"পসার বিকিয়ে চলি জগৎ ফুটপাতে, সন্ধ্যাকালে ফিরে আসি প্রিয়ার মালা হাতে"
আমার টুপি পরার দিন
আমার পূর্বপুরুষদের কেউ মোঘল সম্রাট কিংবা নবাব ছিল বলে জানা নেই। আমার পদবীতে খান জুড়ে দেয়া নেই, তাই কোনকালে পাঠান ছিলাম বলে দাবী করিনা। মোঘল, নবাব বা খানদের মধ্যে পাগড়ি পরার প্রচলন থাকলেও আমার পরিবারে কখনই কাউকে পাগড়ি পরতে দেখিনি। অথচ এই আমি একদিন বাধ্য হয়ে কিংবা সামাজিক প্রথার শিকার হয়ে পাগড়ি পরেছিলাম। আর সেই পাগড়ি পরা যদি টুপি পরা হয় তবে আজকের এই দিনে এক মেয়ে আমাকে টুপি পরিয়েছিল।
পাল্টা আমিও সেই মেয়েকে বেনারসী পরতে বাধ্য করেছিলাম। তবে বেনারসী পরাকে কেউ বাঁকা চোখে না দেখলেও মাথায় টুপি পরানো কিন্তু বোকা বানানোর অর্থেই ধরা হয়। হ্যাঁ সেদিন আমি বোকাই হয়েছিলাম।
অনেকদিন আগের কথা। তখন আমি টোপর বা পাগড়ি না চিনলেও টুপি চিনতাম।
টুপির সাথে ওগুলোর পার্থক্য তখন না বুঝলেও পরে সেটা বুঝেছিলাম। আমার বাবা ছিলেন রোজা-নামাজ পালন করা মানুষ। মানুষ হিসেবেও যথেষ্ট কড়া। তাই নিজের বাউন্ডুলে ছেলেকে সোজা করার তরিকা হিসেবে মাথায় টুপি পরানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। আর সেই টুপি সচল রাখতে মাসিক বেতনে এক মওলানা ঠিক করেছিলেন।
বেচারা মওলানা! বাঁদরের মাথায় টুপি দেখে বড়ই মর্মাহত হয়েছিলেন। আরবী পড়ার মতো জালেমী কাজ এই বাঁদরটা কোনভাবেই মানতে পারেনি। তাই নানারকম বাঁদরামির পাল্লায় পরে মওলানা সাহেবের সকল চেষ্টা গোল্লায় যেতে বসলো। তিনি বুঝতে পারলেন বাঁদর কখনো আরবীকে কলা ভেবে গিলবেনা বরং সে বাংলা-ইংরেজী ভাল করে গিলুক। নতুবা দেশের চিড়ায়াখানায় আরো একটা বানর বাড়বে।
অগত্য কিছুদিন পর আমার মাথা থেকে টুপি নামলো। বাবা আমার মাথায় টুপি না দেখলে নির্ঘাত মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলবে তাই একেবার ন্যাড়া হয়ে বাড়ী ফিরলাম। বাবা আমাকে ন্যাড়া দেখে ট্যারা চোখে তাকিয়ে বললেন- মওলানা তোমাকে আর পড়াবেন না। তোমার আরবী পড়ায় কোন মন নেই। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
সেই থেকে টুপির কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। এই টুপি মাথা থেকে নামার কারণে ইসলামী শিক্ষায় টেনেটুনে পাশ। উর্দুতে ফেল। মার্কশীট নিয়ে বাবার ভয়ে কোন রকমে এগারোকে চুয়াল্লিশ বানিয়ে বাসায় ফিরলাম। চাচাতো ভাইটা ছিল বড় ত্যান্দর।
সে আবার সমস্ত বিষয়ের নম্বর যোগ করে দেখে যোগফল তেত্রিশ কম। সে চেঁচিয়ে বলে উঠলো তুইতো মনে হয় থার্ড না হয়ে ফার্স্ট হয়েছিস। তোর এগ্রিগেট হাইয়েস্ট হবে। আমাকে বলে চল স্কুলে যেয়ে যোগফল শুধরে আনি। আমি কোন রকমে ওকে ম্যানেজ করলাম।
আব্বা যদি জানতে পারে আমি উর্দুতে ফেল করেছি তবে নির্ঘাত গালমন্দ নয়তো কানমলা খাবার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। যদিও উর্দু আমার মূল বিষয় ছিলনা সেটা ছিল অপশনাল বিষয়।
