আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

[ফিরে দেখা ঢাবি: মুহসীন হল]- হুমায়ুন জ্বর অথবা ঘোরের ঘেরাটোপে কিছু নিষ্পাপ অপলাপ

বারবার শুধু ছিটকে পড়ি অশ্লীল কারাগারে ’তুই এখানে?’ এরকম প্রশ্নের উত্তরে কোন শব্দ ব্যায় অপচয়ের নামান্তর তাই কান পর্যন্ত দন্ত বিকশিত করেই জবাবটা দিলাম। একেবারে উপযুক্ত সময়ে পারভেজ এর সাথে দেখা। স্কুলে বিশেষ বিবেচনা ছাড়া খুব কমই সরাসরি ক্লাসের ধাপ পাড় হয়েছি। এই যার ইতিহাস সে যদি ক্লাসের ফার্স্ট বয়ের সাথে ঘ ইউনিটে একইসাথে সাক্ষাতকারে দাড়ায় তাহলে দেশের শিক্ষা দীক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধটা আসলেই থাকেনা। পারভেজের আপাতত মুখভঙ্গীর অনুবাদ ছিল এরকমই।

কিন্তু ওরে কেমনে বুঝাই যে, হুমায়ুন আহমেদ নামে এক যাদুকরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মজার স্মৃতি আমাকে আমুল বদলে দিয়ে এ পথে টেনে এনেছে। সবকিছু ঠিকমতো এগুচ্ছিল। হল বরাদ্দের সময় যখন মিনমিন করে মুহসীন হলে থাকার মনোষ্কামনা জানালাম তখনই গর্জে উঠলেন সমাজবিজ্ঞানের ড. নুরুন্নবী। ভর্তি না হতেই হল চিনে গেছ? রোস, এমন হল তোমাকে দিব যে বাপের নামটাই বারবার স্মরণ করতে হবে। বাস্তবিক তা ই হল।

যে হুমায়ুন আহমেদের লোভে ব্যকবেঞ্চার ছাত্রটি এতদুর চলে এসেছে তাকে মুহসীন হল বরাদ্দ দিলে এমন কি ক্ষতি হতো? মুহসীন হল কপালে না জুটলেও মুহসীন হল দিয়েই হল জীবনের অভিজ্ঞতার শুরু করতে অবশ্য ভুল করিনি। ক্লাসমেট রাশেদ কি করে যেন এক বড়ভাইকে ম্যানেজ করে দক্ষিণ ব্লকের দোতলার একটা সিঙ্গেল রুমে উঠে গেল। সেই বড় ভাই প্রায়ই হলে থাকেননা। এই সুযোগে মুহসীন হলে মোটামুটি একটা ঠিকানা গড়ে ফেললাম। প্রথমদিন হলের বিভিন্ন অলিগলিতে হুমায়ুন আহমেদের স্মৃতি হাতড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।

মুহসীন হলটা বাইরে থেকে দেখতে শেরাটন হোটেলের মতো। সিঙ্গেল রুমগুলোও রাজকীয়। বাইরের দেয়ালের পুরোটা জুড়েই কাচের জানালা। এই জানালাগুলো সুদৃশ্য পর্দায় মোড়ার কথা থাকলেও ঘন ঘন রুমের মালিকানা বদল হয় বলে পর্দার কাজটা খবরের কাগজ আঠা দিয়ে কাচে লাগিয়ে চালানো হয়। দক্ষিণদিকের ব্লক হওয়ায় এই কাগজের ফোকড় দিয়ে মারাত্নক রকমের আলো শরীর পোড়াতে লাগল।

রাশেদের অভ্যাস হয়ে যাওয়ায় মড়ার মতো ঘুমালেও আমি উসখুস করছিলাম। এই রৌদ্রালোকিত আবহে আবার ঝির ঝির শব্দে চমকে গেলাম.....এত রোদের মাঝে আবার বৃষ্টি - পাতিশিয়ালের বিয়ে। তবে বৃষ্টির শব্দটা বেশ জোড়ালো। একটু পড়ে দেখলাম বৃষ্টিা আমাদের জানালা বরাবরই পড়ছে। আহ ...এরকম দৃশ্য কি মিস করা যায়..যেইনা জানালা খুলতে গিয়েছি অমনি রাশেদ ঝাপিয়ে পড়ল...ওরে খুলিসনে ..খুলিসনে...খুলছিস কি মইরেছিস...রাশেদের খুলনা সাতক্ষীরার বিচিত্র ভাষায় আমার প্রকৃতি দর্শনে বাধ সাধায় ক্ষিপ্ত হলাম।

