ১৫ জন শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দেন ২ জন শিক্ষক। এটিও সম্পূর্ণ অবৈতনিক। বেদেবহরেও সভ্যতার আলো পৌঁছেনি। এরাও সব ধরনের সামাজিক সুবিধা বঞ্চিত। আর শাহেদ এদের জন্য সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে শিক্ষার আলো বিতরন করছে।
এসব করতে করতে, দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। আমরা আর মায়াদ্বীপ জেলে শিশু পাঠশালায় যেতে পারি না। ওই পাঠশালায় ৫০ জন সুবিধা বঞ্চিত জেলে শিশু লেখাপড়া করছে। তাদেরও শিক্ষা দিচ্ছেন ২ জন শিক্ষক শাহেদের তত্ত্বাবধানে। আমাদের কাছে সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হয়।
অবিশ্বাস্য মনে হয়। কিন্তু সবকিছুই সত্য এবং বাস্তব। এর বাইরেও সোনারগাঁ উপজেলা ঘিরে শাহেদ করে যাচ্ছে আরও অনেক কাজ। মেধাবী শিক্ষার্থীদের দেওয়া হচ্ছে সংবর্ধনা। চলছে শাহেদের স্বপ্নের পাঠচক্রের কাজও।
এসব কাজে শাহেদের পাশে দাঁড়িয়েছে আমাদের আরেক বন্ধু। কথাশিল্পী রাজীব নূর। তার প্রতিষ্ঠান যোগসূত্রের সৌজন্যে এসব কাজে বিনে পয়সায় সরবরাহ করা হয় বই। কারণ, যোগসূত্র একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান।
এভাবেই শাহেদ তার স্বপ্নের বীজ বপন করে চলেছে সুবর্ণগ্রাম ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে।
আমার আত্মবিশ্বাস আছে শাহেদের উপর। শাহেদ তার কাজে সফল হবে। কিংবা এভাবে বলতে চাই শাহেদের এখন আর সফল না হয়ে উপায় নেই। যে তার সমস্ত কিছু বিলিয়ে দিয়ে সুবিধা বঞ্চিত প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, সে মানুষদের নিয়ে বিফল হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। নিশ্চয়ই কেউ না কেউ সুবর্ণগ্রাম ফাউন্ডেশনের এই স্বপ্নবীজকে সফল করে তুলতে শাহেদের হাতে হাত রাখবেই।
আমরা মায়াদ্বীপ জেলে শিশু পাঠশালায় যাওয়ার ইচ্ছা বুকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসি। কিন্তু আমাদের চোখে মুখে লেগে থাকে সুবর্ণগ্রাম ফাউন্ডেশনের দেখে আসা কাজগুলো।
০০০০০০০০০০০০০০০০
শাহেদ কায়েস : এক তরুণের রক্ত-রৌদ্রের স্বপ্ন
লেখক: শামসুদ্দোহা চৌধুরী
কালের থাবায় বিপর্যস্ত ঐতিহ্য সোনারগাঁও। প্রাচীন রাজধানীর লোনা ইটের নস্টালজিক গন্ধ চারপাশে আমোদিত করে অহর্নিশি। কালাকালের বাঙালির সোনালি সভ্যতার রক্ত ঘাম মনন মেধা মিশে যেখানে একাকার।
স্বপ্নীল ভূবনের সওদাগরের সওদার বেচাকিনি শেষ। কালের রাহুগ্রাসের দীর্ঘ পথচলার হাহাকার মেঘনার নূপুর শব্দ সম তরঙ্গে আছড়িয়ে পড়ে। মেঘনা পাড়ের অসংখ্য তরুণ এক বুক আশা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আশা হতাশার দোলাচলে তাদের বুক কাঁপে অহর্নিশি। তাদেরই মাঝে একজন তরুণ, বুকে সোনালী স্বপ্ন।
সোনারগাঁয়ের এক গ্রাম ললাটির সেই ছেলেটি। শাহেদ কায়েস। চোখে তার দিগন্তের স্বপ্ন। বুকে রক্ত রৌদ্রের গান। বিশেষ ব্রত নিয়ে মাঠে কাজ করার চিন্তায় ব্যাকুল।
নি:সঙ্গ পথচলা। কবিগুরুর সেই বিখ্যাত গানের ‘যদি ডাক শুনে তোর কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’ মন্ত্র বুকে ধারণ করে একলা চলার ব্রত নিয়ে দু’পাশের অবহেলা, উপেক্ষা আর বিদ্রুপের ভ্রƒকুটিকে দু’হাতে ঠেলে দিয়ে চারপাশের প্রকৃতি ও মানবতা থেকে গ্রহণ করছেন এগিয়ে যাবার দু:সাহস।