কলেজে উঠেই বানর স্বভাবের এই আমি প্রেমের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বিচরণ করতে শিখলাম। অবশেষে আবার মাথায় টুপি জুটলো, সেটা প্রেমের টুপি। কোন্ প্রেম কোন কাননের ফুল তা সৌরভেই টের পেতাম।
একধিক বান্ধবীর সাথে আমার সখ্য। যদিও আমার হাতে কোন বাশীঁ ছিলনা, তবুও কলেজে আমি রীতিমত কৃষ্ণ। অথচ সেই ললনাকুলের মধ্যে থেকে আমার প্রিয় রাধাকে খুঁজে পেলামনা। সেই রাধাকে পেলাম আমার পাড়ায়। আমার বাড়ীর পাশের বাড়ীতে।
সেই রাধা আমার বড্ড রক্ষণশীলা। ভীষণ রকমের চাপা স্বভাবের। তাই নানা রকম চাপার কারুকাজে তাকে মোহিত করার চেষ্টা করলাম। প্রেমের নানা কৌশলে রাধার মন জয় করতে আমি ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলাম। কিন্তু রাধার সুরেলা মনে আমার বেসুরো বাঁশী কিছুতেই বাজেনা।
তখনো বুঝে উঠতে পারিনি কোন সুরে বাঁশী বাজালে আমার রাধার মন গলবে। এভাবেই কেটে গেল কলেজ জীবন। ভার্সিটি জীবনে এসেই রাধার মন একটু একটু গলতে শুরু করলো। কারণ রাকসু’র সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় পরপর দুবার বির্তকে প্রথম। ধারাবাহিক গল্প বলায় প্রথম ও দ্বিতীয়।
উপস্থিত বক্তৃতায় প্রথম ও দ্বিতীয়। ছবি আঁকা ও পোস্টারে দ্বিতীয় ও তৃতীয়। আর যায় কোথায়? প্রেমের পথ পোক্ত হয়ে গেল। ততদিনে আমার মাথা থেকে অন্যসব টুপি খুলে গেছে। রাধা নামে টুপি আমার হাতের নাগালে।
একদিন সেই টুপি আমাকে পরতেই হলো। তবে সেই টুপির ধরণ বদলে গেলো। ছোটবেলায় উত্তম কুমারকে অনেক ছবিতে টোপর পরতে দেথেছি। ভাবলাম আমারো তেমন একটা টোপর জুটবে। কিন্তু না, তা হলোনা।
আমাদের সংস্কৃতিতে টোপর পরার কোন রীতি নেই। মুসলমান রীতিতে বিয়েতে পাগড়ি পরতে হবে। জীবনে বহুবার টুপি পরার অভ্যাস থাকলেও পাগড়ি পরার কোন অভিজ্ঞতা আমার ছিলনা। তবে বিভিন্ন হিন্দী ও উর্দু ছবিতে অনেক নায়ককেই পাগড়ি পরতে দেখেছি। সেই অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে নির্ধারিত দিনে, নির্ধারিত সময়ে আমাকে টুপি থুক্কু পাগড়ি পরতেই হলো।
আর এই পাগড়ি পরেই রাধার সাথে সেদিন আমার বিয়ে হলো। মজার ব্যাপার হলো আমার রাধা আবার জমজের একজন, অর্থাৎ টুইন। তবে দুইবোন দেখতে একদম আলাদা। আমার রাধা কালো সেই বোন ফর্সা। আমার রাধা খাটো সেই বোন লম্বা।
আমার রাধা কলা অনুষদের ছাত্রী, সেই বোন ডাক্তার। আমার রাধা একঘন্টার বড় সেই সুবাদে সেই বোন আমার প্রিয় শ্যালিকা। ওদের দুজনের একই দিনে বিয়ে হলো দুটো আলাদা পরিবারে। শ্যালিকা ডাক্তার বলেই তার বর জুটলো ডাক্তার। আর আমার বউ কলা অনুষদের বলেই তার কপালে জুটলো একটা বাঁদর।
নানা ছলাকালায় সেই বাঁদর এখনো রাধার সাজানো বৃন্দাবনের শাখা-প্রশাখায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সংসার নামের সেই বৃন্দাবনে আজীবন এভাবেই দাপিয়ে বেড়াতে চাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।