প্রকৃতি দর্শন থেকে আমাকে বিরত রাখার পেছনে যে যুক্তিটা দিল তাতে মেধাবী ছাত্রদের প্রতি শ্রদ্ধায় বিগলিত হয়ে গেলাম। উপরতলার দিকে এত ভাল ছাত্ররা থাকে যে টয়লেটে গিয়ে ছোটকর্ম সাড়তে গিয়ে জ্ঞান আহরনের জন্য যাতে সময় নষ্ট হয় সেজন্য জানালার কার্নিশে দাড়িয়েই কর্মখানা সেড়ে ফেলেন। উল্লেখ্য যে, নীচতলা আর দোতলার জানালায় গ্রীল থাকলেও মেধাবী ছাত্রদের সুবিধার্থে উপরের দিকে আর গ্রিল বসানো হয়নি। এপ্রসঙ্গে বলে রাখি দোতলায় ২০৫/৭ এরকম একটি রুমের আবার গ্রিল অর্ধেক কাটা ছিল, যাতে বর্হিশত্রুর আক্রমনে দ্রুত এখান দিয়ে পলায়ন করা যায়, অথবা ভাড়ি অস্ত্র শস্ত্র এখান দিয়ে চালান করা যায়। মেইনগেট দিয়ে সবকিছু করা যায়না কারণ শত হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের লজ্জা বা শ্রদ্ধাবোধ বলতে কিছু বিষয় থাকেই।

রাশেদের আঞ্চলিক কথা বার্তা আর ক্ষেতামির কারণে ওকে একটু এড়িয়ে চলা শুরু করেছিলাম। কিন্তু ভুল ভাঙতে দেরী হয়নি। ওর রুমে অনেকদিন থেকেছি কিন্তু লকারটা ছুতে দিতনা। একদিন ও বাথরুমে থাকার সময় লকারটাতে হামলা চালিয়ে একটা গিবসন উদ্ধার করলাম। তারপর সে ক্ষেতাম রাশেদকেই আবিষ্কার করলাম ওয়েস্টার্ন ক্লসিক দেশীয় মিউজিকের এক চরম বাজিয়ে।

দরজা বন্ধ করে একমনে গিটার বাজাতো আর বেসুরো সুরে গান ধরতাম। মুহসীন হলের ছাদটা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের সেরা। তবে প্রস্থ কম হওয়ায় আর কোন রেলিং না থাকায় মনে হতো এই বুঝি গড়িয়ে পড়ব। হলের দক্ষিন ব্লকের কাটাবনের দিকের মাথাটা একটু নিরিবিলি থাকায় এখানটাতেই ৪/৫ জন মিলে আড্ডা দিতাম। এক সময়ে সবাই উঠে গেলে রাশেদ গীটারে ভারতীয় ক্লসিকের উন্মাদনা তুলত।

একদিন এক বন্ধু বলল, ছাদে এত জায়গা থাকতে তোরা ঐখানে কি করস? ঐখানটা থেকে কর্মজীবি মহিলা হোস্টেলের অনেকটা দেখা যেত। আরে দোস্ যা দেখলামনা এক আপা পুরাই......তারপর বেশ কয়েকদিন আমাদের নির্ধারিত জায়গায় দেখলাম বেশ কয়েকটা গ্রুপ দখল করে রেখেছে!!!!! মুহসীন হলের গল্পে হুমায়ুন আহমেদ থাকবেনা সেটা কেমনে সম্ভব। তবে ফলাফল খুবই খারাপ। হুমায়ুন আহমেদ যে মুহসীন হলে থাকতো তা অনেকেই জানেনা। একদিন সাহস করে সেই ৫৬৪ নম্বর রুমে নক করলাম (এই পরীক্ষাটা হুমায়ুন আহমেদ নিজেও করেছিলেন)।

’ভাই.... হুমায়ুন আছে?’- একটু আমতা আমতা করে জানতে চাইলাম। জানতাম ধরা খাওয়ার চান্স ৯০ ভাগ। কিন্তু রুমের বেকুবটা ১০ ভাগের মধ্যে পড়ছে। ’কোন ইয়ারে কোন সাবজেক্ট’ বিরক্তিত বদনে আমাকে জেরা করতে শুরু করলেন করলেন। ’জ্বি, আইআর, সেকেন্ড ইয়ার’।