এক তরুণের রক্ত-রৌদ্রের সংগ্রাম
প্রতিভাবান ও মেধাবী শাহেদ কায়েস, জীবনের কুসুমাস্তীর্ণ চলার পথে না হেঁটে, হাঁটছেন এক অসমতল বন্ধুর পথে। নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন অবহেলিত উপেক্ষিত মানুষের জন্যে। সংসারে এই সমস্ত উপেক্ষিত অবহেলিত লোকদের দু’মুঠো অন্ন এবং এক টুকরো বস্ত্র ছাড়া চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই।
যাদের লেখাপড়ার কথা কেউ ভাবেনি কোনোদিন। বর্ণমালার প্রশান্তি ঘেরা শব্দগুলো যাদেরকে আলোড়িত করেনি, তাদের মাঝে দুর্গম অঞ্চলের পরানের গহীনে নিজ চেষ্টায় নিজ খরচে শিক্ষার মশাল জ্বালিয়ে চলছেন শাহেদ কায়েস। সোনারগাঁয়ের ললাটি গ্রামের সেই ছেলেটি হাঁটি হাঁটি পা পা করে কৃতিত্বের সঙ্গে এলাকার স্কুল ও কলেজের সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং সেখানে অধ্যয়নকালে উচ্চতর শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে চলে যান ভারতের চেন্নাইয়ে অবস্থিত আন্না ইউনিভার্সিটিতে। সফল ভাবে শিক্ষা সমাপ্ত করার পর একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন। কিন্তু শেকড়ের টানে তার মন আঁকুপাঁকু করছিল, ফেলে আসা জন্মভূমি ললাটিতে ফিরতে হবে।
অসহায় দারিদ্র্য পীড়িত, অবহেলিত নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। আর থাকা হলোনা চেন্নাইয়ে। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এলেন, সোজা তার নিজ গ্রাম ললাটিতে। গাঁয়ের মানুষ শাহেদকে দেখে খুশি হলো। কিছু মানুষ বিরক্তও হলো।
এলাকার তরুণ বয়স্ক লোকদের কাছে নিজ অভিলাষের কথা ব্যক্ত করলেন। এগিয়ে এলো অনেকেই, নিরক্ষর ললাটি গ্রামকে আলোকিত করার মহান ব্রত নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা অনেকেই প্রকাশ করলেন। শুরু হলো এক বন্ধুর পথচলা। এলাকার গুটিকয় তরুণ-তরুণী নিয়ে এগিয়ে চললেন। শুরু হলো সোনারগাঁয়ের প্রতিটি অঞ্চলে শিক্ষা বিষয়ক সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের উদ্যোগ।
প্রতিটি গ্রামে গ্রামে, সোনারগাঁয়ের স্কুল কলেজ গুলোতে ঘুরে শিক্ষক শিক্ষিকা ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে আলোকিত মানুষ গড়ার স্বপ্ন দেখলেন। আলোকিত মানুষ হতে হলে গাঁয়ের নিরক্ষর লোকদের শিক্ষিত করতে হবে, ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার পাশাপাশি বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আদর্শ সুস্থ সমাজের অবকাঠামো গড়তে হলে সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে হবে। নিজের শেকড়কে চিনতে হবে। কথাটা বলা সহজ, কাজ করাটা ততো সহজ ছিল না।
ছাত্র-ছাত্রীদের এমনকী পরিবারের অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে শাহেদ বারবার হোঁচট খেয়েছেন, আশেপাশে চেয়ে দেখেছেন বিদ্রুপের ভ্র“কূটি তাকে ঘিরে রেখেছে। ললাটি থেকে শুরু করলেন বই পড়ার আন্দোলন। ‘প্রগতি পাঠচক্র’ নামে নিজ খরচে বই কিনে এনে শত শত তরুণ-তরুণীকে বই পড়া এবং সংস্কৃতি চর্চায় উদ্বুদ্ধ করলেন। এ আলো ছড়িয়ে পড়লো সারা সোনারগাঁয়ে। প্রতি সপ্তাহে সোনারগাঁয়ের বিভিন্ন বই বিষয়ক সেমিনার এবং বই পড়–য়াদের আড্ডা জাম উঠলো।
