‘কবরের অন্ধকারের কথা হুনছি। কবরের আজাবের কথাও হুনছি। গত চার দিন নিজে তা বুঝতে পারছি। মরি যাওয়ার কোনো ভয় এখন আর নাই। কিন্তু বাইচা থাকলে কেমন লাগব বুঝতাছি না।
’
সাভার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) বিছানায় শুয়ে এভাবেই নিজের অনুভূতি জানালেন মানিকগঞ্জের সালমা আক্তার। প্রায় ৭০ ঘণ্টা পর গতকাল সকাল সাতটার দিকে সালমাকে উদ্ধার করা হয় ধসে পড়া ভবনের চতুর্থ তলা থেকে। উদ্ধারের সময় তাঁর জ্ঞান ছিল না।
সিএমএইচে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে ২২ বছর বয়সী সালমার কথা হয় গতকাল দুপুর ১২টার দিকে। সালমার মতো জীবিত উদ্ধার হওয়া প্রায় ১০৭ জনের চিকিৎসা চলছে সিএমএইচে।
তাঁরা ৪০ থেকে ৭৫ ঘণ্টা পর্যন্ত ধসে পড়া ভবনের অন্ধকার মৃত্যুপুরীতে আটকে ছিলেন।
চিকিৎসাধীন একাধিক ব্যক্তি প্রথম আলোকে তাঁদের বিভীষিকাময় সময়ের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন। বলেছেন, অন্ধকারে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মৃত্যুর ভয়ে অস্থির হয়ে উঠতেন। সে জন্য সব সময় চোখ বন্ধ করে থাকতেন। ঘুমানোর ভান করতেন।
মাঝেমধ্যে ঘুমিয়েও পড়তেন।
সালমা বলেন, মড়মড় শব্দ হওয়ার পরই সবাই জীবন বাঁচাতে সিঁড়ির দিকে দৌড় শুরু করেন। কিন্তু মুহূর্তে ছাদ মাথার ওপরে চেপে আসতে দেখে দুই পাশে থাকা মেশিনের মাঝখানে মেঝেতে বসে পড়েন তিনি। ছাদ ধসে উঁচু মেশিনে পড়ে ক্ষণিকের জন্য আটকে থাকে। পরক্ষণেই ছাদ আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামতে নামতে একপর্যায়ে ফ্লোরের এক হাত ওপরে এসে আটকে থাকে।
সেখানে তাঁর সঙ্গে বেশ কয়েকজন কর্মী ছিলেন। সালমা বলেন, অল্প একটু জায়াগায় সাত-আটজন একজনের ওপর আরেকজন শুয়ে ছিলেন। অন্ধকারে কারও মুখ দেখা যাচ্ছিল না। এ অবস্থায় একজন সহকর্মী মারা যান। মারা যাওয়ার সময় তিনি যন্ত্রণায় সালমার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলেন বলে জানান তিনি।
চতুর্থ তলায় ছিলেন গাইবান্ধার মোমেনা বেগম। বয়স ২৩-২৪ বছর হবে। তিনি জানান, তাঁর ওপর আরও কয়েকজন পড়েছিলেন। জীবিত না মৃত কিছুই বুঝতে পারেননি। মোমেনাকেও গতকাল সকালে উদ্ধার করা হয়।
নাসরীন আক্তারকে উদ্ধার করা হয় গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে। তিনিও চতুর্থ তলায় ছিলেন। গতকাল দুপুরে হাসপাতালে গেলে তিনি এলোমেলো কথা বলছিলেন। কোনো কথাই শেষ করতে পারছিলেন না। হাতে, মুখে ও শরীরে আঁচড়ের চিহ্ন।
ধারণা করা হচ্ছে, মেশিনের লোহা বা রডের আঁচড়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গা কেটে-ছিঁড়ে গেছে। জানা গেল, তিনি একটি কলামের পাশে আটকে ছিলেন। তাঁর ওপর পড়ে ছিলেন কয়েকজন। নাসরীনকে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে।
নাসরীনের ভাই সিরাজুম মনির জানান, নাসরীনের স্বামী নান্নু মিয়াও ওই ভবনে কাজ করতেন।
ধসে পড়ার আগে তিনি চা খেতে বের হয়ে বেঁচে যান। তাঁর দুটি সন্তান আছে।
নাসরীনের সঙ্গে উদ্ধার করা হয়েছে আরেকজনকে। তাঁর অবস্থা খুবই গুরুতর। তাঁকে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস দিয়ে রাখা হয়েছে আইসিইউতে।
সাভার সিএমএইচের প্রধান লেফটেনেন্ট কর্নেল শরীফ আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, নাসরীন মারাত্মক আঘাত না পেলেও তাঁর ওপর লাশ পড়ে থাকার কারণে মানসিকভাবে মারাত্মক আঘাত পেয়েছেন। উদ্ধার হওয়া অনেকের মধ্যে এমন সমস্যা দেখা যাচ্ছে। তাঁদের চিকিৎসায় মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ আনা হচ্ছে। উদ্ধার হওয়া কয়েকজন মারাত্মক চাপা পড়ায় তাঁদের শরীরের ভেতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সিএমএইচে আনা হয় চম্পা নামে একজনকে।
তাঁকে মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে দেখা গেছে। শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় চোখগুলো বড় হয়ে যাচ্ছে। লাশের আশপাশে ছিলেন বলে তখনো তাঁর শরীর থেকে পচা লাশের দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল।
চিকিৎসকেরা জানান, চম্পা কথা বলতে পারছেন না। অনেক কষ্টে নামটা শুধু বলতে পেরেছেন।
বেলা দেড়টা পর্যন্ত সেখানে থাকা অবস্থায় আরও দুজনকে মুমূর্ষু অবস্থায় সিএমএইচে আনতে দেখা গেছে। ভবন ধসে পড়ার পর জীবিত উদ্ধার ৩৬৯ জনকে সাভার সিএমএইচে নেওয়া হয়। এর মধ্যে ১৮ জন পথে এবং দুজন চিকিৎসধীন অবস্থায় মারা যান। ৩২ জনকে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
সিলেটের সুমিত্রা জানান, আটকে থাকা অবস্থায় তাঁর জ্ঞান ছিল।
সারাক্ষণ মৃত্যু ছাড়া অন্য কিছুই ভাবতে পারেননি। উদ্ধারকর্মীরা বের করে আলোতে আনার পর তিনি অজ্ঞান হয়ে যান।
ফরিদপুরের রকিবুল হাসান উদ্ধার হন গতকাল বেলা ১১টার দিকে। বয়স বড়জোর ২০ হবে। তাঁকে মোটামুটি সুস্থই দেখা গেছে।
তিনি জানান, তাঁর পাশে অণিমা নামে একটি মেয়ে ছিল। ভবনধসের পর মেয়েটি একটি কার্টুনের নিচে চাপা পড়েন। কার্টুন ছিঁড়ে ছিঁড়ে তাঁর মাথা বের করা হয়। দুজনকে একসঙ্গেই উদ্ধার করা হয়।
সকালে উদ্ধার হওয়া আবদুর রউফ (৪০) পুরোপুরি সুস্থ।
তিনি জানান, মেশিন এবং কলামের মাঝখানে এক জায়গায় তিনি আটকে ছিলেন। প্রচণ্ড গরমের কারণে তিনি পাশে থাকা কার্টুন ছিঁড়ে নিজেকে বাতাস করতে পেরেছেন। ঘুমিয়েছেনও সময়ে সময়ে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।