না, এখানে এরকম কেউ থাকেনা। ও কার রুমে থাকে এইটা জানলে জানালা দিয়ে লাফ দিতে ইচ্ছে করা উচিত আর হালায় মনে হয় হুমায়ুন আহমেদের নামই শুনেনি। ইচ্ছা করছিল ঘারে ধইরা এফ রহমানের টিনশেডে নির্বাসন করে দেই। হুমায়ন আহমেদ তুমুল জনপ্রিয় হলেও সে যে মুহসীন হলের ছাত্র এ বিষয়ে কম ছাত্ররই জানা ছিল। হলের এক পুরনো কর্মচারীকে হুমায়ুন আহমেদ এর কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

বলল চিনেনা। তার উত্তর ছিল ’ মনে হয় ম্যান্তা মারা নেতা ছিল। ভাল ক্যাডার হইলে হুমায়ুন হোক আর ফুমায়ুন হোক অবশ্যই চিনতাম’ রাশেদ নির্বিবাদী নির্ঝঞাট যুবক। তবে অতিপ্রাকৃত গল্পে বেশ কাবু হয়ে যেত। মাঝে মাঝে বিকেলে হাকিম চত্বরের ফুটপাত থেকে অতিপ্রাকৃত গল্পের শুরু শেষ হতো মুহসীন হলে রাশেদের রুমে ভোরা রাতে।

পৃথিবীর সব অতিপ্রাকৃত চরিত্রেরা হানা দিত আমাদের রুমে। অনেকদিন শেষ রাতে রুমঘেষা মাঠে এক নারীর কান্না শোনার চেষ্টা করেছি। ১৯৭৩/৭৪ সালের দিকে মহসীন হলের বাস্কেট ফিল্ড এর কাছে একটা মেয়েকে ধর্ষন করে গলা টিপে লাশ ফেলে যায় কিছু দুর্বত্তরা। তারপর থেকে দক্ষিণ ব্লকের অনেক ছাত্রই হঠাত কোন রাতে মাঠ থেকে একজন নারীর কান্না শুনতে পেত। তবে আমাদের অতিপ্রাকৃত গল্পের আসরে ভয়ঙ্কর ছায়া ফেলে একটা নিশ্চিত খবরে।

রাশেদের রুমে একটা ছেলে জ্বরে মারা যায় অনেকদিন আগে। তারপর থেকেই ঘুমের ঘোরে শুনতে পেত জ্বরের ঘোরে কে যেন কোকাচ্ছে। কৃষ্ণপক্ষের রাতে দুই উদ্ভ্রান্ত যুবকের ভোজসভা শুরু হতো যথনিয়মে। দক্ষিন ব্লকের ছাদের সিড়ি রুমে হেলান দিয়ে রাশেদের গীটার তুঙ্গে উঠত। একসময় নিস্তেজ হতে হতে এক মায়াবী আলোয় ঢাকা পড়ে যেত মুর্ছনা।

মনে হতো পৃথিবীতে আমরা দুটি মানব সন্তান, বাকীরা মৃত। মুহসীন হলের সুবিস্তৃত খেলার মাঠটা ক্রমেই পরিণত জলজ পুকুর, আস্তে আস্তে ছাদের সমান্তরালে মিশে যেত সবুজ শেওলায় ভরা জলজ অবয়বটি। একটু একটু করে আহ্বান জানাতো অবগাহনের, এক অস্থির আমন্ত্রণ, তাদুকির নেশায় উচ্ছনে যাওয়া মানুষের যেমন ঠিক পরিণতির সময়ে নেশা কেটে যায়, তেমনি নেশা নি:সরিত হয় রাশেদের, ততক্ষণে শীতল পানির আহবানে অনেকটা এগিয়েছি। ঝাপিয়ে পরে রাশেদ। টানতে টানতে সিড়ি ঘরের ভেতরে ফেলে হাপাতে থাকে।

মুহসীন হলের পাশ দিয়ে গেলে চোখে পড়ে মাঠটা এখন আর ছাদের সমান্তরালে নেই। অনেক ব্যবধান। সেই জলজ অবয়ব এখন সবুজ মাঠ, ক্রীড়করা ধুলা উড়ায় নিরন্তর। আমার চোখ চলে যায় ছাদের সেই কার্নিশে, যেখানে ব্যকুল হয়ে জীবনের শব্দকোষে মানে খুজতে থাকে উদভ্রান্ত দুই যুবক। সে যুবকেরা আজ নেই, হয়তো নতুন কোন উদভ্রান্ত যুবকদের ঠিকানা সেই সিড়ি ঘর লাগোয়া ছাদ।

একেবারে ফালতু অনুভুতি তবু চোখ ভিজে যায়.....  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.