পাশাপাশি শাহেদ কায়েস নিবিড় পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত হলেন কেন বেদে, মুচি এবং জেলেদের শিশুরা প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় অংশ গ্রহণ করে না। ২০০৫ সালের কথা। তরুণ কম্পিউটার বিজ্ঞানী শাহেদ কায়েস ঢাকার পান্থপথে ‘প্রিজম ইনফো সেল’ নামে একটি অফিস স্থাপন করে তথ্য প্রযুক্তির আর্কাইভ নির্মাণের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এ সময়ে তিনি একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন এবং গ্রামের সাথে নিবিড় যোগাযোগও রক্ষা করে চলেছিলেন। সে সময়ে তিনি নিজ গ্রাম ললাটিতে গড়ে তোলেন ছোটদের স্কুল ‘বিদ্যানিকেতন’।
পরে স্কুলটির নাম পরিবর্তন করে নাম রাখেন ‘সুবর্ণগ্রাম আইডিয়াল স্কুল’। প্রগতি পাঠচক্রের মাধ্যমে বই পড়ার নীরব বিপ্লব চলছিল। পাশাপাশি সোনারগাঁয়ের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের (জিপিএ-৫ প্রাপ্ত) জন্য পুরস্কার ও সংবর্ধনার আয়োজনও করছিলেন। সোনারগাঁয়ের গুণিজনদের সংবর্ধনা দেয়ার পাশাপাশি সোনারগাঁয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করার জন্যে সোনারগাঁয়ের পরতে পরতে পাঠচক্রের কয়েকশত তরুণ-তরুণী নিয়ে ঐতিহাসিক স্থানগুলো প্রদক্ষিণ করেছেন। ঐতিহ্য প্রকাশনীর গ্রাম ভিত্তিক বই বিপণনের আন্দোলনে সাড়া দিয়ে তিনি প্রতিটি স্কুলে এবং কলেজে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
নিজ চিন্তাধারা ও কর্ম পদ্ধতি সর্ব সাধারণকে অবগত করার জন্যে তিনি সম্পাদনা করেছেন ‘সুবর্ণগ্রাম’ নামে একটি অনিয়মিত সাপ্তাহিক পত্রিকা। পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে নিজেকে ব্যাপৃত রাখতে সূচনা করেছেন বৃক্ষ রোপন আন্দোলন ’সামাজিক বনায়ন’। এ সুবাদে সোনারগাঁয়ের কাঁচপুর থেকে চেঙ্গাইন দৃষ্টিনন্দন রাস্তার দু’ধারে দশ হাজার বৃক্ষ রোপন করেছেন। সোনারগাঁয়ের দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে ‘সোনারগাঁ বেনিফিট ফান্ড’ নামে গড়ে তুলেছেন একটি সমবায় প্রতিষ্ঠান। কয়েক হাজার সদস্য নিয়ে গঠিত এই সমবায় প্রতিষ্ঠানটি ২০০৭ সালে উপজেলার শ্রেষ্ঠ সমবায় সমিতি হিসেবে সমবায় অধিদপ্তরের পুরস্কার অর্জন করে।
এত সবের মধ্যেও শিক্ষার জন্যে বই পড়ার আন্দোলন থেমে থাকেনি। যেখানে তরুণদের আড্ডা সমাবেশ সেখানেই বই নিয়ে আলোচনা। সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা এবং তার ওপর বক্তৃতা। পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্যে নিজ এবং তরুণদের জন্যে নিজস্ব উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন কয়েক হাজার দুর্লভ গ্রন্থের বিশাল সংগ্রহ। ইতোমধ্যেই এই বইয়ের বিশাল সংগ্রহ ‘সুবর্ণগ্রাম পাঠাগার’ নাম দিয়ে পড়াশোনার জন্যে সর্ব সাধারণের কাছে উম্মুক্ত করে দিয়েছেন।
বন্ধু শাহেদ কায়েসকে এখন খুব সাহসী আর স্বপ্নচারী মন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।